COVID19

ভেসে যাবে কিছু মুখ, তাতে কী

আনন্দোৎসবে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার পর সরকারবাহাদুরও তার ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তায়।

Advertisement
বিষাণ বসু
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২১ ০৯:৫২

পুজোর হইহই শেষ। সারা রাত ধরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিমাদর্শন, বুর্জ খলিফার বিস্ময় চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার শেষে গা-ম্যাজম্যাজ জ্বরজ্বর ভাব, সিজ়ন চেঞ্জ না কি কোভিড, বলা মুশকিল। কিন্তু সকলেই একমত, দু’দিন দেখা যাক না। এই দেখার দিনগুলোর ফলাফল যে বাকিদের পক্ষে ঝুঁকির হতে পারে, সে নিয়ে ভাবার অভ্যেস আজকাল আর নেই।

আনন্দোৎসবে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার পর সরকারবাহাদুরও তার ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তায়। কোভিড ওয়ার্ড খোলার তোড়জোড় পুরোদমে। উৎসব রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই এমন চটজলদি উদ্যোগ! সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞান থাকলে তো পরিণতির অনুমান কঠিন ছিল না। তবে যে সরকারের মন্ত্রী প্যান্ডেলে জনপ্লাবন দেখে উচ্ছ্বসিত হন, আর অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অবিচল বলতে পারেন, আনন্দ-উৎসব নিয়ে এমন প্রশ্ন তোলাটা দুর্ভাগ্যজনক— সেই সরকারের কার্যাকার্য নিয়ে প্রশ্ন তোলাই হয়তো অবান্তর।

Advertisement

তা ছাড়া কে যেন কবে বলে গিয়েছেন, জনগণ তেমন সরকারই পেয়ে থাকেন যেমনটি তাঁদের প্রাপ্য। আদালত প্যান্ডেলে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে যে জনসাধারণ প্যান্ডেলের ঠিক বাইরে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন, মিডিয়ার প্রশ্নের সামনে একগাল হাসি নিয়ে বলেন, অসুখ-বিসুখ তো থাকবেই কিন্তু পুজো তো রোজ আসবে না— তাঁদের অসুখ-বিসুখের দায়টা সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া অনৈতিক। কেননা, সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং জনগণের স্বার্থ যথাসাধ্য রক্ষাই সরকারের দায়, পুরনো সিনেমার কমল মিত্র সুলভ দাপুটে অভিভাবক হয়ে থাকার গুরুদায়িত্ব পালন সরকারের পক্ষে মুশকিল।

তা হলে এ অবস্থার জন্যে দায়ী কে?

কেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা!

ধূমপান, মদ্যপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের শেষে ঘোর অসুস্থ হয়ে, শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে পৌঁছে চিকিৎসকের অমানবিকতা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আর হাসপাতালের বিল যদি একমাত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে এ তো একেবারেই নস্যি!

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গাঁধীজির অভিযোগ ছিল, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সঞ্জাত অসুখের চিকিৎসার মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞান পরোক্ষে তেমন জীবনযাত্রাকে প্রশ্রয় দেয়, কাজেই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও অনৈতিক। অনভিজ্ঞ ঔদ্ধত্যে এই অভিযোগ উড়িয়ে দিতাম। কোভিডকাল কথাটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাল।

পুরসভা নিজ দায়িত্ব খুবই মনোযোগের সঙ্গে পালন করছে। নিয়মিত কত জন পজ়িটিভ, সে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গে জানানো হচ্ছে, সংক্রমিতের মধ্যে কত জন টিকাপ্রাপ্ত। দেখা যাচ্ছে, সংক্রমিতের বড় অংশই টিকাপ্রাপ্ত। এই তথ্য থেকে অনেক রকম ধারণাই করা যেতে পারে। যেমন, যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁরা বেশি সচেতন, সুতরাং জ্বর-সর্দিকাশিতে তাঁরা তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করিয়েছেন। অথবা, টিকা নেওয়ার আত্মবিশ্বাসের চোটে তাঁরাই বেশি হইহই করে বেড়িয়েছেন। অথচ সংক্রমিত মানেই অসুস্থ নয়। গুরুতর অসুস্থের মধ্যে টিকাপ্রাপ্তের হার কেমন, সেটা কয়েক দিন বাদেই বোঝা যাবে। সারা বিশ্বের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলে এখানেও দেখা যাবে, আইসিউ-এ ভর্তি যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই টিকা নেননি। কিন্তু সেই তথ্য পাওয়ার জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে, কোভিড আর একটু জাঁকিয়ে না বসা অবধি সেই তথ্য পাওয়া মুশকিল। এ দিকে পুরসভার তথ্য থেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, টিকা নিয়েও কিছুই লাভ নেই, এমনকি টিকা নিলে সংক্রমণের সম্ভাবনা নাকি বাড়ে।

অথচ এই তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় রাজ্য সরকার বেশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। এই ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এমন খবর শুনে পেডিয়াট্রিক আইসিউ বেড বাড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সরকারি মেডিক্যাল অফিসারদের বিশেষ কোভিড ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণের কাজও হয়েছিল। কিন্তু ভিড় বাড়তে না দেওয়ার মতো আনুষঙ্গিক পদক্ষেপের অভাবে পুরোটাই মাঠে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা।

আপাতত উপায়? চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের এক জন হয়ে বলি, খুব হতাশ লাগছে। পেশার হিসাবে ভাগ করলে দেখা যাবে, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছেন। এত জন সহকর্মীর মৃত্যুও সামান্যতম বার্তা দিতে পারল না সমাজের বাকিদের! ছেলেবেলায় বইয়ে সমাজবন্ধু বলে কিছু পেশার কথা থাকত। খাটা পায়খানা সাফাই করেন যাঁরা, তেমন পেশা মানবতার অসম্মান বলে বিলুপ্ত। কিন্তু আপনাদের অবাধ আমোদ-আহ্লাদের মলমূত্র সাফাই করতে হবে যাঁদের, সেই আমাদের কথা কে ভাববেন? কবে ভাববেন?

যাকগে সে সব হাহুতাশের কথা। পুজোশেষে কাশফুলে ঢাকা পথ বেয়ে ঢাকিরা ফিরে গিয়েছেন। সঙ্গে কাঁসর বাজানো ঢাকির ছেলেটি। পুজোয় গিয়ে তার নতুন জামা জুটেছে। বাবুর ছেলের বাতিল করা প্রায় নতুনের মতো জুতো। এ বার তার ইস্কুল খোলার কথা। কিন্তু তাকে হয়তো আবার চাষের কাজে যোগ দিতে হবে। বাবুর ছেলেও জ়ুম ক্লাসে ফিরবে। হুল্লোড় শেষ, আবার সেই বোরিং রুটিন, তারও।

এরই মাঝে কয়েকটা মুখ ভাসানের প্রতিমার মতো মুছে যাবে। তা হোক, উৎসব কি আর রোজ রোজ আসে...

কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল

আরও পড়ুন
Advertisement