ফেনি, ফিশ কারি আর ফুটবলে ডুবে থাকা গোয়ার মন ভাল নেই। সমুদ্র-গভীরের ডলফিনরাও বোধ হয় হেদিয়ে মরছে খেলা দেখানোর সুযোগ না পেয়ে! অন্তত বালুতটে ডলফিন-গাইডের হাপিত্যেশ দেখে এমনটাই তো মনে হল।
পানজিম থেকে পর্তুগিজ স্থাপত্যের ছায়া নিবিড় পথে একটু এগিয়েই সুপ্রশস্ত বেইরা মার সৈকত। প্রবল রোদে বালি এমন ঝলসাচ্ছে, রঙিন কাচ না থাকলে চোখ খুলে রাখা দায়। জুতো খুলে হাঁটলে ফোস্কার সম্ভাবনা। সে সব তোয়াক্কা না করেই ছুটে এলেন মধ্য-চল্লিশের এক ব্যক্তি। দূর থেকে দেখছিলাম, একটু আগেই ছাতার তলায় বসে ঝিমোচ্ছিলেন। প্রায় জনবিরল বিচ-এ আমায় দেখে একটু আশা পেয়ে ডলফিন-ক্রীড়ার প্রাইস চার্ট নামতার মতো বলতে লাগলেন। ডলফিন নয়, মানুষের সঙ্গে কথা বলার কাজে গোয়া এসেছি, এটা জেনে উৎসাহ দ্রুত হারিয়ে ফেললেন। একই রকম নিরাসক্ত অদূরের হোয়াইট স্যান্ড সৈকতের লেবু-সোডা বিক্রেতা কল্পেশ খন্ডেলকর, পানজিমের অটো চালক বীরেন ভান্ডারি, ব্রিটোনিয়া গ্রামের মৎস্যজীবী পল ডি কোস্টা, কিংবা ডোনা পওলার ক্যাব ড্রাইভার মাগদু ডি মেলো।
নিরাসক্ত বলাটাও ঠিক নয়। খোঁচালেই বোঝা যায়, ভিতরে প্রবল ক্ষোভ বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। তারা যে ভাবে ডিজ়েলের দাম বাড়াচ্ছে তাতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় না বেরিয়ে পেটে খিল দিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে নাকি লাভ! তাতে অন্তত ঋণের বোঝা বাড়ে না। আজকের তারিখে গোয়ার রাস্তায় একটি অটো বা গণপর্যটনের বাহন খুঁজে পাওয়া, মধ্যপ্রদেশে গিয়ে প্রথম সাফারিতেই বাঘ দেখতে পাওয়ার মতোই কঠিন! তবুও আপনি কপালজোরে রয়্যাল বেঙ্গল দেখলেও দেখতে পারেন অরণ্যে ঢুকেই। কিন্তু টানা চার দিন পথবিহার করে আমি সাকুল্যে একটিমাত্র অটো দেখতে পেলাম, যে দিল্লির তিনগুণ চড়া দামে আমাকে নির্দিষ্ট জায়গায় নামাতে রাজি হল। অটোচালক যতীশ নায়েকের বক্তব্য, “অতিমারির কারণে পর্যটন এমনিতেও মরে গিয়েছে। বহু দিন সব বন্ধ ছিল। এই সরকার আমাদের কোনও ভর্তুকি দেয়নি ডিজ়েলে। কোনও সাহায্য করেনি। এখন চালু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যাঁরা আসছেন তাঁরা খরচ করছেন না আগের মতো। বিরিয়ানি খাওয়া লোক এখন ম্যাগি খাচ্ছেন! আগে যাঁরা এক লাখ খরচ করতেন এখন তাঁরাই বিশ হাজার বার করতেও দশ বার ভাবছেন। বিদেশি টুরিস্ট নেই। আমরা কী খাব বলুন তো!”
প্রবীণ গাড়িচালক বীরেন ভান্ডারি। পিলারি গ্রামে তাঁর বাড়ি। তাঁর ক্ষোভ, “মনোহর পর্রীকর যত দিন ছিলেন বিজেপির হয়ে কাজ করেছি। কিন্তু গোটা লকডাউন এই সরকার আমাদের দেখেনি। বরং নিজেরা চুরি করে গিয়েছে। আমাদের পুরনো রাজ্যপাল তো সব চুরি ফাঁস করে দিলেন।” এত দিন বীরেশ বিজেপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কিন্তু তিনি আজ ক্ষুব্ধ হয়ে জানাচ্ছেন, “এঁরা অতিমারির সময় সবার দোকান বন্ধ করিয়ে নিজেদের তাঁবেদারদের শুধু ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। নিজেদের মুনাফার জন্য। একই ভাবে নিজেদের কিছু পেটোয়া ট্যাক্সি কোম্পানিকে কাজ দিয়েছেন।”
কেনাবেচায় মন্দা। রাজ্য ধুঁকছে বাণিজ্যের অভাবে। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে ক্রয়-বিক্রয়ের হাট রমরম করছে। বিধায়ক, বিধায়ক পদপ্রার্থীদের রয়েছে পৃথক পৃথক রেটকার্ড। প্রধান দুই দল বিজেপি এবং কংগ্রেস তো বটেই, নবাগত তৃণমূল কংগ্রেস এবং এখানে কিছুটা পুরনো আম আদমি পার্টি— সবাই এই বৃহৎ বাজারের অংশ। ভোট এলে এই মেলার হৃৎকমলে কেনাকাটার ধুম লাগে! রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা, পার্টিজান প্রাণ, দীর্ঘমেয়াদি ভাবে কোনও দলে আদর্শ রক্ষার্থে পড়ে থাকা— এ সব গোয়ার রাজনীতিতে অলীক কথা। আসন চল্লিশটি। কংগ্রেস এবং বিজেপির প্রতিটি আসনে অন্তত তিন জন করে প্রার্থিপদের দাবিদার। যাঁরা আসন পেলেন, তাঁরা লড়বেন। বাকিরা দল ছাড়ার আগে এক বারও ভাববেন না। আর যাঁরা জিতছেন, তাঁদের তো বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী হয়ে রইলই! অমুক কোটি থেকে তমুক কোটির আশ্বাস পেলেই তাঁরা দলবদলু, ভোটে জেতার কয়েক মাসের মধ্যেই। ২০১৭ সালে গোয়ার স্কোরবোর্ড বলছে, কংগ্রেস ১৭, বিজেপি ১৩, বাকিরা ১০। ভোটের ধরন দেখে স্পষ্ট, মানুষ বিজেপি-বিরোধী ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস থেকে ঝাড়ে-বংশে ১০ জন বিধায়ক দু’বছরের মধ্যেই বিজেপিতে! গোয়াবাসী মনে করছেন, তাঁদের ঠকানো হয়েছে। পাশাপাশি ২৮ শতাংশ ক্যাথলিক বিশিষ্ট গোয়ার চার্চও বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ বলেই জানা গিয়েছে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যাচ্ছে না গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জিতে আসা মাননীয় বিধায়কদের। অনেক মুদ্রা পেয়েছেন বলেই না তাঁরা চব্বিশ মাসের মধ্যেই সরাসরি শত্রু (রাজনৈতিক) শিবিরে।
গোয়া এমনই একটি ‘শো পিস’ যা আকারে ছোট বলেও বিভিন্ন কারণে ধরে রাখতে চায় উভয়েই। প্রথমত, তার ভৌগোলিক অবস্থান। গোয়ার সীমান্তে মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটক— এই দুই রাজ্যের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। যা বিজেপি এবং কংগ্রেস দু’দলের কাছেই আকর্ষক। গোয়ার আবাসন ক্ষেত্র, খনি শিল্প এবং সর্বোপরি পর্যটনের রয়েছে কর্পোরেট বিনিয়োগ টানার ক্ষমতা। কিন্তু কোনও লাভের গুড়ই গোয়ানদের কাছে আসছে না। ‘দিল্লির দাদাগিরি’ মুক্ত, ‘গোয়ানদের নিয়ে এবং গোয়ানদের জন্য’ সরকারের ডাক এখানে এসে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই রাজ্যে বসবাসকারী মানুষের সিংহভাগ গোয়ার বাইরে, তাঁদের এখানে ভোট নেই। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক এমনকি গুজরাতের বহু মানুষ গোয়ার বাসিন্দা, যাঁরা এখানকার বেশির ভাগ বেসরকারি উচ্চপদে আসীন। এখানকার মাইনিং থেকে পর্যটন— সবের ক্ষীরটুকু খাচ্ছেন। রাজ্য রাজনীতি নিয়ে যাঁদের মাথাব্যথা নেই। যাঁদের মাথাব্যথা আছে, সেই গোয়ানদের পছন্দ করা জনপ্রতিনিধির আবার দল মত নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই! ফলে এই মাঠে খেলতে হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকেও এখানকার ব্যাকরণ মেনেই খেলতে হবে, এবং সেটা তাঁরা খেলছেও। লুইজ়িনহো ফেলেইরো আজ তৃণমূল কংগ্রেসের গোয়ার এক নম্বর নেতা, কালই তিনি ছিলেন গোয়া কংগ্রেসের প্রাচীনতম নায়ক, এমনকি সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও। আজ কংগ্রেস দিল্লিতে বসে যতই গলা ফাটিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দলভাঙানো নিয়ে নালিশ-অনুযোগ করুক না কেন, তা শেষ পর্যন্ত শূন্যগর্ভ। কারণ তারা নিজেরা বিধায়ক ধরে রাখতে পারেনি এবং তার চেয়েও বড় কথা সুযোগ পেলেই তারা বিজেপি থেকে ‘পোচিং’-এর জন্য উন্মুখ। নেহাত সম্পদ এবং কোমরের জোর এখন তাদের বিজেপির থেকে অনেকটাই কম।
বেতিম-এ গোয়ার অন্যতম বড় ফিশ জেটিতে মমতা যাওয়ার পরে বিজেপি-বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। তাঁদের বকেয়া টাকা মেরে দিচ্ছে বেসরকারি হোটেল রিসর্ট, সরকার হাত গুটিয়ে আছে। দু’বছর হতে চলল তাঁদের ডিজ়েলে সরকারি ভর্তুকি নেই। তারও আগে যা দেওয়া হত, তা তামিলনাড়ুর তুলনায় অর্ধেক। বোট কেনার জন্য সরকার আগে যা সহায়তা দিত, এখন তার অর্ধেক। মমতা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে আশ্বাস দিলেন জনে জনে। জানালেন, তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে মৎস্যজীবীদের সঙ্কটের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ থাকবে। তাঁদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা যোজনা হবে।
তবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদের না বোঝার কথা নয় যে, শুধু বেতিম-ই নয়, গোটা গোয়াই ভোটের আগে একটা খোলা মাছের বাজার হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ধূপ, দীপ, আসন— এগুলি কথার কথা মাত্র। আসলে কাঞ্চনমূল্যই নির্ধারণ করে চলেছে এই অপরূপা সুন্দরী, পর্তুগিজ ঐতিহ্য শরীরে ধারণ করা রাজ্যের দুর্ভাগ্যলিপি।