Narendra Modi

মোদীর ভারত সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, কিন্তু সমালোচকরা নিজেদের জায়গায় ঠিক আছেন তো?

আন্তর্জাতিক ময়দানে ভারতের সমালোচনা হলেই সরকারি স্তরে বিভিন্ন সাফাই উঠে থাকে। কিন্তু সমালোচনাকারীরাও কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে?

Advertisement
টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৩ ১০:২৭
Narendra Modi’s India is intolerant regarding criticism, but what about the critics themselves

প্রগতি থেকে দুর্নীতি, ভারতের আসল চেহারা কেমন? ছবি: সংগৃহীত।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, দুর্নীতি, সংখ্যালঘুর প্রতি আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে কী ধরনের আলোচনা হয়, তা নিয়ে এ দেশের সরকারের মনোভাব খানিকটা তিক্তই। যা থেকে মনে হতেই পারে যে, ভারত এক রকমের বোকাটে গোঁয়ার্তুমি বজায় রেখেই এ সব বিষয়ে নেতিবাচক সমালোচনা সহ্য করতে পারে না।

যে কোনও মুক্তমনা মানুষই স্বীকার করবেন যে, নরেন্দ্র মোদী জমানায় গণমাধ্যম্যের স্বাধীনতা রীতিমতো বিপাকে পড়েছে। অনিবার্য ভাবে দেখা গিয়েছে, এই আমলে গণপরিসরে ঘৃণাভাষণের প্রবণতা (বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি কটূক্তি) বেড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি, সমাজমাধ্যমে যে কোনও বিষয় নিয়ে হেনস্থা করতে উদ্যোগী ট্রোল বাহিনীর উত্থান ঘটেছে। পথেঘাটে গণপ্রহারে মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতীয়দের কাছে এ সব আর কোনও ‘খবর’ নয়। ভারতবাসীরা আর তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। কেউ যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায় যে, বাস্তবের প্রকৃত ছবিটি কেমন, ভারতীয়রা তা শুনতে আর আগ্রহী নন।

Advertisement

সরকার তার সমালোচনা নিয়ে কার্যত কিছুই ভাবে না। দেশের ভিতর থেকে উঠে আসা সমালোচনাকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখে সরকার। সেই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে থাকে খানিকটা অবজ্ঞা মেশানো নীরবতা, ক্যামেরার পিছন থেকে আসা চাপ, তথ্যের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, কঠোর আইনের প্রয়োগ এবং তার ফলস্বরূপ মামলা-মোকদ্দমা এবং শেষ পর্যন্ত সমালোচকের শাস্তিবিধান। বিদেশের সমালোচনা সম্পর্কে অবশ্য এই অবজ্ঞা দেখা যায় না। তার বদলে দেখা যায় স্বৈরাচারের সুরে এক রকমের আগ্রাসী আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা। এই কারণে আন্তর্জাতিক (মূলত পাশ্চাত্য) মতামতের প্রতি সংবেদনশীলতার প্রশ্নটি নিরুত্তর থেকে যায়। বা বলা যেতে পারে, বিষয়টি আলোচনাবৃত্তে প্রবেশই করে না।

কোনও বিষয়ে বিশ্বে ভারতের স্থান নিয়ে আলোচনা শুরু হলে সরকার ও তার সমর্থকদের মুখ খোলা নিয়ে কিছু যৌক্তিকতা দেখা যায়। বিদেশ থেকে উড়ে আসা সেই সব সমালোচনার মধ্যে অনেকগুলিই দেখাতে চায়, ভারত আদতে খারাপ। কিন্তু তার চেয়ে অনেক খারাপ ভাবে দেশটা চলছে। আন্তর্জাতিক স্তরে সাংবাদিকরা অনেক সময় বলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানের চেয়েও কম। তখন এ দেশ থেকে দেখানোর চেষ্টা চলে, এর দায় ভারতের নয়। আসল দোষ সেই সংস্থার, যারা এই সংক্রান্ত তালিকাটি তৈরি করে ভারতের স্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। যখন ভারতীয় শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি সংক্রান্ত আলোচনায় দেখানো হয়, তারা বয়সের তুলনায় খর্বকায় বা অপুষ্ট, তখন উল্টে বলা হয়, এশীয় দেশগুলির ক্ষেত্রে কোন মাপকাঠি যথাযথ, তা পশ্চিমের দেশগুলি খুলে বলে না। এশিয়ার মানুষ ইউরোপ বা আফ্রিকার লোকেদের তুলনায় যে স্বাভাবিক ভাবেই ছোটখাটো আকৃতির, সে কথা সে সব উদাহরণে উহ্য থাকে।

যখন গণতান্ত্রিকতার মাপকাঠিতে ভারতের অবস্থান নিয়ে কথা ওঠে, তখনও একই রকম বৈষম্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। এমনকি, যখন ক্রেডিট রেটিং বা ঋণগ্রহণের ক্ষমতা বিষয়ে আলোচনা হয়, তখনও ভারতের অবস্থান খুব সুবিধাজনক জায়গায় থাকে না। আমেরিকার সরকার (ঋণের মাত্রা স্থির করা নিয়ে সে দেশের কংগ্রেসে রীতিমতো চাপানউতর চলছে) এই মুহূর্তে ভারত সরকারের তুলনায় ঋণ শোধের ব্যাপারে খানিক দুর্বল অবস্থাতেই রয়েছে। প্রতিযোগিতার তালিকায় ভারতের স্থান নিয়ে আলোচনা হলে দেখা যাবে, দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দেশগুলি বা যাদের রফতানির বৃদ্ধির হার দ্রুত, তারাও কখনও এই জায়গায় আসেনি।

কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, উপরে বলা বিষয়গুলি এক রকমের ভ্রান্তদর্শন বা পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের ফসল। ভারতের বিরুদ্ধে তোলা প্রশ্নগুলির উত্তর তো এতে পাওয়া যায়ই না বরং এ থেকে এমন মনে হতে পারে যে, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলি ভারতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। অন্য ভাবে বললে, ভারতের উত্থান তারা ভাল চোখে দেখে না। এ বিষয়ে একটু নজর করলে কিন্তু বিপরীত ছবিই দেখা যায়। পশ্চিম গোলার্ধের প্রধান দেশগুলি এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভিভিন্ন দেশ চিনের উত্থানের সাপেক্ষে ভারতের মাথা তুলে দাঁড়ানোর বিষয়টিকে স্বাগতই জানায়।

পশ্চিমী বিশ্বের দেশগুলি এক রকমের সুস্পষ্ট বৈপরীত্যে বিশ্বাস করে। তাদের ধারণায় অর্থনীতি দু’রকমের। এক, ‘উদীয়মান। দুই, উদিত। এই ধারনা প্রশ্নাতীত নয়। তবু এর ভিত্তিতে বহু পশ্চিমী দেশ শ্লাঘা অনুভব করে থাকে। ‘উদীয়মান’ অর্থনীতির দেশগুলিতে কোনও রকমের সমস্যা দেখা দিলে তারা দ্রুত জানায়, এই সমস্যা ব্যবস্থাগত ত্রুটির ফল। কিন্তু ‘উদিত’ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখতে পেলে তারা বলে, সেটা একটা সামান্য বিচ্যুতি। নিয়মমাফিক পথ চলায় কিঞ্চিৎ বিপথগমন। বাণিজ্য ও রাজনীতির গাঁটছড়ার উদাহরণ হিসাবে গৌতম আদানির উদাহরণ উঠে আসে। আইএল অ্যান্ড এফএস (ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিনানশিয়াল সার্ভিসেস)-এর পতনের ব্যাখ্যা হিসাবে উঠে আসে ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা, অডিটরদের ভূমিকা, রেটিং এজেন্সি এবং নিয়ন্ত্রকদের কর্মকাণ্ড। কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট কি আমেরিকার বৃহৎ ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা, নীতি নির্ধারক এবং আইনকর্তাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার ফল নয়?

ভেবে দেখুন, আমেরিকার আঞ্চলিক ব্যাঙ্কগুলি কী ভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। অথবা আত্মঘাতী ব্রেক্সিটের সময়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে কী পরিমাণ মিথ্যার চাষ হয়েছিল। লণ্ডনের আন্তঃ-ব্যাঙ্ক অর্থের বাজারে জালিয়াতির প্রসঙ্গও মনে করা যেতে পারে। সেই ঘটনা ছিল কেলেঙ্কারির এক প্রবাহের অংশ। ক্রেডিট সুইস, ওয়্যারকার্ড, এফটিএক্স, ডয়েশ ব্যাঙ্ক এবং ফক্সভাগেন সংক্রান্ত বিবিধ কেলেঙ্কারি ছিল সেই প্রবাহের অন্তর্গত। এর বাইরে প্রয়াত শিশুকামী জেফ্রি এপস্টাইনের সঙ্গে আমেরিকার সর্বোচ্চ স্তরের ব্যাঙ্কারদের যোগাযোগের ঘটনাকেও মনে রাখতে হবে। যদি প্রশ্ন ওঠে, গৌতম আদানির বিষয়ে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময় ঠিক কোন ব্যাঙ্কগুলি তাদের গা বাঁচাতে তৎপর হয়ে পড়েছিল? আসবে বার্কলেজ, সিটিব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য নামজাদাদের প্রসঙ্গ। তখন প্রশ্ন উঠবে—শুধু ‘উদীয়মান’ অর্থনীতির দেশ ভারতেই কি ব্যবস্থাগত দুর্বলতা রয়েছে?

এর জবাব পেতে গেলে পশ্চিমী ‘উদিত’ বা এগিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশগুলির এক বার আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত। ভারতের তরফেও প্রয়োজন সমালোচনার তিক্ত জবাব দেওয়ার আগে নিজের মুখটি আয়নায় দেখে নেওয়া। কার্যত কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement