‘অনুকূল’ পরিস্থিতিতে বিধানসভা ভোট কি এগোতে পারে
TMC

আর ‘রক্ষণাত্মক’ নয়

মাসখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি যে এতখানি উল্টে যাবে, সেটা আঁচ করা কঠিন ছিল। ধারণা করা হয়েছিল, মানিকতলা জিততে পারলেও বাকি তিনটিতে লোকসভা ভোটের বিশাল ব্যবধান অতিক্রম করা তৃণমূলের পক্ষে দুষ্কর হবে।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪ ০৮:৪৩
জয়যোগ: মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল দেখে শাসক দলের সমর্থকদের উচ্ছ্বাস।

জয়যোগ: মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল দেখে শাসক দলের সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

ভোট-পণ্ডিতদের আরও এক বার ‘ভুল’ প্রমাণ করল শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনের ফল তৃণমূলের লোকসভার ‘বিপুল’ সাফল্যকেও কার্যত ছাপিয়ে গেল। লোকসভার নিরিখে সদ্য পিছিয়ে থাকা তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূলের ভোট-বৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুণ। আর এগিয়ে থাকা একটিতে জয়ের ব্যবধান বেড়েছে কুড়ি গুণ।

Advertisement

মাসখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি যে এতখানি উল্টে যাবে, সেটা আঁচ করা কঠিন ছিল। ধারণা করা হয়েছিল, মানিকতলা জিততে পারলেও বাকি তিনটিতে লোকসভা ভোটের বিশাল ব্যবধান অতিক্রম করা তৃণমূলের পক্ষে দুষ্কর হবে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটা মানতেন না। ঘরোয়া আলোচনাতেও তিনি আগাগোড়া বলে এসেছেন, “লোকসভা ভোটের সামগ্রিক ধাক্কা দেশের উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপিকে বেগ দেবেই। ভোট ধরে রাখতে পারবে না।” বাংলা-সহ অন্যান্য রাজ্যের উপনির্বাচনে সেটাই হয়েছে।

হারের পরে জয়ীকে কাঠগড়ায় তোলা এবং ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করা চিরকালীন রাজনৈতিক অভ্যাস। সব দলই এটা করে থাকে। কিন্তু সেটাও এ বার হয়তো খুব সহজ হবে না। কারণ ভোট কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, সেই বিতর্ক থাকলেও এটা ঘটনা যে, চার কেন্দ্রের কোথাও কোনও বড় গোলমাল, বোমা-গুলি, ব্যাপক হারে বুথ দখল, ভোট দিতে না-পারার গুচ্ছ-গুচ্ছ অভিযোগ শোনা যায়নি। কেউ বলতেই পারেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, নির্বাচন কমিশন সবাই ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিল। তাতে প্রশ্ন উঠবে, বিরোধীপক্ষ কোথায় ছিল? তারা কি ‘সক্রিয়’ ভূমিকায় নামতে পেরেছে? সংহত ‘প্রতিরোধ’-এর কোনও চেষ্টা ছিল কি? কেন হয়নি? বিরোধীরা ছন্নছাড়া হয়ে গেলে শাসক তার সুবিধে নেবেই, এটা এখন ভারতীয় ভোটচিত্রে স্পষ্ট নয় কি? কলকাতার মানিকতলায় এ বার বিজেপি প্রার্থী ভোটের দিন এমন একটি জায়গা নিয়ে অভিযোগ জানালেন, যেটা ওই কেন্দ্রের মধ্যে পড়েই না! রানাঘাটে দেখা গেল, ভোটের আগের দিন তৃণমূলের জনা ত্রিশেক ‘ভৈরব’কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

সব মিলিয়ে হেরোর কাঁদুনি এখন খুব একটা মন কাড়বে বলে মনে হয় না। তার চেয়ে সোজা কথায় মেনে নেওয়া ভাল, এই ফল বিজেপির থেকে ভোটারদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত। যা শুধু এই রাজ্যেই নয়, সারা দেশে অন্য বিধানসভা উপনির্বাচনগুলিতেও স্পষ্ট। যেখানে যে দল শক্তিশালী, বিজেপি-বিরোধী ভোট সেখানে তার ঝুলিতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। অতএব শুধু এই রাজ্যে ভোট ‘লুট’ হয়েছে, আর অন্যান্য রাজ্যে দলে দলে ভোটার বিজেপির বিরুদ্ধে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাবে ভোট দিয়েছেন, এটা অতিসরলীকরণ।

এই সূত্রেই মনে রাখা দরকার, এ-রাজ্যে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের এক-একটিতে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত। লোকসভা ভোটে বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ ও রায়গঞ্জ তিনটি বিধানসভায় পিছিয়ে থাকার ব্যবধান পুষিয়ে এ বারের জয়ের হিসাব ধরলে অঙ্কটি পরিষ্কার হয়ে যায়। মানিকতলাতেও লোকসভা ভোটে এগিয়ে থাকার ব্যবধান উপনির্বাচনে প্রায় ৬০ হাজার বেড়ে গিয়েছে। বাগদা এবং রানাঘাট কেন্দ্র দু’টি মতুয়া ভোটের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। সেখানে এক মাসের তফাতে এই রকম জয় মতুয়া ভোটের গতি-প্রকৃতি নিয়েও ভাবনার খোরাক জোগায়।

অনেকে বলেন, লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের বাস্তবতা আলাদা। তাই লোকসভায় যে বিবেচনার উপর ভোটার ভোট দেন, বিধানসভায় অনেক সময় তার হুবহু প্রতিফলন না-ও ঘটতে পারে। কথাটি হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে একই সময় একই প্রবণতা দেখা গেলে বুঝতে হবে, এটা ‘সচেতন’ বার্তা।

শরিকদের কাঁধে চেপে এ বার সরকার গড়তে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকে। তার মাসখানেকের মধ্যেই জনমতের এই প্রবণতায় শাসকের রক্তচাপ যে আরও বাড়বে না, এমনটি ভাবা বোধ হয় ঠিক হবে না। রাজ্যসভাতেও গরিষ্ঠতার নীচে চলে গিয়েছে এনডিএ। হাওয়া আঁচ করে এনডিএ শরিকদের একাংশ ক্রমে দর কষাকষির ‘মওকা’ খোঁজার চেষ্টা শুরু করবে কি না, কে বলতে পারে!

কিছু দিনের মধ্যে বিধানসভার আরও কতকগুলি আসনে উপনির্বাচন হবে। এই রাজ্যে হবে ছ’টি কেন্দ্রে। ভোটের সাম্প্রতিক ধারা মোটামুটি বহাল থাকলে তৃণমূল ফের অধিক আসনে জিততে পারে। বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলের নেত্রী হিসাবে মমতা তখন জাতীয় ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক ‘ওজন’ জাহির করার পরিসর আরও কিছুটা বাড়াতে পারবেন বলে ধরা যায়। যেটা তিনি চান।

আবার খুব সম্ভবত ওই পর্বেই কেরলের ওয়েনাড় থেকে লোকসভায় লড়বেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। বিরোধী নেতা হয়ে রাহুল গান্ধী ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছেন। প্রিয়ঙ্কা যদি জিতে আসেন, তা হলে শুধু কংগ্রেসের অন্দরে নয়, বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের উপরেও তার বড় প্রভাব পড়া অনিবার্য।

এমনই একটি সময়ে দাঁড়িয়ে মমতা রোজ বলছেন, মোদীর এই সরকার বেশি দিন টিকবে না। কী হবে, সে সব পরের কথা। তবে জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেত্রী হিসাবে তাঁর এই দাবি পরিস্থিতির আধারে অর্থবহ। আরও বেশি লক্ষণীয় হল, অখিলেশ যাদব, শরদ পওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে, স্ট্যালিনের মতো প্রভাবশালী আঞ্চলিক নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বাড়িয়ে চলার উদ্যোগ। সব মিলিয়ে যেটা অন্তত মমতার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতির একটি ‘সুচিন্তিত’ নকশা বলা চলে।

রাজ্যের দিকে ফিরলে শাসক মমতার যে ‘মুখ’টি ইদানীং বেশি করে সামনে আসছে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই বহু আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। তাঁকে নিজের প্রশাসন এবং দল উভয়ের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে এতটা আক্রমণাত্মক হতে আগে দেখা যায়নি। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরে নিচুতলা পর্যন্ত পৌঁছে অভিযোগ শোনার জন্য তাঁর ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি ছিল, অনেকের মতে, তৃণমূলের ’২১-এর বিধানসভায় ঘুরে দাঁড়ানোর শিলান্যাস। যেখানে দলীয় ও সরকারি পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দাপটের বিস্তর অভিযোগ প্রায় গণ-অভ্যুত্থানের আকার নেয়। মমতা ‘রাশ’ ধরে ফেলেন। এ বার লোকসভার আগে তাঁর ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প শাসক দলের অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি-কে আড়াল করতে অনেকখানি সহায়ক হয়েছে বলে মনে করা হয়।

তবে এক অর্থে এ সবই ছিল চাপের মুখে শাসকের ‘রক্ষণাত্মক’ পদক্ষেপ। ’২১-এর ভোটের আগে তৃণমূলে ভাঙন ছিল অন্যতম সঙ্কট। তখন দলের ভিতরের এবং জনমনের ক্ষোভ বার করে দেওয়া ছিল তৃণমূলের কাছে কিছুটা বাধ্যবাধকতা। আর ’২৪-এর ভোটের সময় তৃণমূল নেতৃত্ব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন, দুর্নীতি, চুরি-জোচ্চুরি, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি যে ভাবে গভীরে বাসা বেঁধে ফেলছে, তাকে মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে ‘জনস্বার্থ রক্ষা’য় কিছু করে দেখাতেই হবে। সেটাও ছিল ‘রক্ষণাত্মক’ কৌশল।

কিন্তু লোকসভা ভোটে রাজ্যে একক শক্তিতে বিজেপিকে আরও কোণঠাসা এবং কংগ্রেস ও সিপিএমকে আরও প্রান্তিক করে দিয়ে মমতা নিশ্চিত বুঝতে পেরেছেন, প্রশাসন ও দলে ‘ঘুণ’ না সারালে আর পথ নেই। ‘আক্রমণ’ই তাই তাঁর কাছে এখন ‘আত্মরক্ষা’র প্রকৃষ্ট উপায়। নিজের সরকার ও দলের দুর্নীতি, অপকর্ম, জুলুমবাজি, টাকা খাওয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাঁর এই রকম ভূমিকায় ‘রাজধর্ম’ পালনের বার্তা তো আছেই। পাশাপাশি আগামী বিধানসভা ভোটের আগে ‘সুশাসক’ হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি ‘প্রতিষ্ঠা’র উদ্দেশ্যও নজর এড়ানোর নয়।

অনেক হুঁশিয়ারি তিনি দিয়েছেন। অনেক ঘোষণা, অনেক নির্দেশ জারি হয়েছে। সদিচ্ছার রূপায়ণ কতটা কী হয়, সেটা বুঝতে অবশ্যই আরও ক’টা দিন লাগবে। পরিস্থিতি ‘অনুকূল’ বুঝলে তৃণমূল নেতৃত্ব বিধানসভা ভোট একটু এগিয়ে আনার কথাও ভাবতে পারেন।

আরও পড়ুন
Advertisement