আমেরিকায় ট্রাম্প ফিরে এলে বিশ্বময় অভিঘাত অনিবার্য
Donald Trump

ফিরে আসার পদশব্দ?

অনেকে অবশ্য বলবেন, এমন আশঙ্কা তো কেবল ট্রাম্প-বিরোধী ‘ডেমোক্র্যাট’-দের, যাঁরা সব কিছুর মধ্যেই ট্রাম্পের ‘ভূত’ দেখেন।

Advertisement
শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৩ ০৫:০৪
Donald Trump.

জনসংযোগ: টেক্সাসে এক সভায় আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২৫ মার্চ ২০২৩। রয়টার্স।

ছোটবেলায় দেখা এক রোমহর্ষক বাংলা ছবির রহস্য উন্মোচনের আগে গভীর রাতে এক অজানা পায়ের চলনের বুক-ঢিপ-ঢিপ-করা দৃশ্যটি কেন যেন বহু বার অবচেতনে ফিরে ফিরে এসেছে! সম্প্রতি একটি খবর প্রকাশ পাওয়ায় এই জাতীয় অনুভূতি বোধ হয় আমেরিকার এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মনেও বেশ প্রভাব ফেলেছে— সে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে কারও ‘ফিরে আসা’র পদশব্দে। খবরটা হল, দু’বছরের বেশি নিষেধাজ্ঞার পর বহুজাতিক সমাজমাধ্যম কোম্পানি ‘মেটা’ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘ফেসবুক’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাড় দিল। একটি বারো সেকেন্ডের ভিডিয়ো পোস্ট করে ট্রাম্প জানিয়েছেন, ‘তিনি ফিরে এসেছেন’! একই সঙ্গে সহমর্মী দর্শকদের আবেদন জানিয়েছেন, সামনের বছর (২০২৪) হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের প্রচারে সকলে যেন তাঁকে সমর্থন করে।

অনেকে অবশ্য বলবেন, এমন আশঙ্কা তো কেবল ট্রাম্প-বিরোধী ‘ডেমোক্র্যাট’-দের, যাঁরা সব কিছুর মধ্যেই ট্রাম্পের ‘ভূত’ দেখেন। ঘটনা অবশ্য তা নয়। ট্রাম্পের নিজের দলের লোক ‘রিপাবলিকান’দের মধ্যেও অনেকে এই আশঙ্কায় ভুগছেন। দল-নির্বিশেষে যে কোনও গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির সেই ভয়ঙ্কর দিনটার স্মৃতি ভুলতে পারছেন না, যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনা কম হতেই স্বয়ং ট্রাম্পের উত্তেজক বক্তৃতায় ক্ষিপ্ত, বিশৃঙ্খল ‘ভক্ত’-এর দল ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল-এ ‘কংগ্রেস’-এর অধিবেশন বানচাল করতে সেখানে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়ে প্রায় সাতাশ লক্ষ ডলার মূল্যের সম্পত্তি বিনষ্ট করে। ঘটনায় পাঁচ জন প্রদর্শনকারীর মৃত্যু হয়, ও ১৩৮ জন পুলিশ অফিসার-সহ বহু মানুষ আহত হন। ঘটনার অভিঘাতে পরে চার জন পুলিশকর্মী আত্মহত্যা করেন।

Advertisement

তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স যখন বেআইনি দাবি মেনে গণনার ফলাফল উল্টে দিতে অস্বীকার করেন, তখন দাঙ্গাবাজরা একটি ফাঁসিকাঠ স্থাপন করে আওয়াজ তোলে, ‘মাইক পেন্স-কে ফাঁসিতে ঝোলাও!’ এই অতর্কিত হামলায় হতভম্ব প্রতিনিধি সভার স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি টেবিলের তলায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচান। সব মিলিয়ে আমেরিকার ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর, ১৩ জানুয়ারি ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার সংসদীয় বিচার বা ইমপিচমেন্ট হয়। এর আগে ২০১৯ সালে আমেরিকান প্রতিনিধি সভা ক্ষমতা অপব্যবহারের জন্য প্রথম বার তাঁকে ইমপিচ করলেও আইনসভার উচ্চকক্ষ সেনেট ট্রাম্পকে খালাস করে। কিন্তু ৬ জানুয়ারির অভিঘাতে ট্রাম্পের দলেরই দশ জন তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেন। এর পরেই ফেসবুক-টুইটার’সহ বিভিন্ন সংস্থা তাদের সমাজমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এখন সেই নিষেধ উঠে যাওয়ায়, কেবল ডেমোক্র্যাটরাই নয়, রিপাবলিক দলেরও অনেকে কাঁটা হয়ে রয়েছেন।

জাতীয় রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের আগে অবশ্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে রিপাবলিক দলের মনোনয়ন পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই তোপের মুখে পড়বেন অন্য এক দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী, ফ্লরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস— একদা ট্রাম্পের সমর্থনে রাজনীতিতে উদয় হলেও যিনি এখন ট্রাম্পের অন্যতম ঘোষিত প্রতিপক্ষ। ইতিমধ্যেই ট্রাম্প ডিস্যান্টিস-এর নানা ‘দুর্বলতা’ (“দেখো ও কী ভাবে নিজের নাম উচ্চারণ করে”) নিয়ে সরব হয়েছেন। ফেসবুক-এ প্রবেশ সেই আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়াবে। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে— বা, না পেলে নির্দল প্রার্থী হিসাবে— ট্রাম্প যদি সত্যিই হোয়াইট হাউসে পা রাখেন, তবে প্রথমে কোপ পড়বে এফবিআই, সিআইএ-সহ নানা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকের উপরে, যাঁদের পরিবর্তে নির্ভেজাল ট্রাম্প অনুগতরাই স্থান পাবেন।

ফিরে আসতে পারলে ট্রাম্প যে প্রথাগত ভাবে আইনসভার, বিশেষত সেনেট-এর পরামর্শ ও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো চলবেন, এমন শঙ্কায়ও ভুগছেন অনেকেই। পাশাপাশি, আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব কমিয়ে তাঁর মতাদর্শগত আহ্বান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ বা ‘এমএজিএ’ সমর্থকদের প্রশাসনের নানা পদে নিযুক্ত করে সমান্তরাল প্রশাসনও চালাতে পারেন। ‘এমএজিএ’-র সমর্থকরা বিশ্বাস করে কেবল ভূমিপুত্র আমেরিকানদের (পড়ুন, শ্বেতাঙ্গদের) অধিকারে— যেখানে আমেরিকা গড়েই উঠেছে ‘বাইরের’ নানা দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ে। যে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা নিজেদের ‘ভূমিপুত্র’ দাবি করছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষরা ইউরোপের কোনও না কোনও দেশ থেকে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছেন মূল ভূমিপুত্র আমেরিকান-ইন্ডিয়ানদের নির্মম ভাবে হটিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি, অধ্যাপনা-গবেষণা ও নানা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত থেকে সে দেশকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। কিন্তু ‘এমএজিএ’-র কূপমণ্ডূক নীতি ফের চালু হলে এই সব অভিবাসীর (আগেও ট্রাম্প ‘কাজ করার ভিসা’ প্রদানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন) জীবনকে ঘোর সমস্যায় ফেলবে। মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত স্প্যানিশ ভাষাভাষী ‘হিস্পানিক’ জনগণেরও আশঙ্কার সীমা থাকবে না। বিভিন্ন বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে কৃষ্ণাঙ্গদের হয়তো আবার জর্জ ফ্লয়েড-এর মতো শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটুর তলায় দমবন্ধ হয়ে ‘আই ক্যান্ট ব্রিদ’ বলতে হবে।

তা ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ-তাবৎ, আমেরিকা বিশ্বে পশ্চিম ইউরোপের শক্তিগুলিকে নিয়ে যে সামরিক জোট (নেটো) ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তার কী হবে? কারণ, ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় এলে যদি আমেরিকা এই বিশ্বনেতৃত্বের ভূমিকা থেকে সরে এসে কেবল আমেরিকামুখী হয়ে ওঠে, তবে তার উপরে নির্ভরশীল কেবল পশ্চিমি বড় শক্তিগুলিই নয়, এই মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষরত ইউক্রেনও দারুণ অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারালয় ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ ঘোষণা করলেও রাশিয়ার পুতিন তো ট্রাম্পের পুরনো বন্ধু। যদি সত্যিই ট্রাম্প এমন ঘরমুখো নীতি নেন, তবে এশিয়ার একটা বিরাট অঞ্চলে চিনের (যার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কও ভাল) প্রভাব আরও বাড়তে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ শক্তি ভারত তখন কী নীতি গ্রহণ করবে?

অনেকে বলতে পারেন, এ সব তো কেবল ট্রাম্প ফিরে আসার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আগাম চিন্তাভাবনা— যদি সত্যিই এমন ঘটে তখন দেখা যাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারবারিদের কেবল ‘যা চলছে’ তার উপর নিশ্চিন্তে বসে না থেকে, যে সম্ভাবনা কিছুটা উঁকি মারছে, তাকেও গুরুত্ব দিয়ে বিকল্প নীতির কথা মাথায় রাখতে হয়। তাতে অবশ্য, মিডিয়ার দৌলতে, কেবল স্থানীয় কেচ্ছায় মজে-থাকা এই রাজ্যবাসীর অনেকেরই কিছু যায় আসে না। তারা এখনও, প্রয়াত অর্থনীতিবিদ অশোক রুদ্রের ভাষায়, ‘আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক’-এ ব্যস্ত!

আরও পড়ুন
Advertisement