এ বার তবে ‘মাসুল পর্ব’
BJP

‘বিবেক’-এর ভূমিকা নিতে কাড়াকাড়ি চলছে রাজ্য বিজেপিতে

মে মাসের পরাজয়ের পর থেকে কেন্দ্রীয় বিজেপি-র শীর্ষনেতারা বাংলায় পা রাখেননি। রাজ্যে সভাপতি বদল হলেও নেতৃত্বের বাঁধন বলে কিছু নজরে পড়ে না।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৪২
 ক্ষোভ: নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘতর হচ্ছে। কলকাতা, এপ্রিল, ২০২১।

ক্ষোভ: নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘতর হচ্ছে। কলকাতা, এপ্রিল, ২০২১।

চার বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপি-র পরাজয়কে ‘দুরমুশ’ বললে অত্যুক্তি হবে না। এই হার অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু যে ভাবে তিন কেন্দ্রে বিজেপি-র জামানত গেল এবং বাকিটিতে পাঁচ মাস আগের জয়ের ব্যবধান এ বার পরাজয়ের খাতায় চারগুণ বৃদ্ধি পেল, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য অন্য রকম।

এই ফলের পরে বিজেপি-র কোন নেতা চৌমাথার মোড়ে কান ধরে ওঠ-বোস করে ‘শপথ’ রক্ষা করবেন, কে মাথা মুড়িয়ে শোকপালন করবেন, সে সব কান-মাথাওয়ালাদের ব্যাপার!

Advertisement

তবে তাঁদের দলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে গায়ে জরির জামা চড়ালেও ভিতরের কঙ্কালসার চেহারা আর গোপন থাকছে না। লোক দেখছে, শুধু ক্ষমতা দখলের তাড়না ছ’মাসের মধ্যে সঙ্ঘ-অনুশাসিত দলটির হাল কোথায় দাঁড় করিয়ে দিল!

ভোটে হার-জিত থাকে। জয়ের দাবি নিয়ে ভোট লড়তে নামাও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এখানে বিজেপি-র ক্ষেত্রে এটা হয়েছে ‘অতি দর্পে হতা লঙ্কা’! দিল্লি দেখানো রাজনীতির অহঙ্কার এবং আস্ফালন তাদের মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে— এটা মানতেই হবে।

বস্তুত, প্রথমে সাধারণ নির্বাচন এবং পরের দু’দফা উপনির্বাচন থেকে জনমতের যে প্রতিফলন দেখা গেল, তাতে আপাত ভাবে রাজ্যে বিরোধী পরিসর যেন ক্রমেই ছোট হচ্ছে বলে মনে হয়। সিপিএমের আমলেও এমনটাই ঘটত। তখনকার বিরোধী দল কংগ্রেস একা বা পরবর্তী কালে তৃণমূল আসার পরে উভয়ের যোগফলেও কোনও নির্বাচনে বিরোধীপক্ষ একশো আসন পেত না। ষাট-সত্তর-আশির ঘরে থেমে যেত। দলবদলের রাজনীতি তখনও আজকের আকার নেয়নি। বিজেপি তো ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না।

জ্যোতি বসু বিরোধীদের উদ্দেশে হরদম বলতেন, “আমরা কি ওদের হয়ে ভোট দিয়ে আসব? ওদের মিটিংয়ে লোক পাঠাব? মানুষ ওদের বর্জন করলে আমাদের কী করার আছে!” সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ২০০৬-এ বামফ্রন্ট ২৩৫ আসন পাওয়ার পরে তৃণমূলকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “ওরা ৩০। আমরা ২৩৫।”

কথাগুলি মনে করার কারণ হল, একাধিপত্য সাধারণত অহমিকা তৈরি করে। দলনির্বিশেষে এটা বাস্তব। তাই বিরোধী পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়া সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে খুব স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। তাতে ‘যা করেছি, বেশ করেছি’ গোছের মানসিকতা প্রশ্রয় পেতে থাকে। ফলে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায়।

আবার মানুষের রায় যদি ঢালাও ভাবে এক দিকে ধায়, তখন এই পরিস্থিতি এড়ানোও কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলার রাজনীতিতে আজকের শাসক দলের একচ্ছত্র রমরমাতে তেমন ছাপ পড়ছে না বললে তা-ও সত্যের অপলাপ হবে।

এ বারের চার উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়ের দিনে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সতর্ক’ বার্তায় তার কিছুটা ইঙ্গিতও মিলেছে। তিনি বলেছেন, “নম্র হতে হবে।ঔদ্ধত্যের জায়গা নেই।” শতাধিক পুরসভার নির্বাচন আসন্ন। এই অবস্থায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের অর্থ সুদূরপ্রসারী। তিনি দলের নিচুতলা পর্যন্ত রাশ টেনে রাখার কথাই বুঝিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া ভুল হবে না। আদতে কত দূর কী হবে, না-হবে, পরের কথা। তবে দল যে ‘অবহিত’, তৃণমূল নেতৃত্বের এমন উপলব্ধির পিছনে ২০১৯-এর নির্বাচনী ধাক্কার অবশ্যই একটি ভূমিকা আছে। বিশেষ করে পঞ্চায়েত, পুরসভা স্তরে যেটা আরও বেশি প্রযোজ্য হয়েছিল। তখন থেকে বিষয়টি নিয়ে চর্চাও হয়েছে বিস্তর। আপাতত তার মধ্যে যাচ্ছি না।

কিন্তু এই সূত্রেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের কথা আসতে বাধ্য। মে মাস থেকে বিজেপি-র ধারাবাহিক পরাজয়ের পিছনেও ঔদ্ধত্য একটি বড় কারণ বলে মনে করি। গোভক্তদের ‘অভিশাপের’ ঝুঁকি আছে জানি। তবু একটি প্রচলিত প্রবাদ মনে আসছে— ‘ঘোড়া রোগে গরু মরে!’ ক্ষমতা পাওয়ার আগেই ‘অহমিকা’-র ব্যাধি। মাত্র দু’বছরের মধ্যে রাজ্যে বিজেপি-র করুণ হালকে এই ভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়।

পিছিয়ে গিয়ে ভাবলে এই তথ্য তো মিথ্যে নয় যে, ২০১৯-এর লোকসভার ফল তৃণমূলের বিপদঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। ১৮-টি আসন জেতার সুবাদে ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি-র
এগিয়ে থাকা ছিল চাপের প্রথম ধাপ। সেই সঙ্গে তৃণমূলের নিচুতলায় বাঁধুনির গোলমালও ধরা পড়ে গিয়েছিল।

বোঝা গিয়েছিল, শহরে, গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় বহু বাহুবলী ও দুর্নীতিবাজ শাঁসে-জলে পুষ্ট হয়ে উঠেছে। মানুষ তাদের বর্জন করার মওকা খুঁজেছে। ভোটই তার হাতিয়ার। এতে ক্রমে তৃণমূল উদ্বিগ্ন এবং বিজেপি বিশেষ উল্লসিত হয়ে ওঠে।

এই পর্যন্ত কোনও ভুল নেই। কারণ শাসকের দুর্বল জায়গা ধরা পড়লে বিরোধী তাতে স্বস্তির জায়গা খুঁজবেই। কিন্তু স্বস্তি এবং প্রাপ্তির তফাত বিজেপি করতে পারেনি। গাছে ওঠার আগেই এক কাঁদি কলা খাওয়ার ‘স্বপ্ন’ তাদের গ্রাস করল। তারা ধরেই নিল, ক্ষমতায় এসে গেছে! যার পরিণতিতে দলের রাঘব বোয়াল থেকে চুনোপুঁটি, সবাই উদ্ধত হয়ে উঠলেন। হাবভাবে, আস্ফালনে মনে হতে লাগল যেন তাঁরা গদিতে বসে পড়েছেন!

পুরো প্রচারপর্ব জুড়েই বিজেপি হুমকি দিয়ে, দাপাদাপি করে ‘ক্ষমতা’ জাহির করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে পুলিশ, আমলা সবাইকে ‘দেখে নেব, জেলে ঢুকিয়ে দেব, চাকরি খাব’ বলে শাসিয়েছে এবং তাতে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের মদত মিলেছে।

সাধারণ মানুষের মনে এগুলির বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিছু কম হয়নি। দৌড় শুরু করেই এত ঔদ্ধত্য তারা পছন্দ করেনি। শাসকের চেয়ারে বসে পড়লে এদের আরও কী চেহারা দেখা যাবে, সেই অনিশ্চিত শঙ্কা ছায়া ফেলেছিল ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে। ওই বিরাগ মুছে যাওয়ার মতো কোনও কারণ গত পাঁচ-ছয় মাসে ঘটেনি। বরং নানা কারণে মানুষের কাছে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা আরও কমেছে, উপনির্বাচনগুলি তার প্রমাণ।

পরাজয়কে ‘গ্রহণ’ করাও এক ধরনের শিক্ষা। মানুষ আরও দেখল, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে ‘নম্র’ হওয়া দূরে থাক, ক্রমশ বেশি করে চাতুরির আশ্রয়ে চলে গেল বিজেপি। সঙ্গে হুমকি-হুঙ্কার তো আছেই।

চাতুরির সবচেয়ে ‘উৎকৃষ্ট’ উদাহরণ হল সংখ্যাতত্ত্ব। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নিরিখে বিধানসভায় এগিয়ে থাকা ১২১ আসনকে ভিত্তি করে ২০০ আসনের চ্যালেঞ্জ লড়তে নেমেছিল বিজেপি। অমিত শাহ প্রকাশ্যে এবং দলের অন্দরে বুঝিয়েছিলেন, শাসক তৃণমূলের ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি’ থেকে বিজেপি আরও ‘লাভবান’ হবে। উত্তম কথা।

পরিহাস হল, হারার পরে ওই ১২১-কে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিজেপি বলতে শুরু করল, ২০১৬ সালের তিন জন বিধায়ক থেকে এ বার তাদের ৭৭ জন বিধায়ক। অর্থাৎ এটাই দলের অগ্রগতি। আত্মসমীক্ষার এই নমুনাই প্রমাণ করে তাদের দিশাহারা অবস্থা।

মে মাসের পরাজয়ের পর থেকে কেন্দ্রীয় বিজেপি-র শীর্ষনেতারা বাংলায় পা রাখেননি। রাজ্যে সভাপতি বদল হলেও নেতৃত্বের বাঁধন বলে কিছু নজরে পড়ে না। বরং দেখা যাচ্ছে ‘বিবেক’-দের উত্থান! কখনও দিলীপ ঘোষ সেই ভূমিকায়, কখনও তথাগত রায়, কখনও অন্য কোনও মেজ-সেজ’রা। সবাই বাজার গরম করতে নেমে পড়েছেন।

তাঁদের বক্তব্যের মর্মার্থ হল, ভোটের স্বার্থে যা করা হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। তৃণমূল-ভাঙানো সবচেয়ে বড় ভুল। এই নিয়ে আবার দিলীপ-তথাগতের তরজা নেমে এসেছে কলতলার ঝগড়ায়। হাওড়া শহরের বিজেপি সভাপতিকে বহিষ্কারের জেরও অনেক দূর গড়াবে না, এমন ভাবা ভুল হবে।

না, এখনই একে ‘মুষল পর্ব’ বলব না। তবে ‘মাসুল পর্ব’ তো বলা যায় বটেই। লোভের মাসুল!

আরও পড়ুন
Advertisement