Abortion Law

নিজগর্ভের মালিকানা নিজের নয়

১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলার রায়, যার হাত ধরে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট তখন গর্ভপাত মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে মান্যতা দিয়েছিল।

Advertisement
আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২২ ০৪:৫০

আসন্ন মাতৃত্ব তাঁর মডেলিং পেশার ভবিষ্যৎ শেষ করে দেবে— মোবাইল ফোনে এই রকম দুশ্চিন্তার কথা কাউকে জানাতে জানাতেই রেলের ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন এক তরুণী মডেল। সেখানে আগে থেকে তিন জন নারী উপস্থিত। এক জন ল্যাপটপে কাজ করছেন, এক জন রেলের সাফাই কর্মী, তিনিও তাঁর কাজ করছেন। আর তৃতীয় জন শাড়ি পরিহিতা, কোলের বাচ্চার কান্না থামাতে গিয়ে তাঁর হাত থেকে দুধের বোতল পড়ে যায়। ওই মডেল এতে একটু বিরক্ত হন এবং তা টপকে চলে যান। সাফাই কর্মীটি এগিয়ে এসে দুধের বোতলটি তুলে দেন। কথা ওঠে সন্তান তথা মাতৃত্ব পেশার পক্ষে প্রতিবন্ধকতা কি না, তা নিয়ে। প্রায় সাড়ে তিন মিনিটের বিজ্ঞাপনের শেষ দিকে পঞ্চম নারী খাকি পোশাক পরে যখন সেই ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন, তখন শাড়ি পরিহিতা নারীটির পরিচয় জানা গেল— তিনি এসএসপি। বিজ্ঞাপনটি শেষ হয় এই ভাবে যে— সেই উদ্বিগ্ন মডেল পরবর্তী কালে একটি ম্যাগাজিন সেই এসএসপি ম্যাডামকে উপহার হিসাবে পাঠান, যেখানে তাঁর গর্ভকালীন সময়টি উদ্‌যাপনের ছবি কভার পেজে রয়েছে।

২০২২ সালেই নারী দিবসের প্রাক্কালে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি তাদের প্রেগন্যান্সি কিটের বিজ্ঞাপনে এই নারী দিবসের ভাবনা সামনে আনে, এবং বিজ্ঞাপনটি বেশ জনপ্রিয় হয়। বিজ্ঞাপনে পাঁচটি চরিত্র, পাঁচ জনই নারী। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, তাঁরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে কর্মরতা। কর্মরতা নারী স্বাধীন— এমনই ধারণা। কিন্তু, এই নারীর গর্ভধারণ বা গর্ভপাত কি শুধুই তাঁর সিদ্ধান্ত? আইভিএফ প্রযুক্তির কল্যাণে এখন যখন মাতৃত্বের জন্য এক জন নারীর পক্ষে এক জন পুরুষ সঙ্গীর অনিবার্যতাটুকুও শেষ হয়ে যেতে বসেছে; তখন, গর্ভ যে নারীর একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর— এই কথা বলাই যায়। গর্ভধারণ, বহন, পালন অথবা গর্ভপাতের সমস্ত ঝাপট তাঁকে একা সামলাতে হলেও, কার্যক্ষেত্রে গর্ভধারণ বা গর্ভপাত বিষয়টিতে নারীর একক এজেন্সি থাকে না। এসে পড়ে পরিবার, ডাক্তার, কর্মক্ষেত্র এবং রাষ্ট্র।

Advertisement

বাড়িতে বসে গর্ভাবস্থা পরীক্ষার এই সুবিধা ভারতে এসেছে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে, কিন্তু এর জন্ম আমেরিকায়। ১৯৬৭ সালে মার্গারেট ক্রেন প্রথম যখন এই ঘরে বসে গর্ভাবস্থা পরীক্ষার পদ্ধতিটি আবিষ্কার করার কথা চিন্তা করেন, তখন তাঁর ভাবনার মূলে ছিল গোপনীয়তা। গর্ভাবস্থা পরীক্ষার পদ্ধতিটির মধ্যে থেকে ডাক্তারকে কী ভাবে বাদ রাখা যায়, এবং তারই সঙ্গে তা হলে পরিবার, সঙ্গী, কর্মক্ষেত্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, এই সবের থেকেও বিষয়টি গোপন রাখা যায়। ক্রেন একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, আমেরিকায় তখনও গর্ভপাত অবৈধ ছিল। ২৬টি রাজ্যে অবিবাহিত মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সুযোগসুবিধা পেতে বেশ বাধা ছিল। অবিবাহিত মহিলারা এই ধরনের সুযোগ পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে যেতেন হাতে একটি আংটি পরে, এবং নামের আগে মিসেস লাগিয়ে। বেশ কিছু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ১৯৭০ সালে কানাডার একটি সংস্থার হাত ধরে ‘সমস্ত নারীর একান্তে জানার অধিকার আছে সে গর্ভবতী কি না’ এই স্লোগানকে সঙ্গী করে বাজারে আসে মার্গারেট ক্রেনের সেই আবিষ্কার। নাম হয় ‘দ্য প্রেডিক্টর’। কিন্তু, সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে আমেরিকার বাজারে তা আসতে ১৯৭৭ সাল হয়ে যায়। এর মধ্যেই এসে গেছে ১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলার রায়, যার হাত ধরে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট তখন গর্ভপাত মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে মান্যতা দিয়েছিল।

জেন রো ১৯৭১ সালে এই মামলাটি করেন। তাতে তাঁর বক্তব্য ছিল, গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা সংবিধান-বহির্ভূত— এর পরিপ্রেক্ষিতে টেক্সাস সরকারকে এই আইনটি প্রয়োগের বিরুদ্ধে যেন পদক্ষেপ করতে বলে আদালত। আদালত রো-এর বক্তব্য মেনে নিলেও টেক্সাস সরকারকে সেই ভাবে কোনও নির্দেশ দেয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন রো। এর ফলে গর্ভপাতের এই মামলাটিকে রোয়ের আইনজীবী লিন্ডা এবং সারা সুপ্রিম কোর্টে রাইট টু প্রাইভেসির মামলা হিসাবে তুলে ধরেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই রায় আসে। আর তার পঞ্চাশ বছরের মাথায় গত ২৩ জুন, ২০২২ আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট থমাস এফ ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেনস হেলথ অর্গানাইজ়েশন মামলার রায়ে গর্ভপাতকে সংবিধান-বিরোধীআখ্যা দেয়।

গর্ভপাতের অধিকারকে সংবিধান-বিরোধী আখ্যা দিয়ে যে শুধু গোপনীয়তার অধিকারই খর্ব করা হল তা-ই নয়, গর্ভের উপর যে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের পতাকাটি গাঁথা আছে, তা-ও যেন প্রকারান্তরে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা বিধেয় যে, ১৯৭৯ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে লাগাম টানতে চিন ‘এক সন্তান নীতি’ চালু করেছিল। তার পর থেকেই এই নীতি লঙ্ঘন করা পরিবারগুলোকে জরিমানা, চাকরি খোয়ানো এবং কখনও কখনও জোরপূর্বক গর্ভপাতের শিকারও হতে হয়েছিল। এর পরে, ‘দুই সন্তান নীতি’ পেরিয়ে শিশু জন্মহার বাড়াতে এখন চিনে ‘তিন সন্তান নীতি’ আনুষ্ঠানিক ভাবে আইনে পরিণত করা হয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র তার প্রয়োজন অনুযায়ী গর্ভকে ব্যবহার করবে কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় নাগরিক পেতে।

আজকের শিশু দুই দশক পরে সমর্থ নাগরিক। নাগরিক কোন কাজে লাগে? অফিসে, আদালতে, মাঠে ও কারখানায় শ্রম দিতে কাজে লাগে। নগরের শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশে, সীমান্ত রক্ষায় এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে সেনায় কাজে লাগে নাগরিক। সেনার কাজে গোপনীয়তা জরুরি। আমলাতান্ত্রিক গোপনীয়তা, আদালত কক্ষের গোপনীয়তা সব কিছু অক্ষুণ্ণ থাকে। শুধু গর্ভ, যা নারীর একান্ত ব্যক্তিগত, তার গোপনীয়তা ক্ষয়ে যায়। কেননা এখনও তার উপর উড়ছে রাষ্ট্রীয় পিতৃতন্ত্রের পতাকা। বিশ্বব্যাপী হ্রাস পেতে চলা গোপনীয়তার মাটিতে এও এক বিপুল ভাঙন।

আরও পড়ুন
Advertisement