Manual Scavenger

হারিয়ে যাওয়া মানুষের দল

হারিয়ে যাওয়া মানুষরা মৃতদেহ হয়ে উঠে এলে তবেই কেবল পরিসংখ্যানে জায়গা পেতে পারেন।

Advertisement
আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২২ ০৫:৫২

কয়েক মাস আগে এক বার এক বন্ধুর সঙ্গে একটি পুরসভায় যেতে হল। উদ্দেশ্য, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দিষ্ট একটি প্রকল্পে পুরসভার পারফর্ম্যান্সের তথ্যাদি তুলে এনে গবেষণার কাজে যুক্ত করা। জল, বিদ্যুৎ, আবাসন এই সমস্ত বিষয় পার করে আমরা গেলাম সাফাইকর্মীদের বিষয়ে খোঁজখবর করতে। নিকাশি-নালার সাফাইকর্মী, অর্থাৎ যাঁদের বলা হয় ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজার’। দেখা গেল, ওই ফাইলটা এখন যে ঠিক কে দেখেন, তিনি কোথায় বসেন, সেই সব নিয়েই একটা বিপুল ধোঁয়াশা গোটা পুরসভায়। দু’দিন ঘোরাঘুরির পরে তাঁর সন্ধান মিলল।

ছোটবেলায় আমাদের প্রায় সবাইকেই শেখানো হয়েছিল একটি বাক্যে উত্তর লেখার কৌশল। এই সমস্ত গবেষণার কাজের জন্য যাঁরা সরকারি দফতরে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে গিয়েছেন, তাঁরা জানেন টেবিলের ওই প্রান্তে বসে থাকা মানুষেরা একটি বাক্যে উত্তর দেন। সম্ভব হলে একটি শব্দে। একের বেশি দু’টি কথা তাঁদের মুখ থেকে বার করা মুশকিল। প্রথমেই তিনি একটি বাক্যে বললেন— ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজার এখন আর নেই। বেশ। তবে তাঁদের পুনর্বাসনের কী অবস্থা? ফাইল থেকে তিনি তথ্য দিলেন। কিন্তু, যে তথ্য তিনি দিলেন তাতে দেখা গেল নিকাশি-নালার সাফাইকর্মীর সংখ্যার সঙ্গে পুনর্বাসন গ্রহণ করা কর্মীর সংখ্যা মিলছে না। তিন জন কম হচ্ছে। কম হচ্ছে কেন? তবে কি পুনর্বাসন গ্রহণ না করে সাবঅল্টার্ন তার প্রতিরোধ দেখাচ্ছে? বিকল্প কোনও ভাষ্য উঠে আসবে মনে করে আবারও জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা এই যে তিন জন, ওঁরা কি পুনর্বাসন নিতে অস্বীকার করেছেন? বেশ দীর্ঘ একটি নীরবতার পরে তিনি ছোট্ট একটি উত্তর দিলেন— “তিন জন আসলে হারিয়ে গিয়েছে।”

Advertisement

কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “কীভাবে হারিয়ে গেলাম তার খোঁজ কোরো না কোনদিন। কতো মানুষই তো হারিয়ে যায়।” আশ্চর্যের ব্যাপার হল, হারিয়ে মানুষ যান কোথায়? হারিয়ে যাওয়া মানুষ থাকেন থানায় মিসিং ডায়েরির পাতায়। থাকেন কাছের কোনও গাছের গুঁড়িতে, ল্যাম্পপোস্টে, বাসস্টপ বা রেলস্টেশনে পোস্টার হয়ে। সমাজমাধ্যমে ছবি হয়েও ঘোরাফেরা করেন কেউ। কেউ জায়গা পান খবরের কাগজের ‘সন্ধান চাই’ কলামে, কেউ ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা’ হয়ে রেডিয়ো বা টেলিভিশন পর্যন্ত যান। কখনও দূরবর্তী কোনও রাস্তার ধার থেকে, চায়ের দোকানের বেঞ্চি থেকে, অথবা রেলের প্ল্যাটফর্ম থেকে তাঁদের কাউকে পাওয়া যায়। কখনও হয়তো পাওয়াই যায় না। পাওয়া না গেলে চলে পাচারচক্রের জল্পনা।

এ তো গেল যাঁরা মাটির উপরে হারিয়ে যান। আর যাঁরা মাটির নীচে হারিয়ে যান, তাঁরা? তিন জন নিকাশি-নালার সাফাই কর্মচারী কোথায় হারিয়ে যেতে পারেন, তা বুঝে নিতে খুব অসুবিধা হয় না। নিকাশি-নালার এই সাফাই কর্মচারীরা হারিয়ে যান বিষাক্ত গ্যাসের সংক্রমণে, মাটির ভিতরে। মৃতদেহ পাওয়া গেলে যাঁদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সহজেই লিখে দেওয়া যেত অ্যাসফিক্সিয়া বা পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু। এই রকমের হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা কোথাও পোস্টার হয়ে ঝোলেন না, ‘সন্ধান চাই’ কলামে তাঁদের কথা বেরোয় না, ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা’ পর্যন্ত তাঁরা কোনও ভাবেই পৌঁছতে পারেন না। খবরের কাগজে আঠারো পয়েন্টের শিরোনামে ছোট্ট খবর হয়— ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে নিখোঁজ চার। খবরের চ্যানেলের নীচে সে খবর স্ক্রোল হয়ে চলে যায়।

এই তিন বা চার সংখ্যাগুলো খুব ছোট। কিন্তু ব্যাপারটা অত ছোট নয়। ১৯৯৩ সালে আইন করে মানুষ নামিয়ে ম্যানহোল পরিষ্কার নিষিদ্ধ হয়। ২০১৩ সালে আসে সাফাইকর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা এবং তাঁদের পুনর্বাসন আইন। ১৯৯৩ সালের ওই আইনে বলা হয়, কোনও ব্যক্তি বা কোনও স্বশাসিত সংস্থা কাউকে দিয়ে অপরিষ্কার শৌচাগার, খোলা নর্দমা, গর্ত বা ম্যানহোল, রেললাইন বা অন্য কোথাও থেকে মানববর্জ্য পরিষ্কার করাতে পারবে না। ২০১৩-র আইনে এই সমস্ত প্রক্রিয়া যন্ত্রচালিত করা এবং পূর্বে ওই কাজে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের পুনর্বাসন দেওয়ার কথা বলা হয়। গত বছরের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানায় যে, গত পাঁচ বছরে নিকাশি-নালা, সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে দেশে ৩২১ জন সাফাইকর্মী মারা গিয়েছেন। যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা প্রায় পাঁচশোর কাছাকাছি।

চিত্রটা আরও একটু বড় করলে কেমন দেখায়? মানবাধিকার কর্মী বেজ়ওয়াদা উইলসনের হাত ধরে ১৯৯৩ সালে সাফাই কর্মচারী আন্দোলন শুরু হয়। ওই বছরেই সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর সাফাই কর্মচারিজ়’। এই কমিশন ১৯৯৩ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সাফাই কর্মচারীদের মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা নজর দিলে বোঝা যাবে এর গুরুত্ব। প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৯ বছরে গোটা দেশে ম্যানহোলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে মোট ৯৮৯ জনের। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে তামিলনাড়ু। সেখানে ২১৮ জন মারা গিয়েছেন। এর পর যথাক্রমে গুজরাত ১৫৩, উত্তরপ্রদেশ ১০৭, দিল্লি ৯৭, কর্নাটক৮৬। পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে দশম স্থানে। প্রাণহানির সংখ্যা ২৩।

ম্যানহোলে পড়ে মৃত্যু। এর মধ্যে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজার হয়ে যাওয়া মানুষ, পথচলতি কিছু নিরীহ নাগরিকও থাকতে পারেন। এই খতিয়ান মৃত্যুর। কিন্তু, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খতিয়ান কোথায়?

বুঝে নিলাম, হারিয়ে যাওয়া মানুষরা মৃতদেহ হয়ে উঠে এলে তবেই কেবল পরিসংখ্যানে জায়গা পেতে পারেন। অন্যথায়, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কোনও পরিসংখ্যানেও জায়গা থাকে না!

আরও পড়ুন
Advertisement