সমাজমাধ্যম ও অন্যান্য গণমাধ্যমে পরিবেশিত ও প্রচারিত বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করে একটা গোটা গণতন্ত্রকে ভারসাম্যহীন করে দিতে পারে। কোনও যুগেই শব্দ আর ছবির এত ক্ষমতা বা নাগাল ছিল না, যা আজ নানা সমাজমাধ্যমের সূত্রে সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি, কোনও যুগেই মাধ্যমগুলির আজকের মতো এতটা লাগামছাড়া দায়িত্বহীনতা ছিল না। আজ সবাই লেখক, সবাই সংবাদ পরিবেশক। কিন্তু শব্দ, ছবি, আর সম্পাদিত ভিডিয়োর শক্তি কতখানি,
সেটা খুব কম মানুষ উপলব্ধি করেন। সংবাদ এবং মতামত যে দুটো আলাদা বস্তু, এবং তাদের যে আলাদা রাখাই বাঞ্ছনীয়, এ কথা আমাদের অবিলম্বে বুঝতে হবে।
বিকৃত তথ্য পরিবেশনের মূল উদ্দেশ্যই হল বিশ্বাসী, অলস মনের সুযোগ নেওয়া। মানুষের গভীরতম বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে এমন এক আবেগ ও চিত্তচাঞ্চল্য তৈরি করা, যাতে তাদের যুক্তিবোধ অচল হয়ে যায়। এই নিপুণ প্রতারণার কৌশলের বিরুদ্ধে পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন ও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। ‘ম্যানিপুলেশন ইন্ডেক্স’ তৈরি হচ্ছে, তথ্য যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক দল-মত-জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রকৃত তথ্যভিত্তিক সংবাদ-সচেতনতা তৈরি করার প্রয়াস চলছে।
উল্টো দিকে, ফেসবুক-কে নানা অপতথ্যের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হিসাবে বিভিন্ন মামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই সংস্থারই মালিকানাভুক্ত হোয়াটসঅ্যাপ ভারতীয় উপমহাদেশে এতই জনপ্রিয় যে, কৌতুক করে বলা হয়— ভারতে সূর্যোদয় হলে ক্যালিফর্নিয়ার সার্ভারগুলির উপর খুব চাপ পড়ে, এক সঙ্গে একশো কোটি মানুষের পরস্পরকে পাঠানো সুপ্রভাত-বার্তার চাপে! এত দূর যার নাগাল, তাকে গণমাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রচারের লাভজনক ফন্দি তো স্বাভাবিক ভাবেই কিছু গোষ্ঠীর মাথায় আসবে!
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বিভ্রান্তিকর তথ্যের উদ্দেশ্য মোটামুটি ছয়টি ধারায় বিভক্ত— রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, (অপ)বিজ্ঞান-মূলক, প্রযুক্তি-সম্পর্কিত, আবহাওয়া সংক্রান্ত, এবং আইনকানুন সংক্রান্ত। এই তালিকার মধ্যে বিশেষ করে আমাদের নজরে পড়ে কোনও আসন্ন নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সংখ্যা ও যুক্তির ছদ্মবেশে মিথ্যে ঘটনার প্রচার, ইতিহাসের বিকৃতি ও পুনর্নির্মাণ, ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব, ভ্যাকসিনবিরোধ বা কোভিড-১৯ বিষয়ে অপতথ্য, পরিবেশ নিয়ে অবৈজ্ঞানিক প্রচার, কুসংস্কার বা অপসংস্কার; বা কখনও কখনও নেহাতই খেলা বা বিনোদনজগৎ থেকে কুরুচিকর চাঞ্চল্যকর মিথ্যে রটনা। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণের কথাই ধরা যাক। হঠাৎ প্রচার হল, টিকা নিয়ে লাভ নেই, কারণ টিকা নেওয়ার পরও অনেকে মারা যাচ্ছেন। পরিসংখ্যান পেশ করলে ঠিক তার উল্টোটা দেখা যাবে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ২৮ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের ১০ এপ্রিল থেকে ৪ সেপ্টেম্বর— এই সময়কালের মধ্যে আমেরিকায় করোনা আক্রান্ত হয়ে যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে যত জনের দু’টি টিকাই নেওয়া, কোনও টিকা না নেওয়া রোগীর সংখ্যা তাঁদের ছ’গুণ। আরও মারাত্মক মৃত্যুর পরিসংখ্যান— এই সময়কালে দু’টি টিকা নেওয়া কোভিড রোগীর তুলনায় টিকা না নেওয়া আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনা বারো গুণ বেশি। অর্থাৎ একটি-দু’টি ঘটনার প্রচারেই মানুষের ধারণা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে যে, টিকাটি কার্যকর নয়! পরিসংখ্যানতত্ত্বে এই ব্যতিক্রমগুলিকে ‘আউটলায়ার’ বলা হয়। এই ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলিকে প্রচার করেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়।
আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ) থেকে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, গত বছর পয়লা মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল, এই দুই মাস ধরে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কী ভাবে টুইটারে, এবং হরেক টিভি চ্যানেলে কোভিড সম্বন্ধে ভুল তথ্য প্রচার করছিলেন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মতো অপ্রমাণিত টোটকা ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছিলেন— বহু বিশ্বাসী মানুষ প্রেসিডেন্টের পরামর্শ শুনে আরও অসুস্থ হয়েছেন, কেউ কেউ মারাও গিয়েছেন!
আমাদের মন এই বিভ্রমের সরল শিকার হয় কেন, তারও কতকগুলি মূল কারণ শনাক্ত করা যায়— কোনও প্রক্রিয়া সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণা, ভাষার বিভ্রান্তিকর ব্যবহার, কোনও ঘটনার আদি-অন্ত না জেনে বা না জানিয়ে কেবল চাঞ্চল্যকর অংশটুকু প্রচার করা, ছবি বা ভিডিয়োর অংশবিশেষ সম্পাদনা করে তার প্রচার, কুযুক্তির ব্যবহার, এবং স্ববিরোধী মানদণ্ডে কাউকে অভিযুক্ত করার স্বভাব। যখন কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই ভ্রান্ত তথ্যকে হাতিয়ার করে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা জায়গায় বিতর্কে মাতেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক কোন্দলে, তখন সমস্যা আরও বাড়ে— কারণ, সেই তাৎক্ষণিক তর্কের পরিসরে এই অপতথ্যগুলি খণ্ডন করার জন্য কোনও পক্ষপাতহীন বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন পাওয়া যায় না। নিজের ইচ্ছেমতো এগুলি ব্যবহার করে তাঁরা তর্ক চালাতে থাকেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিতর্কদর্শনের সুপরিচিত ‘অ্যাড হোমিনেম’ ত্রুটি— তর্কের যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিযুক্তি খাড়া না করে প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা। কেউ কোনও অপতথ্যের বা কুযুক্তির প্রতিবাদ করলে তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, এত দিন তিনি কোথায় ছিলেন— আগে বিরোধী দল কর্তৃক নানা অপতথ্য প্রচারের সময়ে তিনি চুপ করে ছিলেন কেন?
নানা দেশে ‘সোশ্যাল লিসনিং’ প্রযুক্তিটি ক্রমাগত আন্তর্জালে কান পেতে শুনে চলেছে কে কী বলছেন, এবং জনগণের আবেগ-সংজ্ঞায়ন ও বিশ্লেষণও সেখানে প্রকাশ করা হয়। এর বেশ কিছু প্ল্যাটফর্মে ক্রমাগত পরিমাপ করা হয় পণ্যজগতের নানা তথ্য নিয়ে নানা মাধ্যমে কী রকম প্রচার চলছে, কত জনের কাছে পৌঁছল সেই প্রচার, তাঁদের এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া কী রকম, কোনও বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বা গোষ্ঠীর প্রভাব আছে কি না, এবং পৃথিবীর মানচিত্রে কোন কোন স্থানে এর উল্লেখ বেশি দেখা যাচ্ছে। একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ‘বিভ্রান্তিকর তথ্যের সূচক’ পরিমাপ তৈরি করে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য ভাবে তুলে ধরা যায়— যেমন করছেন ‘নিউজ়-লিট’ বা ‘চেকোলজি’র কর্মীরা। ভারতের নানা রাজ্যে স্থানীয় ভাষায় যদি এ রকম অলাভজনক সংস্থা তৈরি করা যায়, তা হলে বিভ্রান্তিমূলক ক্ষতিকর তথ্যের এই বন্যাকে হয়তো খানিকটা প্রতিহত করা যায়।
বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্য সবার আগে অবশ্য প্রয়োজন সচেতনতার। আমাদের ব্যক্তিগত মতামত ও অবস্থান তৈরি করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য তথ্যের। সামাজিক শিক্ষায় নানা মতামতের খোলামেলা আলোচনা যেমন হওয়া দরকার, নিজের মতের বিরুদ্ধমত খোলা মনে এবং উদার ভাবে শোনাও তেমনই দরকার। ভলতেয়ার যেমন বলেছিলেন, “আমার মত তোমার মতের সঙ্গে না মিললেও, তোমার মতপ্রকাশের অধিকারের জন্য আমি জীবন দিতে রাজি!” কোনও চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে এলেই সেটা শেয়ার করার আগে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত, তথ্যটির সত্যতা যাচাই করা দরকার, বিশেষ করে সেই তথ্য যদি অন্য কারও ক্ষতি করতে, অথবা প্রাপকের মনে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই ভাবে যদি সচেতনতা তৈরি হয়, একমাত্র তা হলেই সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যমে আমাদের মগজ পরিচালিত করার জন্য যে বিকৃত তথ্যের প্রচার ঘটানো হয়, তার অবসান ঘটতে পারে।