মনের জানলা খোলার বার্তা

শুধু সরকারের সমর্থকদের স্বাধীনতা, শুধু একটিমাত্র দলের সমর্থকদের স্বাধীনতা— তাঁরা সংখ্যায় যতই হোন না কেন— আদৌ কোনও স্বাধীনতা নয়।

Advertisement
সুনন্দন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৪৩

যখন দলের সর্বোচ্চ কমিটি মানুষের সমস্ত আবেগের বিরুদ্ধে গিয়ে ঘোষণা করে যে, সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন স্থগিত রাখতে হবে, কারণ বিশ্বযুদ্ধ এখন জনযুদ্ধ, বা দেশে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা সমর্থন করা দরকার, বা ব্যক্তি খতমের পথই শ্রেণিসংগ্রামের পথ, বা সাধারণ মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অবোধগম্য কারণে ইউপিএ সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে হবে— তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কর্মী, সমর্থকরা কি বিহ্বল বোধ করেন? তা হলে এক বার রোজ়া লুক্সেমবার্গের (ছবিতে) সতর্কবার্তা তাঁরা ঝালিয়ে নিতে পারেন। সেই রোজ়া, এ বছর যাঁর সার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হচ্ছে; যিনি কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তার স্বাধীনতা কোথা থেকে উৎসারিত হবে, তা নিয়ে স্বয়ং লেনিনের সঙ্গে বিতর্কে যেতেও পিছপা হননি; যাঁকে মুক্তচিন্তার বিরোধীরা খুন করেছিল আজ থেকে প্রায় ১০৩ বছর আগে।

রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবকে মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানাবার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের সেই জন্মলগ্নেই তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন যে, যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের নামে গণতন্ত্রের পরিসরকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। ‘রাশিয়ার বিপ্লব’ লেখাটি তিনি লিখেছিলেন জেলে বসে, যেখানে নির্ভুল তথ্য পৌঁছবার কোনও সুযোগই ছিল না। কিন্তু ঠিক কতটা হিংস্র আক্রমণের মুখে পড়েছে এই সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সে সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল। তিনি লিখেছেন যে, ঐতিহাসিক ভাবে যা যা সম্ভব, বলশেভিকরা তা করেছে। অলৌকিক কিছু তো আর তারা করতে পারে না। বিশ্বযুদ্ধে শ্রান্ত, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দেশে প্রমাণ করেছে যে, শ্রমিকশ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। এ দিকে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের গলা টিপে ধরছে আর আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির কাছ থেকেও তারা কোনও সাহায্য পাচ্ছে না। এ অবস্থায় একটা নিখুঁত বিপ্লবের আশা করা মানে তাদের অলৌকিক কিছু করতে বলা।

Advertisement

আবার রোজ়া এটাও বলছেন যে, এই নতুন রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ামাত্র নতুন গণতন্ত্রের পরীক্ষা শুরু করতে হবে। ভবিষ্যতে যবে সব বিপদ কেটে যাবে, তখন গণতন্ত্র আনা হবে— তা হয় না। সাধারণ নির্বাচন, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, মতবিনিময়ের স্বাধীনতা না থাকলে সব জনসংস্থাই প্রাণহীন হয়ে যায়। তখন অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় কেবল আধিকারিকদের মধ্যে, দল এবং সরকারের নেতাদের মধ্যে। মুষ্টিমেয় লোক যদি সব ঠিক করে, তবে দুর্নীতি অবধারিত। শ্রমিকশ্রেণির আধিপত্যের বদলে গোষ্ঠীর আধিপত্যও। তাঁর সব আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল।

কমিটি নির্ধারিত শৃঙ্খলা বনাম বৃহত্তর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভাবন— এই দুইয়ের মধ্যে রোজ়া সব সময়েই স্বতঃস্ফূর্ততার পক্ষে। সেই ১৯০৪ সালে রাশিয়ার প্রথম বিপ্লবেরও আগে থেকে ধারাবাহিক ভাবে তিনি মানুষের প্রতি আস্থা রাখার পক্ষে সওয়াল করেছেন। কী করিতে হইবে বইয়ে লেনিন যে পার্টি-র প্রস্তাবনা করেছিলেন— এবং, সে প্রস্তাব অনুসারেই বিশ্ব জুড়ে যে কমিউনিস্ট পার্টি-র ধাঁচা তৈরি হয়েছিল— রোজ়া আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, এতে পার্টির উপর সর্বহারার কর্তৃত্বের বদলে সর্বহারার উপর পার্টির কর্তৃত্ব জারি হবে।

লেনিন একটা আঁটোসাঁটো সংগঠন চাইছিলেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদীদের কাজকর্মের থেকে আলাদা করে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টায়। নারোদনিক আর ব্ল্যাংকিপন্থীরা যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন সে সময়ের রাশিয়াতে। তাঁদের পথ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চমকপ্রদ হিংসাত্মক ঘটনা— যেমন জ়ার-কে হত্যা— ঘটানো। তাঁরা মনে করতেন, জনগণের স্বাধীনতার জন্যেই তাঁরা লড়ছেন। কিন্তু তাঁদের পরিকল্পিত কার্যকলাপ জনগণের মতামত নিয়ে নয়। বরং যত কম লোক জানতে পারে তাঁরা কী করতে চলেছেন, ততই ভাল। অন্য দিকে লেনিন এবং তাঁর অনুগামীরা চাইছিলেন সুসংহত এক বাহিনী, যার সদস্যরা মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত, যাঁরা একযোগে রাষ্ট্রশক্তির একদম গোড়ায় ঘা দিতে পারবেন। এ ব্যাপারে রোজ়া তাঁর সঙ্গে সহমত। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জনতার প্রাণস্পন্দনকে রক্ষা করতে চান। তিনি চাইছিলেন, যে কোনও সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রতিটি পর্বে কোনও কমিটি নয়, প্রাধান্য পাক উদ্বেলিত সর্বহারা। তাঁর সাফ কথা— বিচক্ষণতম কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্রান্ততার চেয়ে একটা সত্যিকারের বিপ্লবী আন্দোলনের ভুলগুলোও অনেক বেশি কাজের।

রোজ়া বলছেন, একটা সর্বোচ্চ কমিটি যদি এমনকি স্থানীয় স্তরেও প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এমনকি স্থানীয় স্তরে কারা সদস্য হবেন, তাঁদের কী ভূমিকা হবে ইত্যাদি স্থির করে দেয়, তা হলে অচিরেই এমন হয়ে উঠবে যে, সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কয়েক জন নেতা— হয়তো তাঁরা খুবই বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান— তার পর তাঁদের বেছে নেওয়া একদল অগ্রগামী পার্টিকর্মী বিভিন্ন সম্মেলনে উপরের কমিটির নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোকে স্বীকৃতি দেবে। রোজ়ার মতে, এ তো সেই ষড়যন্ত্রকারীদেরই রাস্তা।

জনগণ কি তবে অভিজ্ঞতা থেকে সব ঠিক উত্তর খুঁজে পেতে পারে? এই প্রশ্নে রোজ়া আর লেনিন আবার এক জায়গায়— দু’জনেই মনে করেন যে, সর্বহারাকেও শিক্ষিত করে তুলতে হয়, শেখাতে হয় ইতিহাস, বিজ্ঞান, তত্ত্ব। বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের শেখান, আর তাঁদের কাছ থেকে শেখেন— এই জীবন্ত দেওয়া-নেওয়াই উত্তর খুঁজে খুঁজে এগিয়ে চলে।

বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় বিপ্লবী সন্ত্রাসের প্রশ্নেও ট্রটস্কি এবং লেনিনের সঙ্গে রোজ়ার অবস্থানের ফারাক আছে। দেশের ভিতরে-বাইরে আক্রান্ত বিপ্লবের সমর্থকদের পাল্টা হিংসাকে রোজ়া মনে করেছিলেন একটি তাৎক্ষণিক বাস্তবতা— তিনি চাননি এটি একটি চিরকালীন সূত্র হয়ে দাঁড়াক। রোজ়ার চিন্তার অভিজ্ঞান অঙ্গুরী তাঁর স্বাধীনতার ধারণাটি। তিনি বলছেন, শুধু সরকারের সমর্থকদের স্বাধীনতা, শুধু একটিমাত্র দলের সমর্থকদের স্বাধীনতা— তাঁরা সংখ্যায় যতই হোন না কেন— আদৌ কোনও স্বাধীনতা নয়। যাঁরা ভিন্ন ভাবে চিন্তা করেন, তাঁদের স্বাধীনতাই হল আসল স্বাধীনতা।

মনের জানলা খোলা রাখার এই পাঠ্যক্রম প্রস্তাব করার জন্যে, রোজ়া লুক্সেমবার্গ, আপনাকে অভিবাদন।

আরও পড়ুন
Advertisement