ক’জন ঘুরে দাঁড়ালেন?
GDP

জাতীয় আয় বাড়ছে, সবার চাকরির ব্যবস্থা কিন্তু হচ্ছে না

শুধু কোভিডেরই ক্ষতি? পরিসংখ্যান বলবে, অতিমারি আরম্ভ হওয়ার অনেক আগে থেকেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতের অর্থব্যবস্থা।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:১২

সব ঠিকঠাক চললে এই অর্থবর্ষে ভারতে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৯.২ শতাংশ, জানিয়েছে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস প্রকাশিত ফার্স্ট অ্যাডভান্স এস্টিমেটস অর্থাৎ প্রাথমিক আগাম হিসাব। সব ঠিকঠাক চলবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য ঘোরতর সংশয় রয়েছে, কারণ এই হিসাব কষা হয়ে গিয়েছিল কোভিড-১৯’এর তৃতীয় প্রবাহ শুরু হওয়ার আগেই। আপাতত সেই তর্কে ঢোকার প্রয়োজন নেই। ধরে নেওয়া যাক, এই বছর জিডিপি বাড়ছে ৯.২ শতাংশই।

কিন্তু, তাতেই বা কী? গত বছর জিডিপি হ্রাস পেয়েছিল ৭.৩ শতাংশ। সেখান থেকে ৯.২ শতাংশ বৃদ্ধি মানে, কোভিড আরম্ভ হওয়ার আগে ভারতের জিডিপি যেখানে ছিল, তেলমাখা বাঁশে বিস্তর ওঠানামার পর, দু’বছর পার করে, সেখানে ফেরত যাওয়া গিয়েছে মাত্র। সরকারি কর্তারা বলছেন, কোভিডের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে ফেলল ভারত। কথাটা ডাহা মিথ্যে। কারণ, মাঝখানে চলে গিয়েছে দুটো বছর— কোভিডের ধাক্কা না লাগলে সেই দু’বছরে জিডিপি-র মাপ যতখানি এগোত, সেই ব্যবধান পূরণ করতে সময় লাগবে আরও অনেক। কত দিন, তার অনেক রকম অনুমান পাওয়া যাচ্ছে— পাঁচ বছর থেকে পনেরো বছর, সময়ের হিসাব নানান রকম। কিন্তু, মোদ্দা কথাটা এক— কোভিড অর্থব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছে, তা পূরণ করা মুখের কথা নয়।

Advertisement

শুধু কোভিডেরই ক্ষতি? পরিসংখ্যান বলবে, অতিমারি আরম্ভ হওয়ার অনেক আগে থেকেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতের অর্থব্যবস্থা। অতিমারির আগের চার বছরের প্রতি বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে কম ছিল। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যত খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়েই যাক, এত দিন ধরে একটানা এমন গতিভঙ্গ কখনও হয়নি। গ্রামাঞ্চলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা এবং ভোগব্যয় হ্রাস পেয়েছে, তা-ও অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগেই। বাজারেও চাহিদা কমছিল অর্থব্যবস্থার গায়ে ভাইরাসের আঁচড় লাগার আগে থেকেই। অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যভঙ্গের পুরো দায়টাই অতিমারির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে শাসকদের লাভ হয় বটে, সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা হয় না।

কিন্তু, সে সব তো অতীত। ঝড়ঝাপটা সামলে এই বার ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ালে এই সব ক্ষতে প্রলেপ পড়বে নিশ্চয়ই। এই জায়গায় এসে প্রাথমিক আগাম হিসাব আর ভরসা দেয় না। পরিসংখ্যান বলছে যে, এই অর্থবর্ষে অনেক কিছুই বাড়ছে বটে, কিন্তু খুঁড়িয়ে চলছে মানুষের ভোগব্যয়। জিডিপি হিসাব করা হয় তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে— মানুষের ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, সরকারের ভোগব্যয় এবং স্থায়ী মূলধন নির্মাণ, অর্থাৎ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এই অর্থবর্ষে জিডিপি-তে সরকারি ভোগব্যয়ের অনুপাতও বেড়েছে, স্থায়ী মূলধন নির্মাণের অনুপাতও বেড়েছে। কমে গিয়েছে ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের অনুপাত। মানুষের খরচের মাত্রা এখনও কোভিড-পূর্ব স্তরে পৌঁছয়নি।

জিডিপি বাড়ছে, অথচ মানুষের ভোগব্যয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না— কেন? দেশের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন একটা কথা বলেছেন— যাঁরা বেশি খরচ করেন, তাঁদের বদলে রোজগার গিয়েছে যাঁরা বেশি সঞ্চয় করেন, তাঁদের হাতে। তার মানে কি হঠাৎ পাড়ার একাদশী ভটচাযের রোজগার বেড়ে গেল, যার নামে হাঁড়ি ফাটে লোকের, এমনই কৃপণ? তা নয়। কথাটার মানে হল, এমন লোকের হাতে টাকা বেড়েছে, অন্যদের তুলনায় যাঁদের রোজগারের অনুপাতে ভোগব্যয় কম। এমন লোক কারা? ধনীরা। গরিব মানুষের যে হেতু রোজগার কম, তাঁদের আয়ের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় চাল-ডাল-জমাকাপড়-ওষুধ-যাতায়াত-লেখাপড়ায়। এই সব খাতে ধনীদের খরচের পরিমাণ গরিবদের তুলনায় ঢের বেশি ঠিকই, কিন্তু তাঁদের রোজগারের অনুপাতে এই খরচ অনেক কম। তার চেয়েও বড় কথা, যে গরিবের মাসে আয়ে সাত হাজার টাকা, তাঁর আয় আরও হাজার টাকা বাড়লে তার প্রায় পুরোটাই ভোগব্যয়ে খরচ হবে— একটু বেশি খাবার, একটা নতুন জামা, এই রকম ভাবে। কিন্তু, যাঁর আয় মাসে দু’লক্ষ টাকা, তাঁর আরও হাজার টাকা বাড়তি আয় হলে খুব সম্ভবত ভোগব্যয়ের পরিমাণ নতুন করে বাড়বে না, টাকাটা সঞ্চয় করবেন তিনি। প্রণব সেন যে কথাটা বলেছেন তা হল, অর্থব্যবস্থা যদি বা ঘুরে দাঁড়ায়, তার সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বদলে পৌঁছচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে। আগাম হিসাব তার প্রমাণ দিচ্ছে।

কথাটা অবশ্য নতুন নয়। ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারত একই সঙ্গে দরিদ্র এবং অতি বৈষম্যসম্পন্ন দেশ। সবচেয়ে বড়লোক ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে ৫৭ শতাংশ জাতীয় আয়; তার মধ্যে একেবারে শীর্ষের এক শতাংশের হাতেই রয়েছে ২২ শতাংশ। অন্য দিকে, দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে ১৩ শতাংশ আয়। অর্থাৎ, জাতীয় আয়ের হিসাবে ভোগব্যয় কমার যে ছবিটা ধরা পড়ছে, তার উৎস রয়েছে আয়ের অসাম্যে। গরিব মানুষের হাতে ব্যয় করার মতো যথেষ্ট টাকা নেই, তাই ভোগব্যয়ও কম।

প্রশ্ন হল, এই অবস্থা কি অতিমারির কারণে ঘটছে, না কি অসাম্যের কারণ গভীরতর? এই প্রশ্নের একটা স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যেতে পারে বেকারত্বের পরিসংখ্যানে। অতিমারি শুরুর আগে থেকেই বেকারত্ব বেড়ে চলেছে, এবং গত ডিসেম্বরে যখন অর্থব্যবস্থা মোটের উপর একটা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছিল, তখনও দেখা গেল, দেশে বেকারত্বের হার প্রায় আট শতাংশ। যত জন মানুষ দেশে কাজ খুঁজছেন, তার আট শতাংশ মানুষ কোনও কাজই পাচ্ছেন না। অর্থাৎ, বেকারত্বের দায়ও পুরোপুরি অতিমারির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া মুশকিল। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কথা হল, কাজ পাওয়া যাবে না, এই আশঙ্কায় বহু মানুষ কাজের খোঁজ করাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এবং, খাতায় কলমে যাঁদের কাজ আছে, তাঁদের একটা বড় অংশ ‘স্বনিযুক্ত’— অর্থাৎ, চাকরি না পেয়ে যা হোক একটা কিছু ব্যবসা করে ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন কোনও ক্রমে।

দেশের মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু লোকের বেকারত্বও বাড়ছে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় কী করে? প্রাথমিক আগাম হিসাবের অঙ্কে এই প্রশ্নেরও উত্তর রয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে মূলত পুঁজিনিবিড় ক্ষেত্রে, যেখানে নতুন শ্রমিক নিয়োগের সম্ভাবনা কম। শ্রমনিবিড় পরিষেবা ক্ষেত্র এখনও ধুঁকছে। বাজারে শ্রমের চাহিদা কম, ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে না। যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকেই আগের চেয়ে কম মাইনেতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু, তার বাইরেও একটা ঘটনা ঘটছে। পাল্টে যাচ্ছে চাকরির চরিত্র। পাকা চাকরির দিন অনেক আগেই গিয়েছে। চুক্তিভিত্তিক স্থায়ী চাকরিরও বাজার ফুরোল এই বার। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি নামক যে সংস্থাটির প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে প্রতি মাসে বেকারত্বের ছবিটি পাওয়া যায় এখন, তার কর্ণধার মহেশ ব্যাস এক সাক্ষাৎকারে বললেন, সংগঠিত খুচরো ব্যবসা থেকে হরেক পরিষেবা ক্ষেত্র, সর্বত্রই এখন নিয়োগ করা হচ্ছে ‘গিগ’ কর্মী। অর্থাৎ, সংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে গড়ে উঠছে এক আশ্চর্য কাজের বাজার, যেখানে কর্মীদের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও নেই। ‘কাজ-করলে-মাইনে’র শর্তে নিয়োগ করা যায় যাঁদের, এবং চোখের পলকে ছেঁটেও ফেলা যায়। এমন চাকরির জোরে ভোগব্যয় বাড়ে না, সেটা অনেক পরের কথা— এমন চাকরির ভরসায় কালকের বেঁচে থাকাটুকুও দেখতে পাওয়া যায় না, সেটাই আসল।

তার পরও দিল্লির শাসকরা দাবি করবেন যে, অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতই সবচেয়ে দ্রুত সামলে নিয়েছে কোভিড-এর ধাক্কা। শীর্ষে থাকা এক শতাংশ, এমনকি দশ শতাংশ মানুষের কাছেও কথাগুলো সত্যি, বাস্তব। কিন্তু, তার বাইরে যে আশি শতাংশের ভারত, সেখানে দাঁড়িয়ে শাসকদের এই কথায় বিশ্বাস করব কি না, এই বিবেচনা একান্তই আমাদের।

আরও পড়ুন
Advertisement