ভারতে বাজেট মানে শুধু সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়; আগামী কয়েক বছর সরকারের অর্থনৈতিক নীতি কোন অভিমুখে চলবে, তার পথনির্দেশিকাও বটে। সরকারের নীতি এবং কৌশল কী হবে, তা অবশ্যই নির্ভর করে অর্থব্যবস্থার বর্তমান সঙ্কটগুলির চরিত্রের উপরে। কাজেই, এই বাজেটে কোন কোন নীতি থাকা প্রয়োজন, সে কথা বুঝতে গেলে আগে দেখা দরকার যে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখন ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
অর্থব্যবস্থার নাড়ির গতি বোঝার কাজটা এমনিতে সোজাসাপটা— কর্মসংস্থান এবং জিডিপি’র বৃদ্ধির হারের সরকারি পরিসংখ্যান দেখলেই চলে। কিন্তু, ভারতে সে গুড়ে বালি— গত এক দশকে এ দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে, তার ফলে জিডিপি পরিসংখ্যানের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অতএব, কিঞ্চিৎ গোয়েন্দাগিরি প্রয়োজন হচ্ছে— ভোগব্যয়, বিনিয়োগ এবং রফতানির মতো সামগ্রিক চাহিদার বিভিন্ন অংশের পরিসংখ্যান থেকে অর্থব্যবস্থার হাল বোঝার চেষ্টা করতে হচ্ছে।
বহু অর্থনীতিবিদ তো বটেই, সরকারি আমলাদের একাংশও ভারতে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় বৃদ্ধির শ্লথতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২০২৩-২৪ সালে এই ব্যয় গত বছরের তুলনায় মাত্র চার শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান। ২০২১-২২ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল ১১%। কিন্তু, ভোগব্যয়ের গতিভঙ্গ ভারতের একমাত্র ম্যাক্রোইকনমিক সমস্যা নয়। বস্তুত, এটা প্রধানতম সমস্যাও নয়— ভারতে সুস্থায়ী আয়বৃদ্ধির প্রধানতম চালক দু’টি হল যথাক্রমে বেসরকারি বিনিয়োগ ও রফতানি। দু’টি ক্ষেত্রের একটিরও অবস্থা আশাপ্রদ নয়। বিনিয়োগ বিষয়ে পরিসংখ্যানের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র হল সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) প্রকাশিত তথ্য। এই পরিসংখ্যান বলছে যে, বেশ কিছু দিন ধরেই ভারতে বেসরকারি বিনিয়োগের গতিভঙ্গ হয়েছে। দেশে বেসরকারি উদ্যোগে যত প্রকল্প রূপায়িত হচ্ছে, টাকার অঙ্কে তার বৃদ্ধির হার কত, এই সূচকটি যদি নেওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে যে, ২০০৯-১১ সালে এই বৃদ্ধির হারটি ছিল ২৭%। ২০২১-এর প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে ২০২৩-এর চতুর্থ ত্রৈমাসিকের মধ্যে এই হার কমে দাঁড়িয়েছিল ১৫ শতাংশে। ২০২৪-এর প্রথম দু’টি ত্রৈমাসিকে তা আরও কমে হয়েছে ৫%।
আরও দুশ্চিন্তার কথা যে, অদূর ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও সম্ভাবনা এখনও দৃশ্যমান নয়। মোট কত টাকার নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প ঘোষিত হল, সেই হিসাবটির মাধ্যমে সিএমআইই বিনিয়োগের দৃষ্টিভঙ্গি মাপে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরের পর থেকে টাকার অঙ্কে নতুন প্রকল্পের ঘোষিত বিনিয়োগের বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। তাতে আশঙ্কা যে, হয়তো শিগগিরই বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকবে। তা যদি হয়, তবে বেসরকারি বিনিয়োগের পক্ষে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা পালন করা অসম্ভব হবে।
রফতানির ক্ষেত্রেও ছবিটি ম্লান। ২০২১-২২’এ অল্প সময়ের জন্য রফতানির বাজার চাঙ্গা হয়েছিল— তা ছাড়া বাকি সময় ধরে ভারতীয় শিল্পপণ্যের রফতানির বাজারে ভাটার টান। দেশে আর্থিক সংস্কার হয়েছে তিন দশকেরও বেশি সময় আগে, কিন্তু এখনও বিশ্বের মোট রফতানির মাত্র তিন শতাংশ আসে ভারত থেকে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বস্তুত, ২০২৩-২৪ সালে ডলারের অঙ্কে ভারতের রফতানি হ্রাস পেয়েছে ৩%। পরিষেবা ক্ষেত্রে রফতানির ছবিটি তুলনায় ভাল বটে, কিন্তু গত এক বছরে সেই ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪.৯%। কোভিড-পরবর্তী পর পর দু’বছর পরিষেবা রফতানির ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার দশ শতাংশের বেশি ছিল— বিশ্বের মোট পরিষেবা রফতানিতে ভারতের ভাগ ২০০৫ সালের দু’শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩-এ পৌঁছেছিল ৪.৬ শতাংশে। কিন্তু, ২০২৩-২৪’এ সেই গতি বজায় থাকেনি।
সব মিলিয়ে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় চাহিদাজনিত সমস্যা রয়েছে বলেই মনে হয়। সার্বিক চাহিদা দ্রুত না বাড়লে জিডিপি বৃদ্ধির চড়া হার বজায় রাখা কঠিন হবে; সমস্যা বাড়বে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও। অর্থব্যবস্থার উপরে ঘনিয়ে থাকা এই কালো মেঘ মাথায় নিয়েই অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট পেশ করবেন আজ। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে বিভিন্ন ধরনের কল্যাণ প্রকল্প ও ভর্তুকি ঘোষণা করার। কিন্তু, সে পথে হাঁটলে মস্ত ভুল হবে। সরকার এখন ৩০০টি কল্যাণ প্রকল্প চালায়, তার পিছনে খরচ হয় ৩৩ লক্ষ কোটি টাকা। কেউ কি এ কথা বিশ্বাস করেন যে, আর ক’টা কল্যাণ প্রকল্প চালু করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
এখন যা চাই, তা হল, বিনিয়োগ ও রফতানিতে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় আয়বৃদ্ধির উচ্চতর কক্ষপথে পৌঁছতে সাহায্য করা। এই বাজেটে তিনটি বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি। এক, যে-হেতু দেশে অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয়ের বৃদ্ধি শ্লথ, তাই ভারতের উচিত বিদেশি বাজারের চাহিদাকে ধরার চেষ্টা করা। তার জন্য শিল্পপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিতে হবে। বস্তুত, শিল্পপণ্য রফতানি ক্ষেত্রে বড় শক্তি হয়ে ওঠার সুবর্ণসুযোগ ভারতের সামনে, কারণ বিভিন্ন দেশ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চিনের উপর অতিনির্ভরতা কমাতে চাইছে। ভারতের পক্ষে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সম্পূর্ণ সুবিধা নেওয়া কী ভাবে সম্ভব? উত্তরটা জটিল নয়— এই মুহূর্তে ভারতের কর্তব্য আমদানি শুল্ক হ্রাস করে, বাণিজ্যের পথে বিভিন্ন বাধা দূর করে, এবং বড় বাণিজ্যসঙ্গীদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনা করে উদার বাণিজ্য নীতির সূচনা করা প্রয়োজন।
গত কয়েক বছরে ভারত সরকার যে বৈদেশিক বাণিজ্য-বিমুখ অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ করেছে, তার উল্টো পথে হাঁটতে হবে। গত এক দশকে গড় আমদানি শুল্ক ১৩% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮%। এশিয়ায় ভারতের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় এই হার যথেষ্ট বেশি। রফতানি বাড়াতে চাইলে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে কেন? কারণ, আজকের দুনিয়ায় যে সংস্থাই রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করুক না কেন, উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করতে হলে তাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তর্বর্তী পণ্য আমদানি করতেই হবে। আমদানি শুল্ক চড়া হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, ফলে ভারতীয় পণ্য বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারাবে। অন্য দিকে, আমদানি শুল্ক কম হলে উৎপাদন ব্যয়ও কমবে, ফলে ভারতীয় পণ্য বিদেশের বাজারে দাপিয়ে বেড়াতে সক্ষম হবে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকার এ বছর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে কার্যত অপ্রত্যাশিত ভাবে ২.১১ লক্ষ কোটি টাকা পেয়েছে ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ হিসাবে। বাজেটে এই টাকার সুব্যবহার করে সরকারের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি করা প্রয়োজন। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কেন্দ্রের রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে জিডিপি-র ৫.১%, যা এফআরবিএম আইনের ধার্য লক্ষ্যমাত্রা ৩ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। কোভিড-পর্বে সরকারের ঘাটতির পরিমাণ বিপুল ভাবে বেড়েছে— এই বাজেটে তা কমিয়ে আনা দরকার। রাজকোষ ঘাটতি এবং ঋণের পরিমাণ কমলে অর্থব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আসবে, যা আবার বেসরকারি লগ্নি বাড়াতে সহায়ক হবে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণের কাজটি চালিয়ে যাওয়া দরকার। এখন শেয়ার বাজারে এই সংস্থাগুলির মূল্যায়ন চড়া, ফলে এই সুযোগে আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে সংস্থাগুলি বেচে দেওয়া যায়, এবং তার থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে সরকারের রাজস্ব পরিস্থিতিকে মজবুত করা যায়। এতেও বেসরকারি লগ্নি বাড়তে পারে। এর একটি ভাল উদাহরণ হল এয়ার ইন্ডিয়ার বিলগ্নিকরণ। তার নতুন মালিক টাটা গোষ্ঠী সংস্থাটিকে ফের দাঁড় করাতে বিপুল লগ্নি করছে।
অর্থমন্ত্রীর উচিত, ভারতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির বিচার করে এই বাজেটে যথাযথ নীতি ঘোষণা করা। স্বীকার করা প্রয়োজন যে, অর্থব্যবস্থা যথেষ্ট ভাল ভাবে চলছে না, এবং সেই বাস্তবের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ও সংহত বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই কাজটি করা হলে অর্থব্যবস্থায় চাহিদা ফিরতে পারে। আর, এই সুযোগ হারালে অন্ধকার গাঢ়তর হবে।