১৯৯২ সালের হলিউড সিনেমা স্নিকার্স-এর একটি চরিত্র, ইরউইন এমেরি বলেছিল ক্রিপ্টোগ্রাফি বা সঙ্কেতবিদ্যা এমন জটিল গাণিতিক পরিকাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে যে উপযুক্ত ‘কি’ বা চাবি ছাড়া তার সমাধান অসম্ভব। ছবিটিতে কিন্তু গুন্টার ইয়ানিক নামে এক অঙ্কবিদ প্রোগ্রাম করে ফেললেন ছোট্ট বাক্সের মধ্যে রাখার মতো একটা ‘চিপ’। পৃথিবীর সব কম্পিউটারের নিরাপত্তার তালা ভেঙে তা পাঠোদ্ধার করে ফেলল সমস্ত শ্রেণিবদ্ধ তথ্যের। এটা কি কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছিল?
সেই আশির দশকের গোড়া থেকেই রিচার্ড ফেনম্যান কিংবা ডেভিড ডয়েচের মতো পদার্থবিদ বলে এসেছেন অতি দ্রুত কোয়ান্টাম গণনার সম্ভাবনার কথা। স্নিকার্স ছবিটি মুক্তি পাওয়ার দু’বছর পরে, ১৯৯৪-তে, আমেরিকান অঙ্কবিদ পিটার শোর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রয়োজনীয় অঙ্কটা করে ফেললেন। এর বাস্তব রূপায়ণে মরিয়া হয়ে উঠল দেশ-বিদেশের প্রযুক্তিবিদরা। গুগল, আইবিএম, ইনটেল, মাইক্রোসফ্ট-এর মতো কোম্পানি তেড়েফুঁড়ে ঢুকে পড়ল কোয়ান্টামের গোলকধাঁধার রহস্য আয়ত্ত করতে।
কম্পিউটার যে ভাষা বোঝে তাকে বলে ‘বিট’, যা ‘বাইনারি ডিজিট’ কথাটির সংক্ষিপ্ত রূপ। শূন্য (০) আর এক (১) দিয়ে যার প্রকাশ। এ যেন একটা গোলকের দুটো মেরু। কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিন্তু নিতে পারে গোলকের উপর অন্যান্য বিন্দুও। এল কোয়ান্টাম বিট বা ‘কিউবিট’-এর ধারণা, যার সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে থাকে ২-এর ঘাতের সঙ্গে। যেমন, ২ কিউবিট নিতে পারে ০০, ০১, ১০ এবং ১১— এই চারটি। তেমন ভাবে ১০০ কিউবিট হলে সম্ভাবনার সংখ্যাটা ২-এর ঘাত ১০০, যা ১-এর পরে ৩০টি শূন্য হলে যা হয়, তার চাইতেও বেশি। কিন্তু দ্রুততাই তো শেষ কথা নয়। কিউবিট দ্রুত কাজ করলেও বাড়ে ভুলের সম্ভাবনা। ভুলের পরিমাণ জমে তা হয়ে যেতে পারে সাধারণ কম্পিউটার চিপের চাইতেও খারাপ। যদিও সপ্তরথীর নিরাপত্তা নিমেষে ভাঙা কিংবা তথ্যের সমুদ্র মন্থন করে অভাবনীয় দ্রুততায় অমৃতভাণ্ড তুলে আনার মতো কাজে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রয়োগ-সম্ভাবনা অনন্ত, সুবিশাল তার সম্ভাব্য বাণিজ্যিক রূপরেখাও।
গত ডিসেম্বরে গুগল ১০৫ কিউবিট-সম্পন্ন আধুনিকতম কোয়ান্টাম কম্পিউটার চিপ ‘উইলো’-র কথা ঘোষণা করে চমকে দিল দুনিয়াকে। ‘উইলো’ নাকি পাঁচ মিনিটেরও কমে এমন একটি গণনার কাজ সম্পন্ন করেছে যা করতে একটি শীর্ষ-স্তরের সুপার কম্পিউটারের লাগবে ১০ সেপ্টিলিয়ন বা ১-এর পরে পঁচিশটা শূন্য দিলে যা হয় তার চাইতেও বেশি বছর, মহাবিশ্বের বয়সের থেকেও যা বেশি। কোয়ান্টাম সেক্টর নিয়ে দুনিয়ার এই বিস্ময়টা অবশ্য ছিলই। যার ফলে লক্ষ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ হচ্ছে এই ক্ষেত্রে।
কিন্তু কেউ তো আর ১০ সেপ্টিলিয়ন বছর ধরে সুপার কম্পিউটার চালিয়ে দেখেনি। পরিবর্তে সহজ কোনও কাজ করে সে অনুপাতে কঠিন কাজের সময় হিসেব করেছে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য গুগলের ‘সাইকামোর’ কোয়ান্টাম চিপের কথা মনে পড়তে বাধ্য। ২০১৯-এ গুগল এনেছিল ৫৩ কিউবিটের এই কোয়ান্টাম চিপ, যা নাকি ২০০ সেকেন্ডে করে ফেলে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের দশ হাজার বছরের কাজ। ২০২২-এর এক গবেষণাপত্রে এক দল চিনা গবেষক কিন্তু দেখান, সাধারণ কম্পিউটারে গণনার পদ্ধতি পাল্টে কাজ করা যায় ‘সাইকামোর’-এর চাইতেও দ্রুত। ‘উইলো’ নিয়েও এ ধরনের সন্দেহ থাকবেই।
সুবিধামতো কাজ করার উপযুক্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে ঠিক কতটা ক্ষমতা-সম্পন্ন হতে হবে, আর কবে তা আমাদের করায়ত্ত হবে, এই দুটো প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই। ‘উইলো’ ঘোষণার মাসখানেক পরে, ‘এনভিডিয়া’-র সিইও জেনসেন হুয়াং বললেন, কাজের উপযোগী কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসতে নাকি এখনও লাগবে ১৫ থেকে ৩০ বছর। ব্যস, এই একটা কথাতেই কোয়ান্টাম-সংক্রান্ত কোম্পানিগুলির শেয়ারদর কমে গেল মোটামুটি ৪০%, মুছে গেল প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু কেন? মানুষ কি ভেবেছিল যে গুন্টার ইয়ানিক-এর সেই ছোট্ট বাক্সে রাখা ‘চিপ’খানা আমাদের পকেটে প্রায় এসেই গিয়েছে? সেটা পেতে দেরি আছে শুনেই কি এই অভিব্যক্তি? হুয়াংয়ের সঙ্গে কিন্তু সহমত পোষণ করেছেন মার্ক জ়াকারবার্গের মতো বিশেষজ্ঞও।
বস্তুত, অনেক বিশেষজ্ঞই বলে আসছেন, সুবিধামতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসতে লাগবে আরও ২০-৩০ বছর। মজার কথা হল, গত ২৫ বছর ধরেই এই একই সময়সীমার পূর্বাভাস করে আসছেন তাঁরা। খুব সাবধানিরা অবশ্য মনে করছেন, এমন কোয়ান্টাম চিপ আসবে না আমাদের জীবনকালে।
আসলে এখনকার কোয়ান্টাম চিপের যে অবস্থা তাতে তার কাজ করতে লাগে পরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে মূলধনি বিনিয়োগ, আর সেই সঙ্গে কাজ চালানোর খরচ— যাকে বলে ‘ক্যাপেক্স’ আর ‘অপেক্স’। তাই অদূর ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে আমাদের পকেটে আসবে না, সেটা সহজেই অনুমেয়। প্রায় সাত দশক আগে ভারতের প্রথম কম্পিউটার যখন আসে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে, সে ছিল এক বিশাল যন্ত্র। আমাদের অল্প বয়সেও কম্পিউটার রুম রাখতে হত খুব ঠান্ডা করে, সেখানে ঢুকতে হত জুতো খুলে। সেখান থেকে আজকের ধুলো, তাপমাত্রা, আর্দ্রতায় সহনশীল এবং ভ্রমণ-কালে কাজ করার উপযোগী ছোট আকারের আধুনিক ল্যাপটপ বা ট্যাব পর্যন্ত। বিবর্তনের যাত্রাপথ কিন্তু এক দিনের নয়। তেমনই কোয়ান্টাম কম্পিউটারেরও বিবর্তিত হয়ে গুন্টার ইয়ানিকের ছোট্ট বাক্সে রাখার উপযোগী হতে অনেকখানি সময় লাগাটাই স্বাভাবিক।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রধান দুটো প্রয়োজনীয় স্থিতিমাপ অবশ্যই তার কিউবিটের সংখ্যা আর প্রাথমিক কাজে কতখানি নির্ভুল সে। জেনসেন হুয়াং বলছেন, আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের যা কিউবিট-সংখ্যা, ঠিকমতো কাজের উপযোগী হতে গেলে প্রয়োজন তার অন্তত এক মিলিয়ন গুণ বেশি কিউবিট। এই হিসাবটা খুব একটা ভুলও হয়তো নয়। কোয়ান্টাম জার্নালে ২০২১-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০৪৮ বিটের কোনও সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে প্রয়োজন ২০ মিলিয়ন কিউবিট সম্পন্ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
কিন্তু এতটা দক্ষতা আসবে কবে? উত্তর খুঁজতে শরণ নেওয়া যেতে পারে মুরের ল’-র। প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে মুরের সূত্র কাজ করে অদ্ভুত ভাবে। এই সূত্র অনুসারে প্রযুক্তি ফুলেফেঁপে ওঠে মোটামুটি প্রতি দু’বছরে দ্বিগুণ পরিমাণ। এগিয়ে চলে গুণোত্তর প্রগতিতে। কোয়ান্টামের ক্ষেত্রে এই সূত্র প্রযুক্ত হলে এক মিলিয়ন কিউবিট অর্জন করতে কিন্তু এসে যাবে ২০৫০ সাল। আইবিএম গত বছর বলেছে যে তারা এক লক্ষ কিউবিট অর্জন করতে পারবে ২০৩৩-এ। সে হিসেবেও মিলিয়ন কিউবিট আসতে প্রায় লেগে যাবে ২০৫০।
কিন্তু সেটাই বা কতটা সহজসাধ্য? কোনও কাজে যদি ১০০০ কিউবিট লাগে, তবে নির্ভুল গণনার জন্য ২-এর ঘাত ১০০০ যা হয় সেই সংখ্যক অবিচ্ছিন্ন চলক-কে রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণে। ২০১৯-এ সলিড-স্টেট ইলেকট্রনিক্স জার্নালে এক গবেষণাপত্র লিখেছেন ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি মোপলিয়ে, সিএনআর-এর মিখাইল ডায়াকোনভ। শিরোনাম ‘হোয়েন উইল উই হ্যাভ আ কোয়ান্টাম কম্পিউটার?’ একটি আকর্ষণীয় সমান্তরাল ঘটনার অনুষঙ্গ বর্ণনা করেছেন ডায়াকোনভ। তিনি লিখছেন, সাইকেল চালাতে গিয়ে, খানিক শেখার পরে, আমরা গতি, দিক, এবং রাস্তার সঙ্গে আমাদের শরীরের কোণ, এই তিন ধরনের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সার্কাসে যিনি এক চাকার সাইকেলে খেলা দেখান তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন চার ধরনের স্বাধীনতাকে। কোনও সাইকেলে ২-এর ঘাত ১০০০ হলে যা হয়, সেই সংখ্যক সন্ধিস্থল থাকে যা সাইকেলের অংশগুলির একটিকে অপরের প্রেক্ষিতে অবাধে ঘুরতে দেয়, তবে কেউ কি সেই সাইকেলে আদৌ চড়তে পারবে? উত্তরও দিয়েছেন তিনি; বলছেন, পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা এই বিশাল সংখ্যার স্বাধীনতার ডিগ্রি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলেই সম্ভবপর হবে এটা। যার অর্থ, কখনওই তা সম্ভবপর নয়, বলছেন ডায়াকোনভ!
স্নিকার্স ছবির মতো ছোট বাক্সে ভরা কোয়ান্টাম চিপ তৈরি এবং তা ব্যবহারের দক্ষতা হয়তো অর্জিত হবে, কখনও। তবে তা আগামীকাল হবে না নির্ঘাত। হবে হয়তো কালকের পরের কোনও দিন।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা