ধর্মের নামে হিংসা থেকেই আসে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আক্রমণ
Secularism

এখনও যদি না পারি

ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে কী তীব্র বিষের আরক তৈরি হয়, স্বাদ নিন। সর্বশক্তি দিয়ে বলুন, যে অন্ধতা এই নরক তৈরি করতে পারে, তাকে আটকানোর জন্য আমি, আমরা চেষ্টা করব।

Advertisement
সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:২৯
বজ্রপাত: পহেলগামের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কাশ্মীরে ৩৫ বছর পর বন্‌ধ-এ শামিল স্থানীয় মানুষ, অনন্তনাগ, ২৩ এপ্রিল।

বজ্রপাত: পহেলগামের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কাশ্মীরে ৩৫ বছর পর বন্‌ধ-এ শামিল স্থানীয় মানুষ, অনন্তনাগ, ২৩ এপ্রিল। পিটিআই।

যা  চলছে চার দিকে, তাতে নতুন করে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধর্মের নামে হিংসা আর ঘৃণার বিস্ফোরণ, একের অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যের উপর নিতে চাওয়ার এই অন্ধ আস্ফালন— এ সব কি আর নতুন কথা এই ভারতে?

Advertisement

অবশ্য নতুন করে অবাক না হলেও নতুন করে পুরনো কথাগুলো বলা দরকার, কেননা এই উন্মাদনার মধ্যে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা হচ্ছে— ঘৃণা আর হিংসার কারবারিদের থেকেও বেশি করে— উদারতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার কারবারিদের! সত্য সেলুকাস! আজকের সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম না থাকলে জানাই হত না, ধর্মের নামে অধর্মবিষ, রাজনীতির নামে মস্তিষ্কপ্রক্ষালন নীতি কতটা দগদগে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে ভারতীয় সমাজমনকে যে, এমন একটা ঘটনা ঘটার পর আর সব ছেড়ে ‘সেকু-মাকু’ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের উপর শুরু হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন অস্ত্রবর্ষণ— যেন তাঁদেরই দোষে এ সব হল!

অথচ, কাশ্মীরের এই নৃশংস কাণ্ডের পর ধর্মনিরপেক্ষদেরই বেরিয়ে এসে ধর্মের কারবারিদের দিকে আরও বেশি করে, আরও দ্বিধাহীন ভাবে আঙুল তোলার সময়। দৃঢ় স্বরে বলার সময়— এই যে, দেখুন। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করলে মানুষের মন কোন পর্যন্ত বিষিয়ে দেওয়া যায়, দেখুন। প্রবীণ দম্পতি বা মধুচন্দ্রিমাগামী যুগলের জীবন নিমেষে ঝাঁঝরা করে দেওয়া যায়, দেখুন। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে কী তীব্র বিষের আরক তৈরি হয়, স্বাদ নিন। সর্বশক্তি দিয়ে বলুন, যে অন্ধতা এই নরক তৈরি করতে পারে, তাকে আটকানোর জন্য আমি, আমরা চেষ্টা করব।

ধর্মান্ধ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে চাইছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’রা— বিষ প্রশমন করে। আর তাঁদের দিকে যাঁরা আক্রমণ শাণিয়ে চিৎকার করছেন— তাঁরা ঢালছেন আরও বিষ, কেননা তাঁরাও ওই একই ধর্মান্ধতার অসুখে আক্রান্ত। মুসলমান ধর্মান্ধ, হিন্দু ধর্মান্ধ: মুদ্রার দু’টি পিঠ হলেও মুদ্রাটা একই। তাদের ইতিহাস আলাদা, ধরন আলাদা হতে পারে, কিন্তু চরিত্র এক, গন্তব্য এক। শুনছি আমরা, কেমন করে ধর্মান্ধ মুসলমান হিন্দু পর্যটকদের নারকীয় ভাবে হত্যা করেন। দেখছি, ধর্মান্ধ হিন্দু নেতা কেমন সদ্য-পিতৃহারা শিশুকে কোল থেকে কোলে টানাটানি করে ঘৃণা-চিৎকারে উস্কানি দেন যাতে আরও রক্ত ঝরে।

তাই— যাঁরা মঙ্গলবোধে ধর্মাচারী, আজ তাঁদের পক্ষ বেছে নেওয়ার সময়। নিজেদের তাঁরা ফিরে প্রশ্ন করুন, কী চান তাঁরা? আরও রক্ত? ওই ইসলামি জঙ্গিরা যে ভাবে নিরীহ মানুষগুলিকে মারল, ঠিক সেই ভাবেই হিন্দু জঙ্গিরা আরও নিরীহ মানুষকে মারুক, সেটা হলেই কি খুশি হবেন? ধর্ম দিয়েই সব হিসাব মেটাতে চাইবেন? না কি ধর্ম-আচার, ধর্ম-ভাব নিজের নিজের ব্যক্তিগত জীবনে রেখে, বাইরে তাকে টেনে এনে অপরের জীবনে যন্ত্রণা না ছড়িয়ে, বরং সমাজ-রাজনীতিতে সকলের জন্য অন্য কিছু কথা বলবেন? ধর্মনিরপেক্ষ হোন না হোন, ধর্ম দিয়ে জীবন আরও বিষাক্ত করতে চান কি তাঁরা?

ধর্ম আর সন্ত্রাসের সম্পর্ক নিয়ে অনেক তত্ত্ব-তর্ক-প্রলাপ শুনলাম। এই প্রসঙ্গে কেবল একটি সত্যের পুনরুচ্চারণ দরকার, সত্যিকারের ধর্ম কিন্তু অন্য মানুষের জীবন নরক করে দিতে বলে না। না, এই দুনিয়ার কোনও ধর্মই তা বলে না! কিন্তু একই সঙ্গে এও ঠিক যে সব ধর্মসমাজের মধ্যেই এমন অনেক জিঘাংসু মানুষ আছে যারা একটা চাঁদোয়া তৈরি করে ধর্মলিপ্ত মানুষকে তার তলায় টেনে আনতে চায়। সেই মানুষদের মাথার ভিতরটা ধুয়েমুছে তার মধ্যে ঘৃণার বিষ ঢালতে চায়। সব ধর্মেই এরা ছিল এবং আছে। পরম শান্তিপূর্ণ ধর্ম বলে যাকে জানি, প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার দেখিয়েছে সেই ধর্মের নামেও কত হিংস্রতা সম্ভব। এবং, বহু দশক ধরে এ কাজ করে চলেছে জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠীগুলি, ধর্মের নাম নিয়ে হিংসা ছড়িয়েছে গোটা পৃথিবীতে। আল কায়দা, তালিবান, হামাস, লস্কর-ই-তইবা, এরা কত ভয়ঙ্কর বিপদ— তা নিয়ে আজ এক বিন্দু সংশয় থাকতে পারে না।

ঠিক যেমন, কোনও সংশয় থাকতে পারে না যে, এই সব জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠী ও সমগ্র মুসলমান সমাজকে এক করে দেখা অসম্ভব। ভুলে যাওয়া অসম্ভব যে ইসলামি জঙ্গি কার্যকলাপে ভিন ধর্মাবলম্বীরা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত, তার থেকে অনেক বেশি বিপন্ন বিশ্বজোড়া মুসলমান মানুষরাই। ইরাকে। আফগানিস্তানে। প্যালেস্টাইনে। পাকিস্তানে। বাংলাদেশে। কাশ্মীরে। এ বার পহেলগামে যা হল, তাতে কাশ্মীরি মুসলমানের জীবন কত কালের জন্য ছন্নছাড়া হয়ে গেল— যাঁরা ওই উপত্যকার দারিদ্রলাঞ্ছিত দুর্বিপাকপীড়িত জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা সকলেই তা বুঝছেন। সন্ত্রাসবাদীরা ধর্মের নামটি ব্যবহার করে নিজ ধর্মের মানুষের জীবনেই সুবিশাল অভিশাপ ছুড়ে দেয়। এ কথা ভোলা যায় না বলেই ধর্মপালনকে ব্যক্তিগত পরিসরে রেখে সকলের জন্য যে জীবন, যে রাজনীতি— সেখানে ধর্মের উপরে উঠতে চান ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তাঁরা চান, ভারত তার নিজের সেই পুরনো পথে স্থিত থাকুক, আর একটা পাকিস্তান হয়ে না উঠুক— কিংবা আজকের বাংলাদেশও না হোক।

যে কোনও দেশেই ধর্মের নাম নিয়ে সন্ত্রাস ঘটলে সেখানকার ধর্মীয় সমাজের মধ্যে থেকে একটা বড় প্রতিরোধ দরকার। যেমন, এই মুহূর্তে, ভারতের মুসলমান সমাজের মধ্য থেকে সজোরে ধ্বনিত হওয়া দরকার— ‘চলবে না, এ অন্যায় আমরা হতে দেব না!’ কাশ্মীরের মানুষ কিন্তু ঘটনার পর থেকে ঠিক সেটাই করে চলেছেন। মানসিক ভাবে ধ্বস্ত তাঁরা, আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত। তবু ছিন্নমলিন পোশাক পরা কাশ্মীরি ঘোড়াচালক কোনও ক্রমে নিরাপদে রিসর্টে ফিরিয়ে আনছেন প্রৌঢ় দম্পতিকে। টেনেটুনে সংসার চালানো ট্যাক্সিচালকরা বিভ্রান্ত মুখে বলছেন ‘টুরিস্ট হমারি জান হ্যায়।’ ভাঙাচোরা রংচটা দোকানে বসে পর্যটনব্যবসায়ী বলছেন ‘এ আঘাত শুধু ইনসানিয়ত (মানবতা)-এর উপর নয়, কাশ্মীরিয়তের উপরেও!’ ঘটনার অভিঘাতে সাড়ে তিন দশক পর বন‌্‌ধ ডাকা হয়েছে উপত্যকায়, স্থানীয় গরিব মানুষ দল বেঁধে বেরিয়ে আসছেন ক্রুদ্ধ দাবি নিয়ে, ‘জঙ্গিদের চরম শাস্তি হোক’। টুরিস্টদের উপর আঘাত তাঁদের রুজি-রোজগার বন্ধ করে দেবে। কিন্তু সেটুকুই কি সব? কাশ্মীর যাঁরা গিয়েছেন, কাশ্মীরিদের যাঁরা চিনেছেন, তাঁরা কি শুনতে পাচ্ছেন না, ওই মানুষগুলির আন্তরিক স্বরে বেজে উঠছে— ধর্ম মানে ইমান, দুনিয়া তাঁদের মেহমান!

হিন্দু মুসলমান, দুই সমাজেই তো ছড়িয়ে রয়েছেন এই ধার্মিক শান্তিপ্রিয় মানুষগুলি। আজ এঁরা সকলেই ধর্মান্ধতার আক্রমণের সামনে অসহায়। আবার, অন্য দিকে, ধর্মনিরপেক্ষদের সামনেও হয়তো এঁরা অসহায়, কেননা হিন্দু মুসলমান এ সব পরিচয়ের উপরে ওঠার তাগিদে ধর্মনিরপেক্ষরা সাধারণত এই ধর্মপরিচয়গুলিকেই দুচ্ছাই করে বসেন। অথচ সত্যি বলতে, এই ধার্মিক কিন্তু বিদ্বেষবিমুখ মানুষগুলির উপরই নির্ভর করছে আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ। তাই, সামনে অনেক জরুরি কাজ। প্রতি পদে, প্রতি ক্ষেত্রে, কাশ্মীরে মুর্শিদাবাদে কিংবা উত্তরপ্রদেশে মহারাষ্ট্রে, ছোট বড় সব ধর্মান্ধ হিংসাকেই যেন ধিক্কার দিতে পারি, স্পষ্ট সাহসে বলতে পারি, কোদাল হল কোদাল। আর তার সঙ্গে, ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে যে পরিব্যাপ্ত তৃতীয় পরিসর, সহনশীল ধর্মবোধের পরিসর, তাকে যেন স্বীকৃতি আর সম্মান দিতে পারি।

এ সব কথা পণ্ডিতরা ইতিমধ্যেই বলে গিয়েছেন। কিন্তু এ তো কেবল বইয়ের শুকনো তত্ত্বকথা নয়, আমাদের অস্তিত্বের জ্বলন্ত প্রশ্ন। ধর্মের উপরে উঠতে পারা নিশ্চয় এক বাঞ্ছিত পথ। কিন্তু যথার্থ ধর্ম মেনে চলাও তো নিজেকে প্রসারিত করারই একটি পথ। একশো বছর আগে বাঙালি মুসলমান চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদ অনেক ব্যথায় বলেছিলেন, হিন্দু মুসলমান পরিচয় অসত্য নয়, কিন্তু একেই যদি ‘মানুষের চরম রূপ মনে করি তবে শুধু এই পরিচয়ই দেওয়া হবে যে, আমরা অন্ধ।’ এই অন্ধতার সঙ্গে এখনও মোকাবিলা করব না আমরা, এত দাম দেওয়ার পরও?

যদি না করি— তবে সব ক্রমে শূন্য হয়ে যাবে, পড়ে থাকবে কেবল দুই যুযুধান রক্তলোলুপ পক্ষ, আর তাদের সামনে এক দেশব্যাপ্ত মৃত্যু-উপত্যকা।

Advertisement
আরও পড়ুন