RG Kar Medical College and Hospital Incident

‘কথার বড়ো ধার’

‘দাবি’ শব্দটি প্রতিবাদের। নির্দিষ্ট কোনও ‘বাদ’-এর বিপরীতেই থাকে ‘প্রতিবাদ’। চিৎকারে, স্লোগানে, প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ যখন কোনও বিষয়ে নিজের আপত্তিকে প্রতিষ্ঠা করে তখন নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়।

Advertisement
পায়েল বসু
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:২৯

কথা কেবল মার খায়না কথার বড়ো ধার/ মারের মধ্যে ছল্‌কে ওঠে শব্দের সংসার।” শঙ্খ ঘোষের ‘স্লোগান’ কবিতার, কথা আর শব্দের মতো চরিত্ররা চিরকাল আশ্চর্য স্পর্ধায় বিপ্লবকে ডেকে এনেছে। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে, চলো দিল্লি-র মতো ধারালো কথারা জেগে থেকেছে ইতিহাস বইয়ের পাতায়। ৯ অগস্টে এ রাজ্যে যখন কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে, পরিকল্পিত প্রাতিষ্ঠানিকতায় হত্যা করা হল, এই নারকীয় ঘটনার বিচারের দাবিতে তিনটি দাপুটে শব্দ, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, এত দিনে ইতিহাস গড়ে দিয়েছে।

Advertisement

‘দাবি’ শব্দটি প্রতিবাদের। নির্দিষ্ট কোনও ‘বাদ’-এর বিপরীতেই থাকে ‘প্রতিবাদ’। চিৎকারে, স্লোগানে, প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ যখন কোনও বিষয়ে নিজের আপত্তিকে প্রতিষ্ঠা করে তখন নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়। সমাজের সঙ্গে আম আদমির যোগাযোগের সেতু নির্মাণ করে দেয় দৃশ্য-শ্রাব্য ভাষিক উপাদান। যেমন গান-নাচ-নাটক, ছবি। প্রফুল্লচন্দ্র রায় এক সময় আক্ষেপ করেছিলেন, বাংলায় এসে সকলেই সোনা পায়। শুধু বাঙালির মুঠিতে ওঠে ধূলি। তবে তিলোত্তমার ঘটনায় যুবশক্তির সোনার কাঠির ছোঁয়ায় এ বার অন্তত বাঙালি মেরুদণ্ড সোজা রাখার স্পষ্ট ভাষা পেল।

সাধারণত কথ্য বা মৌখিক এবং লিখিত ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ভাষার নির্মাণ। স্লোগান, ছড়াকাটা, কবিতা পাঠ, গান— এগুলো মৌখিক রীতির মধ্যে পড়ে। অন্য দিকে ক্যালিগ্রাফি থেকে পোস্টারিং, দেওয়ালচিত্র থেকে পথচিত্র প্রতিবাদী ভাষাকে সহজ নান্দনিক প্রকাশ দেয়। নীরবতার ভাষা হয়ে ওঠে প্রতীক, চিহ্ন।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, “স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষজন/ স্লোগান দিতে গিয়ে আমি বুঝতে শিখি কে ভাই কে দুশমন।” গণআন্দোলনে মিছিল এবং স্লোগান পরস্পরের হাত ধরে হাঁটে। এই ‘স্লোগান’ শব্দটি এসেছে স্কটিশ-গেলিক ভাষার স্ল (সেনা) এবং গাইর্ম (কান্না) থেকে। ঐতিহাসিক ভাবে যার অর্থ যুদ্ধনাদ। সহজ, সংক্ষিপ্ত বাক্য সমাজ-রাজনীতি-ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদী ভাষ্য হয়ে ওঠে। বার বার উচ্চারিত হয়ে জনচেতনাকে জোরালো ধাক্কা দেয়। এই সংহত ঐক্যস্বর হল স্লোগান।

পতাকাবিহীন গণআন্দোলনের ন্যারেটিভ তৈরি করেছে স্লোগানের ভাষা। যেমন— জাস্টিস ফর আর জি কর অবিচল রাখা হয়েছে। আগে বসানো হয়েছে, তোমার আমার একটাই স্বর, বাঙাল ঘটির একটাই স্বর, এই মিছিলে উঠুক ঝড়, যতই আসুক বৃষ্টি ঝড়, নাটক ছেড়ে বিচার কর ইত্যাদি। মেয়েদের রাত দখলের স্লোগান হয়েছে— উই ওয়ান্ট জাস্টিস, লড়তে হলে আজকে লড়ি, মেয়েরা রাত দখল করি। ভিক্টিম-কেন্দ্রিক (তিলোত্তমার রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ, তিলোত্তমা ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই), ধর্ষককেন্দ্রিক (আমার মাটি আমার মা ধর্ষকদের হবে না/ আমার রাস্তা আমার ডাক ধর্ষকরা নিপাত যাক/ ধর্ষকদের চিনে নিন এই মাটিতেই কবর দিন/ ধর্ষকদের চামড়া গুটিয়ে দেব আমরা), বিচারকেন্দ্রিক (মাঠে-ঘাটে শপথ নেব বোনের বিচার ছিনিয়ে নেব/ বিচার তুমি দেবে না নিস্তার পাবে না) স্লোগান তৈরি হয়েছে। হিন্দিতে, পহেলে বেটা পড়াও/ ফির বেটি বচাও, ইংরেজিতে, হোয়্যারএভার আই গো/ হাওএভার আই ড্রেস/ নো মিনস নো, ইয়েস মিনস ইয়েস— লোকের মুখে মুখে ঘুরেছে।

বাংলা ছড়ার মেঠো সুরের স্লোগানে রাজপথ মুখরিত থেকেছে। ছাত্ররা তালে তালে বলেছেন, আতা গাছে তোতা পাখি স্বাস্থ্য ভবন সাফাই বাকি, নোটন নোটন পায়রাগুলো ঝোটন বেঁধেছে/সিন্ডিকেটের আঁতুড়ঘর ধরা পড়েছে, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান/ চেয়ার নয় বিচার চাই সেটাই দিয়ে যান। সিস্টেমের বিরুদ্ধে গর্জনকে ঢেকে দিয়েছে মজার পোশাকে। যেমন, বিনীত গোয়েলকে চিনে নে, ওএলএক্স-এ বেচে দে, পুলিশ তুমি দুষ্টু লোক/ তোমার মাথায় উকুন হোক। ছাত্রআন্দোলনের ক্ষোভের ভাষা সব সময় সংযত থাকে না। বিশ্বের বহু আন্দোলনের মতো এ ক্ষেত্রেও মুখরোচক পানিং, হালকা স্ল্যাং ব্যবহার এড়ানো যায়নি।

ভাষাচিহ্ন দেখে, স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণকে শুধুমাত্র সমাজমাধ্যমভিত্তিক নাগরিক প্রতিবাদ বলা চলে না। এ কথা ঠিক, সমাজমাধ্যমের মাধ্যমে হিউস্টনবাসী এলিটের প্রতিবাদ ছড়িয়েছে, এ অত্যাচার থামবে কবে? তুমি পথে নামবে কবে? মানুষের মতো দেখতে হলে সবাই কিন্তু মানুষ হয় না। ছড়িয়েছে শ্রমিকের প্রতিবাদ। সুন্দরবনে, প্রান্তিক মহিলার স্লোগান— মা-বোনেদের একটাই স্বর, আর শহুরে গিগ-শ্রমিকের স্লোগান মিলেমিশে গিয়েছে, জাস্টিস ফর আর জি করে। রিকশা-শ্রমিকের চিৎকার শোনা গিয়েছে স্থির ছবিতে। চলমান ছবিতে নথিভুক্ত থেকেছে সে সমাজের বয়ান— আমির গরিব সবকা বেটি বহেন হ্যায়/ জব তক নির্ণয় নহি হোগা তব তক ইয়ে র‌্যালি চলেগা।

তিলোত্তমার জন্য আন্দোলন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। স্লোগানের আয়নায় সে ক্ষেত্রে উঠে এসেছে রক্ত-মাংসের আস্ত একটা দেশ; ‘প্রতিবাদে পুজোয় মাটি/ দেবে না আর সোনাগাছি।’

গণের ভাষার শক্তিশালী স্বর হল গান। দ্রোহের ভাষার নেপথ্যে থাকে সুর-তাল-বাদ্য। প্রতিবাদের গানে রবীন্দ্রনাথ (বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো) বা নজরুল (কারার ঐ লৌহকপাট) এসেছেন, এসেছে সলিল চৌধুরীর ‘পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে পথ চেনা’ বা ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে’, মৌসুমী ভৌমিকের ‘স্বপ্ন দেখব বলে আমি দু’চোখ পেতেছি’। ইতিহাসে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ বা ‘বেলা চাও’ চিরকালীন। তবে, সদ্য অতীতে বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থানের অনুঘটক ‘মনে রেখো যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি’ গানের উন্মাদনা আমাদের জনজাগরণেও পেলাম। ঐতিহাসিক হয়ে রইল অরিজিৎ সিংহের ‘আর কবে’ গানটি। গানে ‘আর কবে?’ প্রশ্নটা ফিরে ফিরে এসে দ্রোহকালকে অ্যান্থেমের শক্তি জুগিয়েছে।

ছবির ভাষা সর্বজনীন। বাঙালি যদি বলে ‘এটা গাছ’, সাহেব বুঝবেন না। গাছের ছবি এঁকে দিলেই দিব্য বুঝে নেবে ওটা ‘ট্রি’! প্রতিমা আদলের নারীমুখ, আগুন রঙা ভোর, জনসমুদ্রের ঢেউ বুঝিয়ে পোস্টার করেছে ছোটরা। শিরদাঁড়া প্রতীককে বৃত্তাকারে ঘিরে আঁকা হয়েছে স্বাধীনতা, শিক্ষা, ব্যারিকেড সরে যাওয়ার চিত্রভাষা। উড়ন্ত কাকের জবানিতে রাখা হয়েছে— খাঁটি শিরদাঁড়া! ফ্রি হোম ডেলিভারি! প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঘর্মাক্ত মানুষের মেরুদণ্ড খোঁজার ডিজিটাল অভিব্যক্তি অসাধারণ। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল মহমেডান তিন ভাই ভ্যানের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বোন তিলোত্তমার কাছে রাখি বেঁধেছে— পোস্টারের এই আবেগী ভাষা ঐতিহাসিক। স্প্রে দিয়ে ওয়াল গ্রাফিতি বা দেওয়ালচিত্র, স্টপ রেপ, ধিক্কার, ছিঃ! রাস্তার ক্যানভাসে জাগিয়ে রাখা হয়েছে তিলোত্তমার রক্ত-চোখ তিলোত্তমার হক। সাইন (চিহ্ন) ল্যাঙ্গুয়েজে হাতের মুদ্রায় বোঝানো হয়েছে ‘জাস্টিস’!

এ সব মনে করিয়ে দেয়, মানুষ নিয়ে হয় ভাষা। মানুষ নিয়েই রচিত হয় ইতিহাস।

আরও পড়ুন
Advertisement