নুসরত জাহান।
সত্যি তো! এক মেয়ে নিজের যা মনে হবে ঠিক তাই করবে? স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বাধীনতা এক নাকি? গুমরে মরছে সমাজ। ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?’ রবীন্দ্রনাথ বিধাতাকে প্রশ্ন করলেও এখন নিজের ইচ্ছে মতো ভাগ্য তৈরির দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছে বহু মেয়ে।
নিজে মেয়ে বলেই কি হঠাৎ ‘মেয়ে’ নিয়ে লিখতে বসলাম? একেবারেই নয়। নারী সম্পর্কে লেখার জন্য তো ‘নারী দিবস’ আছে। যখন মহিলা অটোচালক থেকে কর্পোরেট সেক্টরে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া নারীর খোঁজ পড়ে। পুরুষের চেয়ে বা নিদেনপক্ষে পুরুষের সমতুল্য মেয়েদের নিয়ে ওই একটা দিনে বাড়াবাড়ির শেষ নেই। এখন নারী দিবস না হলেও পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া এক নারীকে নিয়ে উত্তাল সমাজ। পাড়ার বৌদি, স্কুলের বন্ধু থেকে দাদা, মেসো, কাকা— কেউ বাদ নেই। তাকে নিয়ে সকলের মন্তব্য করা চাই। মন্তব্য মানে ইচ্ছেকে ‘ছ্যা ছ্যা’ করা। কারণ, সেই মেয়ে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজের প্রত্যাশা পূরণের জন্য অপেক্ষা করেনি। নিজেই নিজের সার্থকতার পথ খুঁজে নিয়েছে।
এক ব্যবসায়ীকে ভালবেসেছিল সেই মেয়ে। সেই প্রেম থেকেই তার বিতর্কের সঙ্গে গাঁটছড়া। যখন তারা বিয়ে করার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই ঘটে অঘটন। প্রেমিক ধর্ষণ কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর সেই দিনে সে প্রকাশ্যে হাউ হাউ করে কেঁদেছে আর বলেছে, তার প্রেমিক অপরাধী সাব্যস্ত হলে তার যেন কঠোর শাস্তি হয়।
বলছে তো! প্রেমিককে হারিয়ে ফেলার কথাটাও যে ভিতরে ভিতরে মনে হয়নি, তা জোর দিয়ে বলি কী করে? সমাজের চোখে, আইনের বিচারে যারা ‘খুনি-ধর্ষক’, তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এক ২৩ বছরের যুবতী আচমকা তার বান্ধবীকে খুন করে। সেই অপরাধে সেই যুবতী শুধু খুনি হয়েই থেকে যায়। মেয়েটি চমৎকার গান করত। ছাত্র পড়াত। সে বিষয়গুলো সময় বা সমাজ কেউ মনে রাখেনি। অথচ তার মা তাকে ‘খুনি’ ভাবতে পারেন না। খুনের কারণ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা শুনে মনে হয়েছিল, ক্ষণিকের পরিস্থিতি তাকে সারা জীবনের মতো খুনি তৈরি করে দিয়েছিল! মনে হয়েছিল, সংশোধানাগার থেকে ওর হাতটা ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যাই। সকলকে ওর গান শোনাই।
দেখেছিলাম, সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা এক যুবক তার বান্ধবীকে ধর্ষণ করে সংশোধানাগারে বাকি জীবন কাটাচ্ছে। ধর্ষণের মতো অপরাধকে সমর্থন করা যায় না। করছিও না। কিন্তু, মনে হয়েছিল, কেন সে ধর্ষণ করেছিল? সে তো জন্মধর্ষক নয়! কোন পরিস্থিতি তাকে প্রেমিকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এই অপরাধটা করতে বাধ্য করেছিল?
তা হলে পরিস্থিতিই কি মানুষকে অপরাধী করে তোলে? জানি না। কুখ্যাত ধর্ষণ-কাণ্ডে এক অভিযুক্তের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। সাদা পোশাক পরিহিত ওই যুবক সংশোধানাগারের বাকি সব বাসিন্দার দেখাশোনার দায়িত্বে আছে বলে জানিয়েছিলেন সংশোধানাগারের প্রধান। তিনি ওই যুবককে নিয়ে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, সংশোধানাগারের আইন অনুযায়ী তাকে বাড়িতে কিছু দিন সময় কাটানোর অনুমতিও দিয়েছিলেন।
অপরাধ জগতের মানুষকে বৃহত্তর ক্ষেত্রের ক্যানভাসে ফেলে দেখার শিক্ষা ওই সংশোধানাগার থেকেই পাওয়া। যে খুন করে, সে সারা জীবনের জন্য খুনি হয় না। কোনও মহিলা দুটো বিয়ে করলে বা বিয়ে ভেঙে নতুন প্রেমিকের সঙ্গে সহবাস করলে সে অপরাধী হয়ে ওঠে না। এই কথাটা বার বার চিৎকার করে বলার সময় এ বার হয়ে এসেছে। সেটা আমি জানি। আর জানে সেই মেয়ে।
পুলিশের তদন্তের কম্পাস বারবার সেই মেয়ের দিকে ঘুরেছে। জিজ্ঞাসাবাদও হয়েছে। কিন্তু তাকে ছুঁতে পারেনি পুলিশ। ধর্ষণ-কাণ্ডের চার্জশিটে কোথাও উল্লেখ নেই সেই মেয়ের। যদিও ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তার প্রেমিক ফেরার থাকার সময় তার সঙ্গে মেয়েটির নিয়মিত যোগাযোগের প্রমাণ ছিল পুলিশের হাতে। তবু তার শাস্তি হয়নি। নিন্দকেরা বলে, সে রাজনৈতিক সাহায্য পেয়েছিল। সুন্দর মুখ দিয়ে সবাইকে ভুলিয়েছিল। সত্যিই তো! কী খারাপ মেয়ে! ছ্যা-ছ্যা!
এমনও তো কেউ ভাবতে পারত যে, সেই মেয়ে ভালবাসার জোরে সব না-পারাকে জয় করেছে। আসলে নারীর অতি প্রেম, অনেক প্রেম এসব তার কলঙ্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। নারীকে নিজের ভাগ্য জয় করার কথা যে লেখক লিখেছিলেন, তিনি আবার ‘তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’ লিখে গিয়েছেন। তবে দোষ লেখকের নয়। সব দোষ মেয়ের! এত কীসের পীরিত!
মেয়ে কিন্তু সেখানে থামে না। বড্ড মায়া তার চোখে। সে মায়ায় থেকেই থেকেই বন্দি হতে চায় অন্য পুরুষ। হয়ও। অভিনয়ে তার রূপ ঝলসে ওঠে। মেয়ে প্রেম খুঁজতে থাকে। প্রেম আসে। প্রেম যায়। ছিছিক্কার পড়ে। এত প্রেম? পুরুষমানুষ হলে অন্য কথা। পুরুষরা দু’তিনটে প্রেমে পড়বে। নইলে আবার পুরুষ কী? তা বলে মেয়েদের এত প্রেম! বাচ্চা হলে কী জানবে? তার মায়ের চরিত্রের ঠিক ছিল না? ছি-ছি!
এক ব্যবসায়ীর প্রেমে পড়ে মেয়ে। সে প্রেম তাদের ছাদনাতলায় নিয়ে যায়। এ বার দু’জনের মাঝে এসে দাঁড়ায় ধর্ম। মেয়ে মুসলিম। ছেলে হিন্দু। ‘শুদ্ধ শাকাহারি’। তীব্র আক্রমণ ধেয়ে আসে মেয়ের দিকে। অথচ ছেলেকে নিয়ে কারও তেমন কিছু বলার নেই। সকলে বলে, মেয়ে তার রূপ দিয়ে ছেলেকে টেনেছে। তবে মেয়ে ও সব কথা কানে তোলে না। মেয়ে ইচ্ছেডানায় ভর করে রূপকথার বিয়ের স্বপ্ন দেখে। ছেলেটি তা পূরণ করার মধ্যে আনন্দ আর অধিকারবোধের শিকড় গড়ে তুলতে চায়। ভিনদেশে তাদের স্বপ্নের মতো বিয়ে হয়। তার মধ্যেই মেয়ের টিকটক থেকে পোশাক, শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো টুকরো করে নোংরা মিম তৈরি হয়। প্রশ্ন ওঠে— মুসলিম হয়ে কেন রথ টানে সে? কেন সিঁথিতে সিঁদুর পরে! উত্তর দেয় না মেয়ে। শুধু যা ইচ্ছে হয়, তাই করে। বেশ করে!
বিয়ের পর মেয়ে প্রেমে আত্মহারা। হাতের মেহেন্দি আর বিয়ের রঙে নিজেকে উৎসর্গ করে স্বামীর কাছে। তাতেও সমাজের রাগ! ‘নষ্ট মেয়ে’ স্বামী নিয়ে সংসার করছে। পিতৃতন্ত্র পুরুষকে ছাড় দেয়। পিতৃতন্ত্র বলে, ছেলেটা আসলে বোকা। রূপ দেখে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে। যেন ছেলেটা এমন মেয়ের প্রেমে পড়তেই পারে না। সে তখন আর ছেলে নয়। সে বোকা। ভালবাসা, যৌনতা সব ছাপিয়ে শুধু লিঙ্গবৈষম্যের আস্ফালন ধরা পড়ে। ঢাকা পড়ে প্রেম।
মেয়ের ভাল লাগে না লোকদেখানো বিয়ে। সংসার। মেয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। এক ছাদের তলায় অপরিচিত মানুষ হয়ে থাকার ইচ্ছে তার নেই। লোকে বলে, এই মেয়ে ভারী ‘দাপুটে’। ভারী ‘চালাক’। তাই নাকি সে নিজের বাড়িতে ফিরেছে। কারণ, ‘যা খুশি’ করার জন্য নিজের বাড়ি লাগে। বাবা বা বরের বাড়িতে থেকে ইচ্ছেমতো জীবন চালানো যায় না। শুধু বর নয়, বাবাকেও রাতে দেরি করে ফেরার কারণ জানাতে হয়। কিন্তু মেয়ে তো বড্ড নিজের মতো করে বাঁচতে চায়!
একা বাঁচতে শুরু করে মেয়ে। আর সে ‘বরের নারী’ নয়। প্রেমে তখনও অতৃপ্তি। তখন জীবনে আসে সহকর্মী। এ বার রব আরও দারুণ! এ তো পরকীয়া! ছ্যা-ছ্যা। সমাজ না-চাওয়া বিয়ে রাখতে উৎসাহ দেয়। চাওয়ার ভালবাসার জমি তৈরি করতে মদত দেয় না। কিন্তু দখিন হাওয়ার মতো প্রেম তো সমাজ-নিয়ম-প্রতিষ্ঠানের ধার ধারে না। তার বৈধতা মাপতে পারে আইন। তাকে ‘পরকীয়া’ বলে ডাকতে পারে সমাজ। তাতে তার দাপট কমে না। হ্যাপাও কমে না। দু’জনে ইচ্ছেমতো বেড়াতে গেলে আনন্দ করে ভাগ করে নেওয়া যায় না। নেবে কী করে! মেয়ে তো আইনসভার সদস্য। কোথায় মানুষের পাশে থাকবে। পিঠঢাকা ব্লাউজ আর শাড়ি পরবে। তা নয়, ইচ্ছেমতো খোলামেলা পোশাক পরে নাচছে। ছ্যা-ছ্যা। কিন্তু কেউ কিছু বলতেও পারে না মেয়েকে।
শুরু হয় নজরদারি। মেয়ে ভয় পায় না। বিতর্ক আর সমালোচনা নিয়েই নিজেকে মুক্তি দেয় সে। দোষারোপের পর দোষারোপ। প্রেম এলেও শান্তি আসে না। সমাজ তক্কেতক্কে থাকে তার আচরণ নিয়ে ব্যঙ্গ করতে। হাতেনাতে ধরে ফেলে তার প্রেম। বলে— প্রেম তো হল। বিয়ে কই? এই বিয়ের আগে প্রথম বিয়ের বিচ্ছেদের কাগজ কই? মেয়ের সপাট জবাব, আগে তো আইনি বিয়েই হয়নি তার! স্রেফ লিভ-ইন করেছে! বোমা পড়ে হাটের মাঝে। ছ্যা-ছ্যা। কী ছলনাময়ী! স্বামীর সব টাকাপয়সা নিয়ে সহবাস বলে কেটে পড়ল! মেয়ের জেদ বাড়তে থাকে। সম্পর্ক নিয়ে একটা কথাও বলে না সে। ক্রমে বুঝতে পারে শরীরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। প্রতিবাদের ভাষা বদলে নেয় মেয়ে। ‘জীবন আমার, ইচ্ছে আমার’ ঘোষণার মতো বেজে উঠে বলে, “আমার লড়াই আমাকেই লড়তে হবে। কেউ কারও হয়ে গলা তুলবে না। এখন যদি লোককে দেখানোর জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যে জীবন যাপন করি, স্বামী অত্যাচার করলেও সমাজের ভয়ে চুপ থাকি, লোকের সামনে স্বামীর ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য আওয়াজ না তুলি, তবে নিজের জীবনটা কোথাও যেন হারিয়ে যাবে। নিজেদের ক্ষতগুলোকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে মহিলারা নিজস্বতা হারিয়ে ফেলবে।’’
সমাজের তৈরি বিয়ে, প্রেম, সন্তানজন্মের সব ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় খেয়ালি মেয়ে। সে বরেরও নয়। সে পরেরও নয়। সে নিজের। সেই মেয়ে নতুন প্রেমিকের সঙ্গে থাকে। সমাজকে বার্তা পাঠায, প্রেম করলেই বিয়ে করতে হয় না। সেই মেয়ে জানে, তার প্রেমিকের সন্তান আছে। স্ত্রী আছে। প্রেমিকাও আছে। কিন্তু এ-ও জানে, সেই সম্পর্কে এখন আর প্রেম নেই। শুধু আদবগুলো আছে। তাই তার নতুন প্রেমের মলাট থেকে বই— সব বদলে যায়। তার আচরণ, জীবনধারা একের পর এক নীরব প্রতিবাদে ভাঙতে থাকে বহু আদিম শাসনের বেড়া।
যে কথা লুকিয়ে বলা হয়, সে কথা কত সহজে বলে দিয়ে গেল এক খেয়ালি মেয়ে!