নুসরত আগে থেকেই যাকে বলে, বিতর্কিত। ছবি: ফেসবুক
নুসরত জাহানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপটুকুও নেই। সখ্য বা নিয়ত যোগাযোগ তো দূরস্থান! তাঁর মোবাইল নম্বরটাও জানি না (জানলেও বিশেষ লাভ ছিল না। তিনি কেন এলোমেলো লোকের ফোন রিসিভ করতে যাবেন)।
নুসরতের সঙ্গে দেখা হয়েছে (বলা যাক, তাঁকে চর্মচক্ষে দেখেছি) কুল্যে মাত্র দু’বার। প্রথম— এক তৃণমূল নেতার পুত্রের বিবাহে। বাইপাসের উপকণ্ঠে সেই জাঁকের বিবাহবাসরে নুসরত যখন একটি মহার্ঘ লেহঙ্গা-চোলি পরে আবির্ভূত হলেন, চারদিক আরও ঝলমল করে উঠল। ঘটনাচক্রে, নেতা যখন তাঁর দলের সাংসদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচকিত হয়ে তিন লম্ফে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আগুয়ান, তখনও তাঁর ডানহাতের মুঠিতে ধরা পরিচিত এবং সদ্য এসে-পড়া সাংবাদিকের হাত। সেই হাতেরই হ্যাঁচকা টানে সাংসদ-সাংবাদিক মুখোমুখি এবং ভদ্রতাসূচক আলাপ। নাম-পরিচয় জানাজানি।
নুসরত (হাত জোড় করে): নমস্কার। আপনার নাম শুনেছি। খুব ভাল লাগল আলাপ হয়ে।
সাংবাদিক (নাম শুনেছেন শুনে সম্ভবত খানিক ভেবলে গিয়ে): নমস্কার। বাপরে, আপনি তো খুব লম্বা!
নুসরত হাসলেন। খিলখিল হাসি। কথাবার্তা আর এগয়নি। এগনোর কথাও ছিল না। বিয়েবাড়িতে নক্ষত্রদের সঙ্গে এমন কত উটকো লোকের আলাপ হয়! তার আয়ু কয়েক সেকেন্ডের বেশি হয় না। সে দিনও হয়নি। অনতিবিলম্বে নুসরতকে ঘিরে ফেলল চারদিকে ভিড়-করা তারকার সঙ্গে সেল্ফি-বুভুক্ষুর তরঙ্গ। সেই ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে তিনি ভাসতে ভাসতে বিশাল আলো-ঢাকা প্রাঙ্গণের কোথাও একটা চলে গেলেন। বেঁটে সাংবাদিক গোড়ালির উপর হাফ টার্নে ঘুরে একলা চলে গেল বুফে টেবিলের দিকে।
দ্বিতীয় দেখা তার বেশ কয়েক বছর পরে। গত মার্চে। আনন্দবাজার অনলাইনের ‘বসন্ত উৎসব’-এর শ্যুটে। সে অবশ্য একেবারেই কেঠো, ফর্ম্যাল এবং হেঁ-হেঁ মুখের একটা প্রায়-আরোপিত কথোপকথন। সেই মঞ্চে আরও অনেকে উপস্থিত। পেশাগত কমিটমেন্টের দায় মেনে তারকারা সব একে একে আসছেন। সময় মেপে হাল্কা গল্পগাছা করে চলে যাচ্ছেন। নুসরতও তেমনই এসেছিলেন। নিউটাউনের সেই শ্যুটিং স্পটে বিনা মেক-আপে সাধারণ চুড়িদার-কামিজে সশস্ত্র রক্ষী পরিবৃত হয়ে তাঁকে হেঁটে আসতে দেখতে দেখতে আবার সেই কথাটা মনে হল— নুসরত জাহান খুব লম্বা।
কিন্তু পাশাপাশিই মনে হল, নুসরত জাহান বেশ ঋজুও বটে। মনে হল, তাঁর চলাফেরায় একটা দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া তাঁর কাঁধে ফেলা দোপাট্টাটার মতোই আলগোছে লেগে আছে। যেটাকে রোয়াব বললেও খুব ভুল হবে না।
নুসরত এলেন। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দোল, শান্তিনিকেতন, ছোটবেলা ইত্যাদি সাড়ে বত্রিশ ভাজা নিয়ে প্রত্যাশিত খুশি-খুশি কিছু অ্যানেকডোট বললেন। তার পর আবার চরাচরে একটা হিল্লোল তুলে চলে গেলেন অকুস্থলের অন্যত্র। সেখানে তাঁর একটা শ্যুট পূর্বনির্ধারিত ছিল। সেই ইউনিট বারবার এত্তেলা পাঠাচ্ছে। তখনও জানতাম না, পরবর্তী কয়েক মাসে নুসরতকে নিয়ে দেশ-রাজ্য এবং পাড়ায়-পাড়ায় কী পরিমাণ ঢেউ উঠবে। যে ঢেউ প্রায় প্রলয়ের আকার নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আছড়ে পড়ল নুসরত তাঁর সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর। তখনও ভাবিনি, নুসরতের মা হওয়ার খবর আনন্দবাজার অনলাইনে বেরোনর পর আনন্দবাজারের ফেসবুক পেজে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি ধেয়ে আসবে— বাবা কে? কে বাবা?
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সমাজের কাছ থেকে, সহ-নাগরিকদের কাছ থেকে এই প্রশ্নটাই কি নুসরত জাহানের প্রাপ্য ছিল? শুধুমাত্র এই প্রশ্নটাই? সংবাদমাধ্যম গত কয়েক মাসে নুসরতের জীবন, যৌবন, ধন এবং মান সংক্রান্ত ব্যাপারে হুদো হুদো খবর দিয়েছে। তাঁর একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টও ছাড়েনি। নুসরতের বিবাহিত জীবন, সে জীবন ভেঙে যাওয়া থেকে তাঁর যৌথযাপন, বন্ধুত্ব, প্রেম। সন্তান সম্ভাবনা থেকে সন্তানের জন্ম পর্যন্ত নুসরতকে খবরে রাখতে চেষ্টা করেছে। যে জন্য ফেসবুক-সহ বিভিন্ন নেটমাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইট-সহ বিবিধ সংবাদমাধ্যমের মুণ্ডপাত করা হয়েছে এবং হচ্ছে অবিরত। যার মোদ্দা কথা— সাংবাদিকতা ম্লেচ্ছতায় ভরে গিয়েছে। ছ্যা-ছ্যা! বাচ্চা-হওয়া নিয়ে এত বাড়াবাড়ি! যা শুনে মনে মনে বলতে ইচ্ছা করেছে— সংবাদমাধ্যম নুসরতের খবর দিয়েছে। কিন্তু নুসরতের সন্তানের বাবা কে, সেটা সমস্বরে চিৎকার করে জানতে চেয়েছে আমজনতা। এখনও চাইছে। চেয়েই চলেছে!
এই প্রশ্নটা কি নুসরত জাহানের প্রাপ্য ছিল? বিশেষত সেই সমাজের কাছে, যে সমাজ আদালতের সেই রায়ে উদ্বেল হয়। যে রায় বলে, সন্তান এখন থেকে শুধুমাত্র মায়ের পদবিও ব্যবহার করতে পারবে। আদালতের সেই রায় জেনে যে সমাজ গ্যাদগ্যাদ করে চার হাতে-পায়ে ফেসবুক পোস্ট করতে বসে, সেই সমাজই তার সমস্ত কৌতূহলের ঢাকনা খুলে ধরে লকলকে জিভে ঠোঁট চাটতে চাটতে প্রশ্ন করে— নুসরতের বাচ্চার বাবাটা কে র্যা?
এটা ঠিকই যে, নুসরত আগে থেকেই যাকে বলে, বিতর্কিত। তাঁর বহু কাজকর্ম নিয়ে আকছার সমালোচনা হয়েছে। সে সাংসদ হয়েও হটপ্যান্ট পরে ডোন্ট কেয়ার টিকটক ভিডিয়ো করাই হোক বা ভোটের প্রচারে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে গাড়ি থেকে এক ঝটকায় নেমে সটান আস্তানায় ফিরে-আসা। এটা ঠিকই যে, একটি বিষয়ে সাহস দেখিয়েছেন বলেই নুসরত সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যান না। যেতে পারেন না। একলা মা নুসরতের কথা মনে পড়লে এই শহরের আরও এক একলা মায়ের কথা মনে পড়ে। যিনি ধর্ষিতা হয়েছিলেন এবং অকালে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সেই মায়ের কথা মনে পড়লে নুসরত জাহান সম্পর্কে ভ্রূ কুঁচকে যায়। চোয়াল কঠিন হয়।
কিন্তু তার পাশাপাশিই মনে হয়, যে সমাজে বিবাহের ধান-দুব্বো ছাড়া মাতৃত্ব শুদ্ধ হয় না, সেই সমাজে দাঁড়িয়েই বিবাহ এবং মাতৃত্বকে একই বন্ধনী থেকে ছিন্ন করেছেন নুসরত জাহান। সামাজিক কলঙ্কের তোয়াক্কা না করে নিজের শরীরের উপর তাঁর নিজস্ব অধিকার কায়েম করেছেন। নেটমাধ্যমে কখনও ছিছিক্কার পড়েছে। কখনও টপটপ করে ঝরে পড়েছে কৌতূহলের লালারস। কিন্তু তিনি অনড় থেকেছেন। অটল থেকেছেন। নিজের শর্তে, নিজের এলেমে, নিজের মতো করে বেঁচেছেন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শুধুমাত্র নিরাপত্তারক্ষী পরিবৃত হয়ে একা একা তাঁকে চিকিৎসকের চেম্বারের বাইরে গাড়ি থেকে নামতে দেখে, আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে অপছন্দ-করা প্রবীণ সহ-নাগরিক বলছিলেন, ‘‘এমন একটা সময়ে মেয়েটা একা-একা ডাক্তার দেখাতে এসেছে দেখে একটু খারাপই লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এই সময়টায় ইমোশনাল সাপোর্টের জন্য কাউকে একটা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারত। তার পর মনে হল, মেয়েটার কিন্তু দম আছে!’’
দম। রোয়াব। ধক। নুসরত জাহানের ধক আছে। সেই ধকেই তিনি নিজের শরীরের উপর তাঁর নিজস্ব অধিকার জাহির করেছেন।
অনেকে বলছেন নীনা গুপ্তর কথা। যিনি সামাজিক কলঙ্ক তুচ্ছ করে ভালবাসার সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তাকে লালন করেছিলেন। সেই সময়ে সম্ভবত আরও রক্ষণশীল, আরও ধারালো, আরও করাল এবং আরও কুটিল ছিল এই সমাজ। সেই সমাজে আরও আরও কঠিন ছিল নীনার লড়াই। নীনার সেই যুদ্ধ এবং সিদ্ধান্তকে নিখাদ এবং সমর্পণী শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি, নুসরতের ক্ষেত্রে শাসন এবং শাসানির সম্ভাবনা আরও বেশি ছিল। নুসরতের সিদ্ধান্তের দায় অনেক বেশি। অনেক বেশি তার ভার। কারণ, নুসরতের একটা রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। তিনি সাংসদ। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের লোকসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
অনেকে বলছেন বটে, নুসরত সমাজের যে স্তরে বসবাস করেন, সেই স্তর থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ততটা কঠিন নয়। সত্যিই কঠিন নয়? কঠিন। বিশ্বাস করুন, খুব কঠিন! নুসরত সমাজের যে স্তরে বিচরণ করেন, সেই স্তর তাঁকে সবসময় এক জোরাল আতশকাচের তলায় রাখে। সেই স্তরই তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এক আনুবীক্ষণিক জীবন। একে সংখ্যালঘু। তায় টলিউডের নায়িকা। এবং এহ বাহ্য, সাংসদ। ভাবমূর্তি টানটান রাখার জন্য যেখানে মহিলা রাজনীতিক সম্ভাব্য বিবাহবিচ্ছেদ থেকে ফিরে আসেন, সেই সমাজে আগামী লোকসভা ভোটে নুসরতকে তাঁর দল যে টিকিট দেবে না, তা এখন থেকেই তাঁর অনেক দলীয় সতীর্থ বলতে শুরু করে দিয়েছেন। বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র পরিচর্যা করার জন্য নতুন নেতা পাঠানোও শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, নুসরত জাহান সমাজের যে স্তরে বসবাস করেন, সেই স্তর তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ জরিপ করে সতর্ক এবং সরুচোখের দৃষ্টিতে। তাঁর একটি স্খলন পর্বতপ্রমাণ করে দেখায় সেই শক্তিশালী আতশকাচ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তূণীরের তির আক্রমণের বিষে ডুবিয়ে ধনুকের ছিলায় টান দেয়। সতীর্থদের অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে থাকেন, এ তো উটকো ঝামেলা হল দেখছি! জনতা জিজ্ঞাসা করলে বলবটা কী!
সেই সমস্ত নিরাপত্তাহীনতার মুখে দাঁড়িয়েও নুসরত জাহান তাঁর সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে তির্যক মন্তব্যের মুখে নুড়ো জ্বেলে, ঝামা ঘষে এবং যাবতীয় জাতির জ্যাঠামশাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে সন্তান-কোলে বাড়ি ফেরেন। সাদা এসইউভি-র চালকের আসনে বান্ধব। পাশের আসনের আধখোলা দরজাটা থেকে মোবাইল-ধরা যে জোড়হাত আশপাশের ভিড়কে ঔপচারিকতার নমস্কার করছিল, তার আবডালে অ্যাডিডাসের মাস্ক-পরিহিত মুখে কি একচিলতে অবজ্ঞার হাসি লেগে ছিল? কাজল-পরা দু’চোখে কি ছিল জয়ের ঝিকিমিকি?
ঘটনাচক্রে যদি আবার কোনও বিয়েবাড়িতে দেখা হয়ে যায়, নুসরত জাহানকে বেঁটে সাংবাদিক নির্ঘাত বলবে, ‘‘আপনি তো মশাই নিজের হাইটটা আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন!’’