দেশের সমাজ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সূচক নিয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাবে ২০২১ সালের জনশুমারিতে। তবু তার আগে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দু’টি ধাপে গোটা দেশ জুড়ে প্রায় সাড়ে ছ’লক্ষ পরিবার এবং সোয়া আট লক্ষ মানুষের মধ্যে চালানো পঞ্চম দফার জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট আপাতত আমাদের হাতে। তাতে গোটা দেশের সমগ্র ছবিটা একশো শতাংশ ধরা না পড়লেও, বাস্তবটুকু বোঝার ক্ষেত্রে সে যথেষ্ট প্রামাণ্য। সেই বাস্তবের মধ্যে এক ব্যতিক্রমী ইতিবাচক ছবি নির্ভুল ফুটে উঠেছে।
জনশুমারি হোক অথবা জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা— এর আগে কোনও গুনতিতেই এ দেশে নারী ছাপিয়ে যায়নি পুরুষকে। এই প্রথম। এনএফএইচএস-এর চতুর্থ দফায় প্রতি হাজার পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল ৯৯১। এ বার তা পৌঁছে গিয়েছে ১০২০-তে। বাংলায় অনুপাতটি ১০৪৯।
উল্লেখযোগ্য হল, গ্রামের (১০৩৭) তুলনায় শহরে (৯৮৫) এই অনুপাত বেশ কম। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত এই যে, রুটি-রুজির জন্য গ্রামের মানুষরা শহরে চলে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই পুরুষ। পুরুষদের এই শহরকেন্দ্রিক পরিযাণ ছাপ ফেলেছে উভয় প্রান্তের লিঙ্গ অনুপাতেই।
লিঙ্গ-অনুপাত মেয়েদের দিকে ঝুঁকেছে, খবরটি অত্যন্ত ইতিবাচক। এর সঙ্গে নারীর সামাজিক অবস্থান বা ক্ষমতায়নের সম্পর্ক জোরদার। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য তথ্যও সে দিকেই নির্দেশ করছে। পরিবারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবাহিত মহিলাদের অবদান আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে ব্যক্তিগত অথবা যুগ্ম ভাবে জমি বা বাড়ির মতো স্থাবর সম্পত্তিতে মহিলাদের মালিকানা। বেড়েছে মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, কর্মসংস্থানও।
সংখ্যার দিক থেকে সামগ্রিক ভাবে পুরুষের তুলনায় নারীর এগিয়ে যাওয়া কি নির্দেশ করে যে, পুত্রসন্তানের তুলনায় কন্যাসন্তানের জন্মহার বেশি? তা কিন্তু নয়। জন্মের সময় লিঙ্গ অনুপাতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বিগত পাঁচ বছরে সেই অনুপাত হল প্রতি ১০০০ পুত্রসন্তানে ৯২৯ কন্যাসন্তান। গত দফার সমীক্ষার তুলনায় (৯১৯) এই অনুপাত বেড়েছে, তবুও স্পষ্ট যে, এখনও বহু পথ হাঁটা বাকি।
তা হলে এই বর্ধিত লিঙ্গ অনুপাতের কারণ কী? নারীর সামাজিক অবস্থান বা ক্ষমতায়নের পাশাপাশি আর একটি কারণ হল, এ দেশে এখনও নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় কিছুটা বেশি। বিগত দশকগুলিতে মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য নির্দিষ্ট অভিমুখে যে প্রয়াস হয়েছে, বিভিন্ন সূচকে তারই সুফল মিলছে। নারী এখন সংখ্যার দিক থেকে পুরুষকে ছাপিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেশি বছর বাঁচছে। কিন্তু, বেশি অবহেলিত হয়ে বাঁচছে। শারীরবৃত্তীয় কারণেই মেয়েদের রক্তাল্পতার সম্ভাবনা বেশি— তবু ভুললে চলবে না, যে পরিবার এবং সমাজ এখনও পুত্রসন্তান চায়, তারা মেয়েটির মাসিক শুরু হওয়ার বা সে গর্ভবতী হওয়ার অনেক আগে থেকে তার থালা থেকে সরিয়েই ছেলেটির জন্য তুলে রাখে পুষ্টির অধিকাংশ। বৃদ্ধ বয়সে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে শুরু করে পরিবারের সাহায্য বা সহানুভূতি পাওয়ার ক্ষেত্রেও একই লিঙ্গবৈষম্য বর্তমান। তাই গড় আয়ু বেশি হয়েও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার সূচকে কিন্তু নারীরা পিছিয়েই।
ঘরোয়া আড্ডা থেকে শুরু করে চায়ের দোকান হয়ে নির্বাচনী প্রচার পর্যন্ত অনেকেই একটি ব্যাপারে একমত— আমাদের দুর্দশার প্রথম ও প্রধান কারণ হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তাই প্রয়োজন এক লৌহপুরুষ এবং তাঁর বজ্র আইন, যা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সবাইকে বাধ্য করবে কম সন্তান উৎপাদনে। আর সন্তান কম উৎপাদিত হলেই জনসংখ্যা কমবে— সুযোগ এবং সুদিন আসবে পাল্লা দিয়ে। হাতের কাছে চৈনিক উদাহরণ তো আছেই। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিমানুষের গলা টিপে ধরলেই সব সমস্যার তুরন্ত ও সহজ সমাধান!
জনবিজ্ঞানের পরিভাষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা কিন্তু এতখানি সহজ নয়। তা ছাড়া, এই যুক্তিগুলোও অত্যন্ত দুর্বল। একটি দেশ এবং তার জনসংখ্যা একটি নির্দিষ্ট চক্রের মধ্যে দিয়ে যায়। দেশ যখন অনুন্নত, মানুষ যখন গরিব, তাঁদের কাছে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার গড়পড়তা সম্ভাবনাই যখন কম, তখন তাঁরা বিবর্তনের নিয়মেই বেশি সন্তান উৎপাদন করেন। জন্মহারের পাশাপাশি সিলিং ছুঁয়ে থাকে মৃত্যুহারও। তার পর আর্থিক ও সামাজিক মাপকাঠিতে দেশ এগোলে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী হলে, সুযোগ-সুবিধা বাড়লে কমে আসে জন্মহার এবং মৃত্যুহার। পাল্লা দিয়ে কমে গড় সন্তান উৎপাদনের চাহিদা।
এ দেশে সেটা বিগত অনেকগুলো দশক ধরেই হয়েছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যে টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) ছিল প্রায় ছয়, সমীক্ষা অনুযায়ী সেই সংখ্যাটাই আজ নেমে এসেছে দুইয়ে। এই প্রথম টিএফআর নেমে এল ২.১-এর নীচে— যাকে ধরা হয় প্রতিস্থাপন মাত্রা। প্রতিস্থাপন মাত্রার তাৎপর্য হল, কোনও জনগোষ্ঠীর টিএফআর যদি এই স্তরে থাকে, তা হলে সেই জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যাকে স্থিতিশীল ধরে নিতে হবে। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে জনসংখ্যা বাড়বে না। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ কাল ধরেই টিএফআর নিম্নগামী, এখন তা ১.৬।
‘জনবিস্ফোরণ’ এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কড়া আইন প্রণয়নের তত্ত্বকে কি চুপ করাতে পারবে পঞ্চম দফার এনএফএইচএস-এর ফলাফল? সেই তত্ত্বটি নিখাদ রাজনীতির। স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই হোক, বা উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল আনা এবং তাকেই মডেল বানাতে চাওয়া— রাজনীতি অতি প্রকট। সেই রাজনীতি শুধু এটুকু বলে না যে, আমাদের সমস্ত সমস্যা জনবৃদ্ধির জন্য— আরও এক ধাপ এগিয়ে এটাও বলে যে, এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির আসল কারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলিই।
কথাটা ডাহা মিথ্যে। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রমাণিত যে, কোনও জনগোষ্ঠীর উচ্চ জন্মহারের কারণ ধর্মীয় নয়। তা বিবর্তনগত, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক। যে জনগোষ্ঠী যত বেশি অ-সুরক্ষিত বা নিজেকে অ-সুরক্ষিত মনে করে সে তত বেশি সন্তান উৎপাদন করতে চায়। তার পরেও বলা প্রয়োজন যে, বিগত পঞ্চাশ বছরে এ দেশের সামগ্রিক জন্মহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমেছে মুসলমানদের জন্মহারও। বস্তুত, তা কমেছে হিন্দুদের তুলনায় দ্রুততর হারেই। মোট জনসংখ্যার যে ধর্মীয় অনুপাত, তাও বিগত সত্তর বছর ধরে একই। কাজেই, গত ত্রিশ বছর ধরে জনস্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা, নারীসুরক্ষা থেকে শুরু করে পরিবার পরিকল্পনায় যে জোর দিয়ে আমরা আজ সুফল পাচ্ছি, দেশটাকে উত্তরপ্রদেশ মডেলে বলিউডি সিনেমার সেট না বানিয়ে চেষ্টা করতে হবে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা ঝাড়খণ্ডের মতো যে সব রাজ্যে জন্মহার এখনও প্রতিস্থাপন মাত্রা ছোঁয়নি, সেখানেই প্রজননক্ষম নারীদের মধ্যে ২০%-এর বেশি নিরক্ষর— এ নেহাত কাকতালীয় নয়।
আমরা চিনের ‘এক সন্তান নীতি’-র উদাহরণ দিই, কিন্তু খবর রাখি না যে, রাষ্ট্রীয় সাঁড়াশিতে বিজ্ঞানের নিয়মকে চেপে ধরা যায় না। জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণের ফল ভোগ করতে হয় নারীদেরই— কন্যাভ্রূণ হত্যা, গর্ভপাত বাড়ে। ভারসাম্য নষ্ট হয় বহুচেষ্টায় অর্জিত লিঙ্গ-অনুপাতের। ত্রিশ বছর পেরিয়ে দেখা যায় যে, দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষের বয়স বেড়ে গেছে, তাঁরা স্বাভাবিক নিয়মেই সরে এসেছেন কর্মক্ষেত্র থেকে। অথচ তাঁদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো যথেষ্টসংখ্যক কমবয়সি ছেলেমেয়ে নেই। সে শূন্যতায় ভিড় করে আসে অসাম্য আর সামাজিক অশান্তি। দীর্ঘ ত্রিশ বছর পরে এক প্রকার বাধ্য হয়েই চিন ‘এক সন্তান নীতি’ প্রত্যাহার করে সন্তান উৎপাদনে নাগরিকদের উৎসাহ দিচ্ছে।
প্রশ্নটা জনসংখ্যা, তার বৃদ্ধি আর তার অবৈজ্ঞানিক নিয়ন্ত্রণের নয়। প্রশ্নটা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নারী সুরক্ষা, সামাজিক স্থিতিশীলতা হয়ে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও সদিচ্ছার। প্রথমটা সহজ, দ্বিতীয়টা অনেক কঠিন। সমাজ আর দেশ বদলায় ধীর অথচ সুসংহত গতিতে। তাকে পাঠ করার, ছড়িয়ে দেওয়ার এবং তাকে ফুরিয়ে যেতে না দেওয়ার দায় আমাদেরই।
কমিউনিটি মেডিসিন, পিজিআইএমএস রোহতাক