Obesity

এক গোপনচারী মহামারি

কমবয়সি শিশুদের মধ্যে ওবিসিটি বা স্থূলত্বের প্রবণতা, মাত্রাতিরিক্ত ওজন এখন বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা। বলা যায়, বিশ্বব্যাপী মহামারি।

Advertisement
অরবিন্দ সামন্ত
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:০২

গোলগাল ছেলেটি মাথা নিচু করে পার্কের কোণে বেঞ্চে একা একা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। পার্কের মাঠে তখন বাচ্চাদের তুমুল হুল্লোড়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? বন্ধুদের সঙ্গে খেলবে না? ছেলেটা মুখ ভার করে তাকাল, বলল, ওরা খারাপ! ওরা আমাকে ‘মোটু’ বলছে! বলছে, নড়তে চড়তে পারিস না, যা, বেঞ্চে গিয়ে বসে থাক!

Advertisement

কমবয়সি শিশুদের মধ্যে ওবিসিটি বা স্থূলত্বের প্রবণতা, মাত্রাতিরিক্ত ওজন এখন বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা। বলা যায়, বিশ্বব্যাপী মহামারি। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন (ডব্লিউএইচও)-এর মতে, বডি মাস ইন্ডেক্স (বিএমআই) ২৫-এর বেশি হলে অতিরিক্ত ওজন বলে চিহ্নিত করা হয়, আর ৩০-এর বেশি হলেই তা স্থূলতার অবস্থা বলে ভাবা হয়। এক সময় মনে করা হত, শৈশবকালীন স্থূলত্ব আসলে উন্নত দেশগুলিরই সমস্যা, যেখানে মানুষের মাথাপিছু আয় বেশি, মায়েরা বাচ্চাদের প্রয়োজনের তুলনায় খাওয়ায় বেশি, ফলে শিশুদের শরীরে উদ্বৃত্ত চর্বি জমে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, উদীয়মান অর্থনীতির উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও শিশুদের স্থূলতা ক্রমবর্ধমান।

এ কথা ঠিক, শৈশবকালীন ওবিসিটির প্রকোপ উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় উন্নত দেশগুলিতে বেড়েছে অনেক বেশি। আমেরিকায় প্রতি পাঁচ জন শিশুর মধ্যে এক জন স্থূলকায়। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে ১৯৭৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সিদের মধ্যে স্থূলতা বেড়েছে আট গুণ। আর ২০১৭-২০ সালের মধ্যে শুধুমাত্র আমেরিকায় শিশুদের মধ্যে স্থূলতা বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ। আমেরিকায় ৬ থেকে ১১ বছরের স্কুল-বয়সি স্থূলদের মধ্যে ছেলের সংখ্যাই বেশি। আর ১২ থেকে ১৯ বছরের মেয়েরা বেশি স্থূলকায়। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। আমেরিকার ৭৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষই স্থূলকায় বলে এখন চিহ্নিত।

তবে মনে করা হয়, বিশ্বে স্থূলকায় শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চিনে। চিনে সাত এবং তদূর্ধ্ব বয়সের স্থূলকায় শিশুর সংখ্যা ৪০ মিলিয়নেরও বেশি— ২০১০ সালে ১৬ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে প্রায় ৩০ শতাংশ। শৈশবকালীন স্থূলত্বের নিরিখে ভারতের স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। প্রায় ১৫ শতাংশ শিশু এ দেশে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতায় ভুগছে। ১৯৮০ সালের পর থেকে ৭০টি দেশে শৈশবকালীন স্থূলতা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

বিশ্ব জুড়ে এই যে শৈশবকালীন স্থূলতার ক্রমবর্ধমান গতি, তার কারণ কী? গবেষকরা বলছেন, স্থূলতা বিকাশে ব্যক্তিগত এবং পরিবেশগত কারণের এক জটিল মিথস্ক্রিয়া কাজ করে। উচ্চ-ক্যালরি ফাস্ট ফুডের সহজলভ্যতায় শৈশবে মাত্রাতিরিক্ত পুষ্টি, চিনিযুক্ত পানীয়ের বর্ধিত ব্যবহার, অত্যধিক ক্যালরি গ্রহণ, ক্যালরি খাওয়ার মধ্যে শক্তির ভারসাম্যহীনতা, সীমিত শারীরিক কার্যকলাপ, টেলিভিশন, ট্যাব, ভিডিয়ো গেম এবং মোবাইল স্ক্রিনের সময় বৃদ্ধি, ঘুম-জাগরণ চক্রের ব্যাঘাত, উচ্চ আর্থসামাজিক অবস্থা, শহুরে বসবাস— এ সব কিছুই স্থূলতার প্রাথমিক কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর। নিউরাল, হরমোন আর অন্ত্র-মস্তিষ্কের অক্ষের মধ্যে এক জটিল মিথস্ক্রিয়া রয়েছে যা আমাদের খিদে আর তৃপ্তিকে প্রভাবিত করে। আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে আর তা মূল হরমোন ঘ্রেলিন এবং লেপটিন দ্বারা প্রভাবিত হয়। অস্বাভাবিক ঘুম-জাগরণ চক্রের সঙ্গে স্ট্রেস-সম্পর্কিত মানসিক ব্যাধি ঘ্রেলিনের মাত্রা বাড়াতে পারে আর তার ফলে খিদে বাড়ে। মোট কথা, শৈশবকালীন স্থূলতা অনেকটাই ‘লাইফস্টাইল সিনড্রোম’।

ভারতে প্রায় দেড় কোটি শিশু মাত্রাতিরিক্ত ওজন আর স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে বলে মনে করা হচ্ছে। শিশুদের অতিরিক্ত ওজনের প্রবণতা ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। দুই থেকে চার বছর বয়সি অতিরিক্ত ওজনের শিশুদের অনুপাত ২০১৭ সালে ছিল ১১.৫ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ২০০৩-২৩ সাল নিয়ে গবেষণায় লক্ষ করা গেছে, মেয়ে-শিশুদের তুলনায় ছেলে-শিশুদের স্থূলতা বৃদ্ধির ঝোঁক বেশি। দেখা গেছে, সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করা শিশুদের তুলনায় বেসরকারি স্কুলে পড়া শিশুদের স্থূলত্বের ঝোঁক বেশি। আবার চাকরিরত মায়েদের শিশুরা, স্থূলত্বের ঝুঁকিতে, গৃহস্থ-মায়েদের শিশুদের তুলনায় বেশি। আবার পরিবারে স্থূলতার ইতিহাস থাকলে শিশুদের স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে।

গবেষণা বলছে, শৈশবকালীন স্থূলতা শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যকেই প্রভাবিত করে। ডায়াবিটিস, কার্ডিয়োভাস্কুলার সমস্যা, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা-সহ অনেক গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। স্থূলতা শৈশবে যে বিপাকীয় সিনড্রোম, দুর্বল শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগ, শ্বাসকষ্ট এবং গ্লুকোজ় অসহিষ্ণুতার পত্তন ঘটায়, তা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও চলতে থাকে। শৈশবের অতিরিক্ত ওজন আর স্থূলতার সঙ্গে অপরিণত বয়সে মৃত্যুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজ়িজ়, ২০১৭-এর হিসাব অনুসারে, স্থূলতার কারণে বিশ্বে বছরে চল্লিশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। স্থূলতা বিশ্বব্যাপী একটি মহামারির চেহারা নিয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়।

পরিস্থিতি যদি না পাল্টায়, তা হলে ভারতে ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুর স্থূলতা, বৈশ্বিক বোঝার প্রায় ১১ শতাংশে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, শৈশবে মেদবাহুল্য ও মাত্রাতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি এ দেশে একুশ শতকের অন্যতম জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ।

আরও পড়ুন
Advertisement