Society

চেনা স্বাদ হারিয়ে যাচ্ছে কি

কালম্যানের জয় রোজ সকালে তাঁর দোকানের গণেশঠাকুরকে ধূপটুপ দিয়ে কাজ শুরু করতেন। তার পর বাকি দিনটা কেটে যেত পর্ক, বিফ, ডাক, টার্কির মাংস কাটাকুটি, খোঁচাখুঁচি বা বিশেষ কসরতে মশলাজলে কিয়োর করে।

Advertisement
ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৪১
কালম্যানের মাংস সম্ভারের টুকিটাকি আজও মেলে বিক্ষিপ্ত ভাবে।

কালম্যানের মাংস সম্ভারের টুকিটাকি আজও মেলে বিক্ষিপ্ত ভাবে। —ফাইল চিত্র।

বছরশেষের দিনগুলোয় অবধারিত জয় ঘোষের কথা মনে পড়ে। কলকাতার রংচঙে বর্ষশেষে বেখাপ্পা ফ্যাকাসে প্যান্ট-জামায় ক্লান্ত উত্তর-পঞ্চাশ তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের খুপরি দোকানে ভর সন্ধেয় খদ্দেরনারায়ণের আবদার মেটাতেন। যাঁর যেমন পছন্দ মাংসের ভাগ বা পার্বণী রোস্ট হাসিমুখে গুছিয়ে দিতে সদা ব্যস্ত। জয়ের দোকানটি বন্ধ আজ বছর পাঁচেক। তাতে খুব বেশি কারও কিচ্ছু যায় আসেনি। তবু কালম্যান মিট শপের যবনিকাপাতে কলকাতা তথা ভারতের একটি পরম্পরার বিপন্নতাও স্পষ্ট হয়েছিল। নানা ঘটনায় যা আজ জাঁকিয়ে বসেছে।

Advertisement

কালম্যানের জয় রোজ সকালে তাঁর দোকানের গণেশঠাকুরকে ধূপটুপ দিয়ে কাজ শুরু করতেন। তার পর বাকি দিনটা কেটে যেত পর্ক, বিফ, ডাক, টার্কির মাংস কাটাকুটি, খোঁচাখুঁচি বা বিশেষ কসরতে মশলাজলে কিয়োর করে। কলকাতার খুব ছোট ছোট গোষ্ঠীর মানুষ— ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেও অকিঞ্চিৎকর— অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, বাঙালি খ্রিস্টান বা কলকাতার চিনা, পার্সি, গোয়ানদের কেউ পরবের দিনে সেই দোকানের সল্ট মিট, মিটলোফ, লঙ্কাখচিত ঝাল-ঝাল বিফ কলার, টকটকে হাঙ্গেরিয়ান সসেজের অপেক্ষায় থাকতেন। নানা ধরনের খাবার নিয়ে ছুতমার্গহীন যে কোনও রসিক খাইয়েই কালম্যানের ভক্ত। একই সঙ্গে বিফ, পর্ক নিয়ে কাজ করবেন এমন কারিগর নাকি খুঁজে পেতে মুশকিল হচ্ছিল, তাই সে দোকান ঝাঁপ ফেলে দিল।

কালম্যানের মাংস সম্ভারের টুকিটাকি আজও মেলে বিক্ষিপ্ত ভাবে। বরং বিশ্বায়নের দিনে পাঁচতারা বা ফাইন ডাইনিং রেস্তরাঁয় বিদেশ থেকে আমদানি উৎকৃষ্টতর মাংসও এখন সহজলভ্য। ঠান্ডা মাংসের রকমারি আঙ্গিকের সর্বভারতীয় নানা সংস্থাও চলে এসেছে চার পাশে। কিন্তু এক ছাদের নীচে গেরস্তপোষ্য দামে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব গোষ্ঠীর জন্য কিছু-মিছুর সংস্থান রাখা একটি বিপণি আজ ভূভারতেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে খুঁজতে হয়।

এই না-থাকার শোক এ মরসুমে ফের উথলে উঠল পার্ক স্ট্রিটে ক্রিসমাস ফেস্টিভ্যালে গিয়ে। তৃণমূল জমানায় শুরু হওয়া এই উৎসব ক্রমশ কলকাতা বা বাংলার কসমোপলিটানিজ়ম বা সাতরঙা সংস্কৃতি উদ্‌যাপন মঞ্চ হয়ে ওঠে, যার একটি প্রধান আঙ্গিক ভোজ-বিলাস। রসিকজন অনেকেই এখানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, চিনা ভারতীয় বা গোয়ান বৌদি-দাদাদের রান্না সুখাদ্যের অপেক্ষা করেন। সে সব খাবারে বিফ, পর্কের উপস্থিতিও স্বাভাবিক। এ বার দেখা গেল বো ব্যারাকের জর্জিনা দেশাই কিংবা পিকনিক গার্ডেনের ক্লারা ডেভিড, ব্রেন্ডা ডি’সিলভা বা দমদমের অনিতা মেরি দাসেরা পর পর চিকেন ভিন্দালু, চিকেন কোপ্তা কারি, চিকেনেরই প্যান্ত্রাস কিংবা চিকেন কিমা ঠাসা আলু চপের পসরা সাজিয়েছেন। গৃহিণীরা হাসাহাসিও করছেন, চিকেনের কিছু বিকল্প নিশ্চয়ই রাখা যায়, তবে যে কোনও খাদ্য ঘরানার একটা ণত্ব-ষত্ব তো থাকে! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খানা কি আদৌ পর্ক, বিফ ছাড়া চলে?

কিন্তু আয়োজকদের কড়া নিষেধ, এই সরকারি ক্রিসমাসে সে-সবের নামগন্ধ করা যাবে না। খাবার একান্তই আপরুচি, তা আমরা জানি— কিছু খাওয়া বা না-খাওয়ার মধ্যে গৌরব বা লজ্জার প্রশ্নও নেই। তর্কও জোড়া যায়, বাংলায় অন্য কয়েকটি রাজ্যের মতো নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ সন্দেহে কারও জীবন বিপন্ন হচ্ছে কি? গৈরিক আবেগে এখানে কোথাও প্রকাশ্যে মাংস-ডিম বিক্রি নিয়ে নিষেধাজ্ঞারও প্রশ্ন নেই। তবু ছোট ছোট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস বা খাদ্য সংস্কৃতি মূল স্রোতের সামনে মেলে ধরায় এক ধরনের লজ্জা বা কুণ্ঠা যেন এ রাজ্যেও ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে। সরকারি বড়দিন উৎসব থেকে পর্ক, বিফের নির্বাসনে সেই মানসিকতারই প্রতিফলন।

মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশে এক সঙ্গে বসে খানপানের ঐতিহ্য খুব পুরনো নয়। ১০০ বছর আগে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সময়ে গান্ধী এবং আলি ভাইরাও খাওয়ার বেলায় নিভৃত পরিসরে সরে যেতেন। নিজেদের এই উদ্ভট জড়তা নিয়ে গান্ধী তাঁর লেখায় রসিকতাও করেছেন। এক সঙ্গে খাওয়ার গুরুত্ব আজও কম নয়। ভোটের হাওয়ায় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বাংলার দলিত, আদিবাসী গৃহে নিয়ম করে খাদ্য গ্রহণ করেন। অবশ্যই দলিত, আদিবাসীর নিজস্ব খাবার নয়— মন্ত্রীর রুচিমাফিক, কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহায়তায় কিছু বিশেষ আয়োজনও করতে হয়। তাতে এক ধরনের মেকিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে। তবে মালুম হয়, জাতপাতে দীর্ণ এ দেশে নানা ধরনের লোকের পাশাপাশি বসে এক হেঁশেলের নানা রকম পছন্দসই খাবার খাওয়ার পরিসর গড়ে ওঠাও এক সামাজিক উত্তরণের চিহ্ন বটে।

জনপ্রিয় বইয়ের দোকান, কাফে বা পানশালা একটি শহরের পরিচয়ও হয়ে ওঠে। মালিকানার হাতবদল বা পরিকাঠামোগত সমস্যায় কলকাতার কিছু সাবেক পানশালা, চিনে রেস্তরাঁ ক্রমশ তাদের নিজস্ব চরিত্র হারাচ্ছে। তাঁর ‘প্রাণভ্রমরা’ বেঙ্গালুরুর কোশিজ় প্যারেড কাফের গল্প অনেক লিখেছেন রামচন্দ্র গুহ। সেখানে দেখেছি, সামান্য হ্যাম স্যান্ডউইচ বা টোস্টে মাশরুমের সঙ্গে বিয়ার, কফি নিয়ে কয়েক ঘণ্টা কাটানো সম্ভব। বড়দিনে বা রবিবার সকালে আগ্রহী ক্রেতাদের জন্য বিশেষ বিফ পদও কাফের আকর্ষণ। ঘোর আমিষাশী থেকে ভিগান, কেউ সেখানে ব্রাত্য নন। যুগের রাজনীতিতে আমরা পরস্পরের থেকে আলাদা হচ্ছি। সবাইকে কাছে টানা পরিসরগুলিও বিরলতর হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement