খেলাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। গ্লাসগোতে সদ্য-সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলনের পরে চিন ও ভারতকে দোষারোপ— গোটা দুনিয়াকে তারা কী দুর্নিবার ভাবে উষ্ণায়নের গভীর সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কারণ এই দুই দেশ কয়লা ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি নয়। এই দোষারোপে অবশ্য ভারত বা চিন কিছুমাত্র বিচলিত নয়, বরং তারা একে হাতিয়ার করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে লাভ করতে উদ্যোগী। তার এক ঝলক আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় দেখেছি। তাঁর বক্তৃতা এবং তৎপরবর্তী কয়লা কূটনীতি এক ঢিলে তিন পাখি মারল। এক দিকে বলা গেল যে, ভারত উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে অগ্রণী উদ্যোগী; দ্বিতীয়ত, গরিবদের উন্নয়নের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়া হল এই বলে যে, সস্তার কয়লা না হলে তাঁদের সুলভে বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুৎজাত পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়; এবং তৃতীয়ত, বিদেশি মিডিয়া যে হেতু এই দ্বিচারিতার নিন্দা করছে, তা দেখিয়ে বলা হবে যে, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে— অর্থাৎ, ভারত ‘খতরে মে হ্যায়’। আমেরিকা বা ইউরোপের মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। এই সম্মেলনে ধনী দেশগুলিও গরিব দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি থেকে বিরত থেকেছে— যা তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কাজেই, তাদের ছেড়ে শুধু ভারত আর চিনকে ‘কয়লা কেলেঙ্কারি’তে অভিযুক্ত করার মধ্যে পক্ষপাত আছে, সেটাও সত্যি।
গোটা হইচইয়ের মধ্যে একটা ভাবের ঘরে ডাকাতি স্রেফ ধামাচাপা পড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার দু’টি দিক আছে। প্রথমত, অবিলম্বে সারা বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো। গত ৭০ বছরে পৃথিবীর উষ্ণতা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে পৌঁছলেই তা বিশ্বের জলবায়ু আর পরিবেশকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে। ২০২০ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ছিল প্রায় ৩৮ গিগাটন (মনে রাখতে হবে যে, কোভিড-সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে এই বছর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই বন্ধ ছিল)— সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ বছর তা এখনই ৩৭ গিগাটনের কাছাকাছি। তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২১০০ সালে ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখতে গেলে ২০৩০-এ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হওয়া উচিত ১৮.২২ গিগাটন। অর্থাৎ, বর্তমান স্তরের অর্ধেকেরও কম! গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সব দেশ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সবাই যদি তা রক্ষাও করে, তবুও নিঃসরণের মাত্রা ২০৩০-এ দাঁড়াবে ৩৭.৭১ গিগাটনে। তার ফলে ২১০০-তে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে ২.৪ ডিগ্রি। আর যদি বর্তমান হারে নিঃসরণ চলতে থাকে, তা হলে ২০৩০-এ বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ দাঁড়াবে ৪০.৬৬ গিগাটন আর তাতে ২১০০ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে ৩ ডিগ্রি।
এ বার দ্বিতীয় প্রশ্ন। এই গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য কারা কতটা দায়ী? আর এই নিঃসরণ কমানোর দায়ই বা কাদের? ভারত ও চিন যথাক্রমে বিশ্বের প্রথম ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে সামগ্রিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ভিত্তিতে। তাই কূটনৈতিক চাপ তাদের উপরেই বেশি। কিন্তু ভারত আর চিন যৌক্তিক ভাবেই দাবি করে, যে হেতু তাদের দেশের মাথাপিছু নিঃসরণ উন্নত দেশের তুলনায় অনেকটাই কম, শুধু জনসংখ্যা বা দেশের আয়তনের ভিত্তিতে তাদের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা অন্যায্য। ভারতের মাথাপিছু নিঃসরণ ১.৮ মেট্রিক টন, যেখানে আমেরিকার ১৫.২ মেট্রিক টন। চিনের মাথাপিছু নিঃসরণ ৭.৪ মেট্রিক টন— আমেরিকার অর্ধেক। দেশের আয়তন বড়, বা জনসংখ্যা বেশি হওয়ার জন্য তো ভারত বা চিনের ঘাড়ে অতিরিক্ত বোঝা চাপানো যায় না। অকাট্য যুক্তি।
কিন্তু এর মধ্যেও বিরাট একটা ফাঁকি রয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে যে, সারা পৃথিবীতেই ধনীদের নিঃসরণ একই রকম— তা তাঁরা যে দেশেই থাকুন না কেন। সামগ্রিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৫২ শতাংশের জন্য দায়ী পৃথিবীর ৯% ধনী মানুষ— যাঁরা সংখ্যায় মাত্র ৬.৫ কোটি। এর মধ্যে এক শতাংশ ধনী সামগ্রিক নিঃসরণের ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী। আর পৃথিবীর ৫০% দরিদ্র মানুষের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ সামগ্রিক নিঃসরণের মাত্র ৭%। শুধু তা-ই নয়, ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে যে, পৃথিবীর মাত্র একশোটি বড় কোম্পানি ৭১% গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী। প্রত্যক্ষ ছাড়াও পরোক্ষ নিঃসরণের দায়ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বহুজাতিক সংস্থার উপর বর্তায়— যেমন, ইন্দোনেশিয়ার পাম তেলের জন্য নির্বিচার বননিধনের বিনিয়োগ আসে বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাঙ্ক থেকে।
নিঃসরণের হিসাব রাখা হয় উৎপাদনের ভিত্তিতে, ব্যবহারের ভিত্তিতে নয়। যেমন ধরা যাক একটি পোশাক তৈরি হল বাংলাদেশে, কিন্তু তা চলে এল ইউরোপের বাজারে বিক্রির জন্য। কিন্তু বিক্রির পরও এই পোশাক তৈরির জন্য যা নিঃসরণ হয়েছে, তা ইউরোপের খাতে এল না, রইল বাংলাদেশের খাতে। তা ছাড়া, সমুদ্র বা আকাশপথে পণ্য পরিবহণে নিঃসরণের মাত্রা জানা গেলেও তা কোনও দেশের খাতে ধরা হয় না, কারণ তা কোনও দেশেরই আইনি গণ্ডির মধ্যে পড়ে না।
ধনতন্ত্রের কল্যাণে নিঃসরণের মাত্রা কী ভাবে বাড়ছে, তা নির্ধারণ করাটা বিশেষ কঠিন কাজ নয়। কিন্তু, কথাটি স্বীকার করতে সব নেতাই সমান নাচার। তাই বাজারের সাহায্যেই উষ্ণায়নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে। যেমন, শক্তির বিকল্প উৎস— সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি ইত্যাদির বাজার তৈরি করা। কিন্তু এখানে কয়েকটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, বিশ্বে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির মাধ্যমে উন্নয়নের কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। এটা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো, অনির্দিষ্ট। তা ছাড়াও, এর জন্য প্রচুর বিনিয়োগ আর জমির প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, যে বাজার-অর্থনীতি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে, সেই বাজারই তার সমাধান করবে, এমনটা বিশ্বাস করতে অনেক বিজ্ঞানীই নারাজ। তাঁদের মতে, ব্যক্তিস্বার্থ বা মুনাফার স্বার্থ— যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল নীতি— তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে উষ্ণায়নের মোকাবিলা অসম্ভব, সমাধানসূত্র অন্যত্র খোঁজা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে অসংখ্য অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক ভাবে প্রান্তিক মানুষ চরম বিপর্যস্ত। তাঁদের বাসস্থান উপকূলবর্তী, পাহাড়ি, মরু অঞ্চলে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বাধিক। তাই নিঃসরণ কমানোর উপায়গুলি এমনই হওয়া উচিত, সেগুলি একাধারে এই সব মানুষের অভিযোজনেরও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু, এঁদের কথা ভাবার দায় বাজার অর্থনীতির নেই। এঁদের জন্যে অর্থের ব্যবস্থা করতে উন্নত দেশগুলি এক সময় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল, উষ্ণায়নের ঐতিহাসিক দায়ভার স্বীকার করে। সে কথা আর বড় একটা শোনা যায় না। অতএব এঁদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
দাবি উঠছে যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলায় প্রধান শর্ত হওয়া উচিত নৈতিকতা, গরিবের স্বার্থ, এবং সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায়। যা পুঁজিকে পরিবেশের ধ্বংসসাধন করতে বাধা দেবে, সমাজকে বৃত্তাকার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে উৎসাহ দেবে, বাজার-চালিত ভোগবাদ আর বস্তুবাদকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য দিকে গরিব মানুষের উন্নয়নের অধিকারকে মর্যাদা সহকারে বাস্তবায়িত করবে, তাঁদের উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে রক্ষা করবে। নচেৎ, জলবায়ু সম্মেলন রাষ্ট্রনায়কদের কেবল ‘ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল’ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে, যে ভাবে গত তিন দশকে এই নিয়ে ২৬টি সম্মেলন করে এসেছে।
হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি, জার্মানি