গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার ছাত্রী রুমানা সুলতানা। ফল ঘোষণার সময় উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ সভাপতি মহাশয়া ঘোষণা করেন, এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে একক সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন একজন ‘মুসলিম কন্যা’, ‘মুসলিম লেডি’, ‘মুসলিম গার্ল’। সাংবাদিকরা সেই ‘মুসলিম কন্যা’ তথা ‘লেডি’ তথা ‘গার্ল’-এর নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ওয়েবসাইট দেখে নিতে। অর্থাৎ রুমানার নামটি তাঁর কাছে গৌণ। সে মুসলিম মেয়ে। এই তার মূল পরিচয় সংসদের সভাপতির কাছে।
রুমানা সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে কারণ, সে মেধাবী এবং পরিশ্রমী। রুমানা মাধ্যমিকেও পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিল। রুমানা একজন ভাল ছাত্রী। তথাপি উচ্চমাধ্যমিকের ফল ঘোষণার সময় কী ভাবে রুমানার ‘ছাত্রী’ পরিচয় ঢাকা পড়ে যায় তার ধর্ম পরিচয়ের আড়ালে? নেটমাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠার পর সভাপতি মহাশয়া ক্ষমা চেয়ে বলেছেন যে তিনি নাকি ‘আবেগতাড়িত’ হয়ে রুমানাকে ‘মুর্শিদাবাদের মুসলিম কন্যা / লেডি / গার্ল’ বলে ফেলেছিলেন। আশ্চর্য! যাকে ঘিরে এত আবেগ, তার নাম উচ্চারণে এত বাধা কিসের?
বাধা সভাপতি মহাশয়ার মনে। বাধা আমাদের, অর্থাৎ ভারতবর্ষের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত শিক্ষিত উদার সম্প্রদায়ের চিন্তায়। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। বেশ কয়েকবছর আগে ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর উদ্যোগে মেটিয়াবুরুজে একটা ‘ওয়াক’ হয়েছিল। শীতের সকালে বেশ নরম রোদ মেখে আমরা বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট, যোধপুর পার্কের বাবুবিবিরা মেটিয়াবুরুজের অলিতেগলিতে ইতিহাস খুঁজছিলাম। কিন্তু বাস্তব হল, মেটিয়াবুরুজে শুধু ইতিহাস বাস করে না। মেটিয়াবুরুজের বর্তমানও আছে। সেখানে বিচালি ঘাটের রাস্তার দু’দিকে সারি দিয়ে দোকানিরা পসার সাজিয়ে বসেন। মানুষজন সংসার করেন, রাস্তায় চলাচল করেন আর পাঁচটা পাড়ার মতোই। কেন কে জানে বাবুবিবিদের এই পাড়াকে একটু ‘অন্যরকম’ লাগে। তাই এক ‘প্রগতিশীল’ অধ্যাপিকা অনুমতির তোয়াক্কা না করে ওই গলির বাসিন্দাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষজনের, রোদে শুকোতে দেওয়া জুতোজোড়ার ছবি তুলতে থাকেন। আরেক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ শিক্ষিকা মেটিয়াবুরুজের ঘিঞ্জি গলিতে একটি অতীব দামী এবং ফ্যান্সি গাড়ি দেখে মন্তব্য করেন, “বাবা! এসব পাড়ায় এত দামি গাড়ি!” বলেই সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে গাড়ির চালকের দিকে তাকান। ভাবখানা এই যে, এ পাড়ায় এত দামি গাড়ি কেউ সৎ উপার্জনের টাকায় কিনতে পারেন না। নিশ্চয়ই কোনও বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত গাড়ির মালিক!
অনুচ্চারিত কথাটি হল, মেটিয়াবুরুজে শুধুমাত্র গরিব মুসলমানের বাস। এ পাড়ার বিত্তশালী মানেই স্মাগলার আর দক্ষিণ কলকাতার, সৌখিন পল্লির গেটে বোগেনভোলিয়া ঝোলানো বাড়ির বিত্তশালী মাত্রেই সততার প্রতীক!
আসলে সভাপতি মহাশয়া অথবা তাঁর সামাজিক বাতাবরণের মানুষজন, আমাদের মেটিয়াবুরুজে হাঁটতে যাওয়া বাবুবিবির দল— কেউই রুমানাদের চেনেন না। মুসলমান মেয়ে মানেই তাঁদের চোখে ‘পিছিয়ে থাকা’, ‘বোরখা পরিহিত’ ভিক্টিম। মুসলমান মেয়েদের ভিক্টিমহুডে সভাপতি মহাশয়ার এত দৃঢ় বিশ্বাস যে, ক্ষমা চাইতে গিয়ে তিনি রুমানাকে তুলনা করেন প্রায় শতবর্ষ আগের সমাজসংস্কারক এবং লেখিকা বেগম রোকেয়ার সঙ্গে। শতবর্ষে পুরো দুনিয়ার ভোল পালটে গিয়েছে। সভাপতি মহাশয়ার ধর্মের এবং সামাজিক শ্রেণির মহিলারা ঘোমটা খুলে বেরিয়ে এসে প্লেন চালাচ্ছেন। শুধু মুসলমান মেয়েরাই নাকি এখনও বেগম রোকেয়ার কালে পড়ে আছেন। ধন্যি সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মম্ভরিতা!
সভাপতি মহাশয়ারা যে রুমানাদের চেনেন না, তার অন্যতম কারণ মুসলমানদের সঙ্গে এই তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ উদার মানুষরাও সাধারণত সমকক্ষের মতন মেশেন না। মুসলমান মেয়ে দেখলেই এঁদের মধ্যে করুণা করার প্রবণতা দেখা যায়। ধরেই নেওয়া হয় যে, মুসলমান মেয়ে মানেই শিক্ষায় পিছিয়ে। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-’২০ শিক্ষাবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের মোট সংখ্যার ৩১.৪৫% মুসলমান ছাত্রছাত্রী এবং তাদের মধ্যে ৩২.৭৭% মুসলিম মেয়ে। সেকেন্ডারি স্তরে এই সংখ্যা ২৯.৫৪%। এর মধ্যে ৩৩% মুসলমান মেয়ে। হায়ার সেকেন্ডারি স্তরে মোট ছাত্রছাত্রীর ২৩.৯৬% মুসলমান এবং তাদের মধ্যে ২৭.০৯% মুসলমান ছাত্রী। উচ্চমাধ্যমিক সংসদের সভাপতির অন্তত এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে খানিক ধারণা থাকবে, এটা আশা করা যায়।
এই যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে মেলামেশার অভাব, এ কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দু রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমিত নয়। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ, উদার হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষজনও কিন্তু নিতান্ত দরকার ছাড়া মুসলমান পাড়ায় পা রাখেন না। নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে তাঁরা মাঝেমধ্যে রাজাবাজার, পার্কসার্কাস, মেটিয়াবুরুজে যান মুসলমান সম্প্রদায়কে, বিশেষত মুসলমান মেয়েদের ‘উদ্ধার করতে’। আমার সম্প্রদায়ের, অর্থাৎ হিন্দু সাবর্ণ সম্প্রদায়ের অনেক সমাজকর্মীকে বলতে শুনেছি, মুসলমান মেয়ের হিজাব এবং বোরখা ছাড়ানোই নাকি তাঁদের ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রতীক। অথচ সারা পৃথিবী জুড়ে বহু মুসলমান মেয়ে হিজাব পরে তাঁদের ধর্মীয় পরিচিতি দাবি করছেন। ফ্রান্সে প্রস্তাবিত হিজাব এবং বোরখা-বিরোধী আইনের প্রতিবাদে তাঁরা লড়াই করছেন।
সম্প্রতি পার্ক সার্কাস ময়দান-সহ কলকাতার বিভিন্ন স্থানে সিএএ এবং এনআরসি-র প্রতিবাদে মুসলমান মেয়েরা যে অবস্থান-বিক্ষোভ করছিলেন, সেখানে তাঁরা একটা দড়ি দিয়ে অবস্থানস্থলের সীমানা নির্ধারণ করেছিলেন এবং সেই সীমানার ভেতর বসেছিলেন। পার্ক সার্কাস ময়দানে গিয়েও আমার সম্প্রদায়ের তথাকথিত ‘আলোকপ্রাপ্ত’ মানুষজনদের বলতে শুনেছি, “এ কী! এদের (অর্থাৎ মুসলমান মেয়েদের) এমন দড়ির মধ্যে বসিয়েছে কেন?” মানে এই এত বড় সারাদেশব্যাপী আন্দোলন যাঁরা পরিচালনা করছেন, তাঁরা অন্য কারও (পড়ুন মুসলমান পুরুষের) নির্দেশে দড়ির ভেতর বসেছেন। মুসলমান মেয়েদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, তাঁদের এজেন্সি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সন্দিহান হওয়ার মধ্যে যে অহমিকা লুকিয়ে আছে, সেই অহমিকায় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যেন জন্মগত অধিকার। এই অধিকারের জোরেই সংসদের সভাপতি রুমানার নাম উচ্চারণের প্রয়োজন মনে করেন না। রুমানাকে অপমান করেন এবং সবথেকে আশ্চর্যের হল, অপমান করেও বুঝতে পারেন না যে, এটি অপমানসূচক উক্তি!
এই যে রুমানাকে বারবার তার ধর্ম পরিচয়ের মাধ্যমে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করানো, তার মধ্যে আরেকটি মনোভাবও দেখা যায়। যখন হিন্দু উচ্চবর্ণের কোন মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পায়, তখন কখনও সংসদের হর্তাকর্তাদের বলতে শোনা যায়নি যে, ‘একটি হিন্দু মেয়ে / লেডি / গার্ল’ এত নম্বর পেয়েছেন এবং তার নামটি ‘ওয়েবসাইটে দেখে নিন’। অর্থাৎ, হিন্দু মেয়েরা তো পরীক্ষায় ভাল করবেই। তারা তো মুসলমান মেয়েদের থেকে জন্মগতভাবেই মেধাবী ইত্যাদি। তারা তো আমাদের ঘরের মেয়ে, দেশের মেয়ে! আর মুসলমান মেয়ে? সে মেধাবী হতে পারে না? সে আপনার ঘরের নয়? দেশের নয়? এই যে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে অপরায়ন, মানুষকে নীচু করা, একেই বলে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ। এই আধিপত্যবাদ আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান। তাই সংসদের সভাপতির মতো নিরপেক্ষ পদে আসীন হয়েও উনি ভুলে গেলেন রুমানা সুলতানা একজন কৃতী ছাত্রী। তিনি কারও করুণাপ্রার্থিনী নন। তিনি নিজেই নিজের ভাগ্য গড়তে সক্ষম।
(লেখক সমাজকর্মী। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত। পরিসংখ্যান সূত্র: লেখক ও গবেষক সাবির আহমেদ)