america

সমাজ পাল্টানো কার কাজ

ওল্ড টেস্টামেন্টের কিছু অদ্ভুত ব্যাখ্যার মাধ্যমে পুনর্গঠিত সেই সমাজে মেয়েদের অর্থ বা সম্পত্তির মালিকানা নিষেধ, অনুমতি নেই লেখাপড়ার।

Advertisement
অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২২ ০৫:০৫

কানাডিয়ান লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউডের ১৯৮৫’র ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস দ্য হ্যান্ডমেড্‌স টেল। সে গল্পে ‘গিলিয়েড’ নামক কল্পিত এক প্রবল পিতৃতান্ত্রিক, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, সর্বগ্রাসী ধর্মতান্ত্রিক দেশ উৎখাত করেছে আমেরিকান সরকারকে। ওল্ড টেস্টামেন্টের কিছু অদ্ভুত ব্যাখ্যার মাধ্যমে পুনর্গঠিত সেই সমাজে মেয়েদের অর্থ বা সম্পত্তির মালিকানা নিষেধ, অনুমতি নেই লেখাপড়ার। কেড়ে নেওয়া হয় অভিজাত শাসক শ্রেণির সেবায় নিয়োজিত ‘হ্যান্ডমেড’ নামক এক দল মেয়ের নিজের ইচ্ছেমতো প্রজননের অধিকারও।

আজ, প্রায় ৩৭ বছর পরে, এক নিবন্ধে অ্যাটউড নিজেই সেই কাল্পনিক গিলিয়েডের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখিয়েছেন আজকের আমেরিকার, যে দেশে সম্প্রতি আধ শতক পুরনো ‘রো বনাম ওয়েড’ রায়কে উল্টে দিয়ে গর্ভপাতের কোনও সাংবিধানিক অধিকার নেই বলে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এ এমনই এক ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত, যা প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।

Advertisement

আমেরিকার রাজ্যগুলি অবশ্য করতে পারবে তাদের নিজেদের মতো আইন। এবং মোটামুটি আধাআধি রাজ্যে, রিপাবলিকানরা যেখানে শাসন ক্ষমতায়, আইন করেই আটকানো হবে গর্ভপাত, এ একেবারে নিশ্চিত। কোনও রাজ্যে ভবিষ্যতে শাসন-ক্ষমতায় রাজনৈতিক পরিবর্তন হলে বদলে যেতে পারে সে রাজ্যের মেয়েদের গর্ভপাত সংক্রান্ত অধিকারও। মার্চ মাসে করা পিউ রিসার্চের সমীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকার ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের ৮০% আর রিপাবলিকান জনতার মাত্র ৩৮% গর্ভপাতের পক্ষে। আসলে এই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মানসিকতা, সামাজিক পরিস্থিতি, ধর্মবিশ্বাস, কলেজশিক্ষিতের অনুপাত, ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদির বিন্যাসে অনেকখানি তফাত। আর রাজনৈতিক দলগুলি তো চাইবেই প্রধানত নিজেদের সমর্থকদের খুশি করতে। পিউ রিসার্চের সমীক্ষামতে, আমেরিকার ৬১% মানুষ মনে করছেন গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হওয়া উচিত। তাতে অবশ্য কিছুই আসে যায় না। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবর্তন তো আর গণভোটের মাধ্যমে হচ্ছে না।

আয়ারল্যান্ডের কথায় বলতে হয়, কিছু দিন আগেও সে দেশ ছিল এক অচলায়তন। সমাজের উপর ক্যাথলিক চার্চের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণের রশি ছিঁড়ে ফেলতে স্পষ্টতই উদ্‌গ্রীব হয়ে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ আইরিশ জনতা। অচলায়তনের অর্গল খোলার সেই তাড়নাটা বাড়ছিল একটু একটু করে। তার পর গত তিন দশকে উল্কার গতিতে আধুনিক-মনস্কতার দিকে ছুটেছে আয়ারল্যান্ড। ১৯৯৩-তে সমকামকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেয় তারা। তার ২৪ বছরের মধ্যেই সে দেশে এসেছেন এক সমকামী প্রধানমন্ত্রী। স্থবির আইরিশ সমাজের এই জাগরণে নিশ্চয়ই যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে তাদের আইনগত ভাবে বাধ্যতামূলক গণভোটের ব্যবস্থা। ১৯৯৫-তে গণভোটে বিবাহবিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দেয় আয়ারল্যান্ড, ২০১৫-তে গণভোটেই আইনসিদ্ধ হয় সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে। আর ২০১৮-তে আর এক ঐতিহাসিক গণভোটে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আইরিশ জনতা ভোট দিয়ে বৈধ করেছে গর্ভপাতকে। এর সঙ্গে আবার জুড়ে রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দাঁতের ডাক্তার সবিতা হলপ্পনবার-এর নাম। ২০১২-তে সুস্থ ভাবে সন্তান জন্মানোর আশা না থাকলেও গর্ভপাতের অনুমতি পাননি সবিতা। সবিতার মৃত্যুর অভিঘাত আইরিশ গর্ভপাত আন্দোলনকে প্রবলতর করেছে নিশ্চয়ই, তবে আয়ারল্যান্ডের এই বিপ্লবটার মূল যাজ্ঞিক এক আইরিশ-আমেরিকান তরুণী, নাম আমান্দা মেলে। ২১তম সপ্তাহে ‘এডওয়ার্ডস সিনড্রোম’ ধরা পড়ে আমান্দা মেলে-র অজাত সন্তানের, যার মৃত্যু অনিবার্য। তবু আয়ারল্যান্ডের আইন অনুসারে মুমূর্ষু ভ্রূণকে বয়ে নিয়ে চলতে বাধ্য হন আমান্দা, ইংল্যান্ডের লিভারপুলের হাসপাতালে এই অধ্যায়ের শেষ হওয়া পর্যন্ত। আমান্দা কিন্তু সহজে ছেড়ে দেন না। আয়ারল্যান্ড দেশটাকেই তিনি টেনে নিয়ে যান রাষ্ট্রপুঞ্জে, চান বিচার। ২০১৬-তে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিটি মেলের প্রতি আয়ারল্যান্ডের আচরণকে বলে নিষ্ঠুর, অমানবিক। রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশে আমান্দাকে ৩০,০০০ ইউরো ক্ষতিপূরণও দেয় আয়ারল্যান্ড। আইরিশ সরকারকে আইন বদলাতেও বলে রাষ্ট্রপুঞ্জ।

গণভোটের আগে প্রতি দিন গড়ে ন’জন আইরিশ মহিলা যেতেন প্রতিবেশী ব্রিটেনে, গর্ভপাতের জন্য। ২০১৮-র গণভোটের ফলে আর এর প্রয়োজন রইল না। এ বার আমেরিকাতেও নিজ রাজ্যে গর্ভপাত সম্ভব না হলে সম্পন্নরা হয়তো পাড়ি দেবেন অন্য রাজ্যে, যেখানে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ। আসলে জো বাইডেন যতই প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, ডেমোক্র্যাটরা যতই শাসন করুন দেশটা, এখনও আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালীর নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান ভাবধারা এখনও সে সমাজকে জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের নয় জন বিচারক, যাঁদের কার্যকালের মেয়াদ আমৃত্যু, নিযুক্ত হন সরাসরি প্রেসিডেন্টের দ্বারাই। এই মুহূর্তে সেখানে রয়েছেন ৬ জন ‘রিপাবলিকান’ বিচারক, যাঁদের ৩ জন ট্রাম্প-নিযুক্ত। সেখানে এক বিচারককে রাজনৈতিক পরিচয়ে দাগিয়ে দিতেই সমাজ অভ্যস্ত, কোন প্রেসিডেন্টের আমলে তাঁর নিয়োগ হয়েছে সেই অনুসারে। বিচারকরাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আনুগত্য দেখান তাঁদের নিয়োগকারী প্রেসিডেন্ট এবং দলের উপরে। ‘রো বনাম ওয়েড’-কে উল্টে দিলেন যে পাঁচ জন বিচারক, তাঁরাও তাই।

তা হলে কি সমাজ সংস্কারের জন্য গণভোটই সঠিক পদ্ধতি? ওই আয়ারল্যান্ডের স্টাইলে? সমকালীন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন সেখানেই সম্ভব। কিন্তু জনগণ যে সর্বদা সঠিক পথের দিশারি হবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? গণভোট যে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণের শ্রেষ্ঠ উপায় নয়, ‘ব্রেক্সিট’ তার সাক্ষ্য দেবে। আচ্ছা, গণভোটে স্থির হলে কি সতীদাহ নিষিদ্ধ হতে পারত সে সময়ে? সাধারণ জনগণের কি যথোপযুক্ত দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা, এবং পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সাহস থাকা সম্ভব? আর সে কারণেই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নীতি-নির্ধারণে প্রয়োজন বিশেষ কিছু মানুষের প্রজ্ঞার আশ্রয়। সেটা আইনসভার মাধ্যমে হতে পারে, হতে পারে বিচারসভার মাধ্যমে।

কিন্তু সমস্যা হয় যখন এই বিচারসভা রাজনীতির প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিচারকদের প্রজ্ঞাকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং আনুগত্য। অথচ, বিষয়টা যে সব সময় এমনই ছিল, তা কিন্তু নয়। ১৯৭৩ সালে ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলায় গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করা হয়, সে সময়েও সুপ্রিম কোর্টে ছিলেন ৬ জন ‘রিপাবলিকান’ আর ৩ জন ‘ডেমোক্র্যাট’ বিচারক। সেই মামলায় মোট ৭ জন বিচারক রায় দেন গর্ভপাতের পক্ষে: রিপাবলিকান ৫ জন, ২ জন ডেমোক্র্যাট। যে ২ বিচারক বিপক্ষে রায় দেন তাঁদের এক জন রিপাবলিকান, এক জন ডেমোক্র্যাট। সেই রায়কে রাজনৈতিক ভাবে পক্ষপাতশূন্য বলা চলে। আর আধ শতক পরে সেটা রাজনীতির চাটুতে সেঁকা।

তর্কটা তাই জারি থাকে। সমাজের প্রবল টানাপড়েনে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণের দায়ভার থাকা উচিত কার হাতে? জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪-র মতোই আজ অ্যাটউডের হ্যান্ডমেড-কেও যেন এক অনিবার্য ভবিষ্যদ্বাণী মনে হয়।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আরও পড়ুন
Advertisement