ভোটের রাজনীতি সদা পরিবর্তনশীল, তবে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা তার ব্যতিক্রমে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতেও ফলাফলের ছবি এক ইঞ্চিও বদলালো না। এই রাজ্যের মানুষের পক্ষ থেকে বামপন্থী দলগুলোকে প্রত্যাখ্যানের গল্পটা জারি থাকল। ‘মিনি ভারতবর্ষ’ বলে কথিত ভবানীপুর হোক, বা বিড়ি শ্রমিক ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ বা তফসিলি জাতি গরিষ্ঠ গোসাবাই হোক, জমানত বাজেয়াপ্ত হওয়াটাই আজ যেন বামপন্থীদের ভবিতব্য। অথচ মে মাসে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর এই রাজ্যে কত ঘটনাই না ঘটল। আমরা দেখলাম যে দলটিকে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের প্রতীক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের মণিমুক্তো নেতারা নতুন অক্সিজেনের খোঁজে আবার সগৌরবে শাসক দলে ফিরে গেলেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রথম বার পেট্রলের দাম একশো টাকা পার হয়ে গেল। মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক, বা গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত, রাজ্যেও, দেশেও জারি থাকল। বামপন্থীরা জয়ী হবেন, এত বড় কষ্টকল্পনা কেউ করেনি, কিন্তু একটা লড়ার মতো জায়গাতেও তাঁরা আসতে পারবেন না, ভাবতে অবাকই লাগে।
‘আমরা শূন্য কিন্তু আমরাই রাস্তায় আছি’, এই জাতীয় স্তোকবাক্যে কর্মীদের কিছু ক্ষণের জন্য সান্ত্বনা জুটতে পারে। কিন্তু সত্যিটা হল, জনগণের বিশ্বাস বা আস্থার জায়গায় বামপন্থীরা আজ আর নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় কুশলী পোস্ট, আর নিয়মতান্ত্রিকতার ঘণ্টা মেপে প্রতিবাদে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এই সব করে মানুষের আস্থা ফিরে পাওয়া যায় না।
দুর্দশাটা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থীদের নয়। যারা নিজেদের সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় ‘বিকল্প বাম’ হিসাবে তুলে ধরতে সদা তৎপর, তাদের অবস্থাও তথৈবচ। সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে এই সমস্ত বাম দল যারা অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে ও প্রচারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছিল, তাদের সকলের জমানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জয়নগর, কুলতলি বা সাম্প্রতিক ভাঙড়ে প্রত্যাখানের ছবিটা একই রকম।
নির্বাচনী বিপর্যয়ের কথা উঠলেই বিকল্প বামশক্তির বাঁধা গৎ উত্তর হল, তারা ভোটের রাজনীতি করে না, লড়াইয়ের রাজনীতি করে। কিন্তু যদি তাদের লড়াই মানুষকে আলোড়িত করে, মতাদর্শ মানুষকে প্রাণিত করে, তা হলে ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন ঘটবে না কেন! আসলে বিষয়টা হল, প্রচার ও সংগঠনের মধ্যে কয়েক যোজন দূরত্ব, বাস্তবতাবোধের অভাব, এবং সর্বোপরি ভাবনায় সৃষ্টিশীলতা না থাকা। তাই সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সূচনালগ্নে বিকল্প বামশক্তি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও শেষে তার লাভ তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতেই জমা হয়।
সত্যিটা হল, আজ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র বা যুব সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মননে প্রাতিষ্ঠানিক বা বিকল্প, কোনও বামপন্থীরই কোনও প্রভাব নেই। বামপন্থী পাঠ্যক্রমে উল্লিখিত সমালোচনাতে বামপন্থীদের যতখানি আগ্রহ, তার কণামাত্র যদি আত্মসমালোচনায় থাকত, তবে তাঁরা এই বিপর্যয়ের স্বরূপটি উপলব্ধি করতে পারতেন।
এই রাজ্যে অধুনা যে কোনও রাজনৈতিক প্রতর্কে ফ্যাসিবাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। অভিজ্ঞতা দেখায়, অবিজেপি, অবাম রাজনৈতিক দলগুলির ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার মডেল আসলে নরম হিন্দুত্বের মোড়কে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার কৌশলমাত্র। সেই মডেলে বিধানসভায় জন্মাষ্টমী পালন করা যায়, ক্লাবগুলোকে দুর্গাপূজার অনুদান দেওয়া যায়, রাজস্থানে বাল্যবিবাহকে সমর্থন করে প্রস্তাব আনা যায়, বা দিল্লি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি টাকায় রামমন্দির ঘুরিয়ে আনার প্যাকেজ ঘোষণা করা যায়। এই মডেল দিয়ে যথেষ্ট ভাবে হিন্দুত্বের রাজনীতির আদর্শগত বিরোধিতা করা যায় না।
এটাই দুর্ভাগ্য। এই অবস্থায় ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে যাঁরা সবচেয়ে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারতেন, সেই বামপন্থীরা আজ শতধাবিভক্ত, এবং পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। ফলে, বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে তাঁরা মিত্র খোঁজেন কংগ্রেস বা মৌলবাদী সিদ্দিকির মধ্যে, কেউ আবার শাসক দলের জয়েই স্বস্তি পান।
কিন্তু এই চালচিত্রের বাইরে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে অন্য সম্ভাবনাও আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র দূরীকরণ, পরিবেশ, দলিত ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে অসংখ্য ছোট বড় উদ্যোগ ডানা মেলছে। সংস্কার অর্থনীতির অভিঘাত যত তীব্র হচ্ছে, তত বহু সংখ্যক মানুষ প্রতিস্পর্ধা দেখাচ্ছেন। অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রখর দাবিতে অসংগঠিত শ্রমিকরা প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলোর লক্ষ্মণরেখাকে অতিক্রম করছেন। এক বছর পার করে কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলি তো স্বীকৃতি পেল। শুধুমাত্র নির্বাচনী জোটের চশমা দিয়ে দেখলে হয়তো এই নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষাকে ঠাহর করা যাবে না।