অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় সবচেয়ে সুপরিচিত এবং শক্তিশালী ধারণা কোনটি, সে খোঁজ করলে অ্যাডাম স্মিথের ‘ইনভিজ়বল হ্যান্ড’ বা ‘অদৃশ্য হাত’-এর কথা আসবেই। ১৭৭৬ সালে তাঁর মহাগ্রন্থ অ্যান এনকোয়ারি ইনটু দ্য নেচার অ্যান্ড কজ়েস অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস-এ স্মিথ দেখান, মানুষকে অবাধ ভাবে নিজের স্বার্থ অনুসারে কাজ করতে দিলে, এবং মুনাফা অর্জন করতে দিলে কী ভাবে তা শেষ অবধি সমাজের পক্ষেও মঙ্গলকর হয়। তার কারণ, অসংখ্য ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সংহতি বজায় রাখতে সাহায্য করে বাজারের অদৃশ্য হাত। কেনেথ অ্যারো, আমার মতে যিনি গত একশো বছরের শ্রেষ্ঠ অর্থশাস্ত্রীদের অন্যতম, জেরার্ড ডেব্রুর সঙ্গে যৌথ ভাবে এই অদৃশ্য হাত উপপাদ্যের গাণিতিক প্রমাণ পেশ করেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, সেই প্রমাণে তাঁরা দেখান, ঠিক কোন কোন শর্ত পূরণ করা হলে স্মিথের তত্ত্বটি কাজ করবে।
অনেকেই স্বার্থপর আচরণের যুক্তি হিসাবে অদৃশ্য হাত উপপাদ্যটির কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭৮ সালে অ্যারো আর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন; দুর্ভাগ্যক্রমে, সেটি সুপরিচিত নয়। সেই প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘আ কশাস এসে ফর সোশ্যালিজ়ম’। সেই প্রবন্ধে অ্যারো লিখেছিলেন, বাজারকে যদি শুধুমাত্র অনিয়ন্ত্রিত স্বার্থসিদ্ধির দ্বারাই পরিচালিত হতে দেওয়া হয়— সেখানে যদি মূল্যবোধ বা নৈতিকতার কোনও স্থান না থাকে, শুধুমাত্র সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়— তা হলে গোটা অর্থব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়বে।
এই কথাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করছি, কারণ আমরা একটা বিপন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি— স্বার্থপরতা আমাদের রাজনীতিকে সম্পূর্ণ ভাবে গ্রাস করেছে। এখন প্রতি দিন দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যত দুঃসংবাদ মেলে, ইতিহাসের খুব কম পর্যায়েই তত খারাপ ঘটনা একত্রে ঘটেছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বা পশ্চিম এশিয়ার অশান্তিতে প্রতি দিন অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের পায়ের নীচে মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে— উত্থান ঘটছে সর্বাধিপত্যকামী স্বৈরশাসকদের, যাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতা ও দাপটে আগ্রহী; সাধারণ মানুষের জন্য তাঁদের কোনও সহমর্মিতা নেই, উদ্বেগও নেই। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে, বাক্স্বাধীনতায় লাগাম পরানো হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে দমন করা হচ্ছে নির্দয় ভঙ্গিতে, অতি কঠোর পন্থায়। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন তুরস্কে বিপুল দমন-পীড়ন চলছে। বৈশ্বিক কার্যকারণের হদিস রাখেন, এমন পর্যবেক্ষকদের একাংশ বলছেন, আরও অনেক বড় মাপের সংঘাত আসতে চলেছে দুনিয়া জুড়ে— এখন তারই পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন ঘটনায়।
এই বৈশ্বিক উথালপাথাল, গণতন্ত্রের ভূমিক্ষয়ের কারণ একাধিক— সেই কারণগুলি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং যন্ত্রমেধার উত্থানও সমস্যাটিকে বাড়িয়ে তুলেছে। আমি বিশ্বাস করি, দুনিয়া জুড়ে যে তীব্র আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তা-ও এই সর্বাধিপত্যকামী শাসনকে মদত জোগাচ্ছে।
এই বড় কারণগুলিকে অবশ্যই বিশ্লেষণ করা, ভেঙে দেখা প্রয়োজন। কিন্তু এই নিবন্ধে আমি একটি নির্দিষ্ট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কারণের কথা বলব। আগেই উল্লেখ করেছি যে, মূলধারার অর্থনীতি প্রায়শই স্বার্থপরতার জয়ধ্বনি করে। কিন্তু যে সত্যটি অনুল্লিখিতই থেকে যায়, তা হল, অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি সুস্থায়ী বিকাশের জন্য কেবলমাত্র মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়া যথেষ্ট নয়। অ্যারো যেমন বলেছিলেন, বিশ্বাস ও সততার মতো মৌলিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অপরিহার্য।
আজকের এই বিপন্ন সময়ে এই কথাটি মনে রাখা অতি জরুরি। সততা, বিনয় ও সহমর্মিতার মতো মানবিক গুণগুলির প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন, সেগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সহমর্মিতা মানে কিন্তু শুধু নিজের জাতি, বর্ণ, ধর্ম বা জাতীয়তার অংশীদার অন্যদের প্রতি সহমর্মী হওয়া নয়। পৃথিবীর যে প্রান্তেই কোনও মানুষ যন্ত্রণায় থাকেন, সেটি গোটা দুনিয়ার জন্য দুঃখজনক ঘটনা, বৈশ্বিক ট্র্যাজেডি। এই মুহূর্তে আমেরিকায় কিছু মানুষের সঙ্গে সঙ্গে যেমন আচরণ করা হচ্ছে— যেমন, যে ভঙ্গিতে বৈধ কাগজহীন ভারতীয়দের পায়ে শিকল বেঁধে দেশে ফেরত পাঠানো হল— তা এই মৌলিক নৈতিকতার পরিপন্থী।
ভারতীয় হিসাবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সময় ভারত এমন নৈতিকতা, মূল্যবোধের প্রবক্তা হিসাবে দুনিয়ায় অগ্রগণ্য ছিল। স্বাধীনতার সময় নতুন ভারতের ভিত্তিপ্রস্তরে এই কথাগুলি অনপনেয় ছিল। জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতায় এ কথাগুলি শুনেছি। তারও আগে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ‘মহামানবের সাগরতীরে’-র কথা। নজরুল লিখেছিলেন, “ধর্ম বর্ণ জাতির ঊর্ধ্বে জাগো রে নবীন প্রাণ।” ক্ষুদ্র, স্বার্থতাড়িত রাজনীতির পরিবর্তে বৈশ্বিক একতার নীতির প্রচারে ভারত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৫৫-য় ইন্দোনেশিয়ায় বান্দুং সম্মেলন ছিল এই মূল্যবোধের রাজনীতি ও নন-অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্ট-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আফ্রিকা ও এশিয়ার সদ্য-স্বাধীন বহু দেশের রাষ্ট্রনায়করা, এবং, তার নেতৃত্বে ছিলেন নেহরু, এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ।
যে ভারত এক সময় আন্তর্জাতিকতার বার্তা প্রচারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, সে দেশেই এখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং বিদ্বেষ ক্রমবর্ধমান, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ভারতে যাঁরা সংখ্যালঘু বিদ্বেষের রাজনীতি করেন, সংখ্যালঘু নিপীড়নের পথে হাঁটেন, তাঁরা প্রায়শই বলে থাকেন যে, অন্য দেশেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে— অন্য দেশে সংখ্যালঘু হিসাবে হিন্দুরা বিপন্ন— ফলে, ভারতেও এই পথে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। এর চেয়ে অপযুক্তি আর কী বা হতে পারে! অন্য দেশের বা অন্য গোষ্ঠীর কোনও আচরণ অপছন্দ করলে কি কেউ সেই আচরণ নকল করতে চায়? ভারতে যাঁরা সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করেন, তাঁরা ঠিক এই কাজটিই করছেন।
আজ গোটা পৃথিবী যখন সংঘাত আর শোষণের দাপটে ত্রস্ত, তখন আমাদের কর্তব্য নিজেদের সেই নৈতিক অবস্থানটি পুনরুদ্ধার করা; সব মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো। নিজেদের বারংবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, যে কারও যন্ত্রণা, দারিদ্র, বঞ্চনা আসলে আমাদের সবার লজ্জা।
ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক; ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারত সরকার