অন্যের বেদনার বিষয়ে নীরবতাও কিন্তু এক রকমের নৃশংসতা
Violence

সমানুভূতির সন্ধানে

এই ক্রমাগত উত্তেজক হিংসা এক সময় আমাদের ‘ক্লান্ত, ক্লান্ত করে’। তখন আমরা ‘ক্ষান্তি’ চাই, নৃশংসতার উপরে উঠে ‘শান্তি’ চাই।

Advertisement
শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২২ ০৪:৩৭

সক্রেটিস কি প্রাচীন এথেন্সের নগর-রাষ্ট্রিক জীবনে সমন্বিত ন্যায় প্রতিষ্ঠার (দার্শনিক) প্রয়াসী হতেন, যদি এথেন্স বনাম স্পার্টার নেতৃত্বাধীন দুই পক্ষের মধ্যে সুদীর্ঘ সময় ধরে পেলোপনেশিয়ার যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-৪০৪) না হত? কলিঙ্গ যুদ্ধে, আড়াই লক্ষ মানুষের রক্তে যদি ধৌলিগিরির পার্শ্ববর্তী ‘দয়া’ নদীর জল রক্তিম না হত, তবে কি সম্রাট অশোক ‘চণ্ডাশোক’ থেকে ‘ধর্মাশোক’-এ রূপান্তরিত হয়ে সুবিশাল সাম্রাজ্যের নানা স্থানে শিলাদেশ-এ প্রজাদের সন্তানতুল্য ঘোষণা করে আঞ্চলিক শাসনকর্তাদের ক্রোধ-রহিত হয়ে, সুবেদী হয়ে সকলকে সুবিচার প্রদান করতে আদেশ দিয়ে ‘দেবনামপ্রিয়’ হয়ে উঠতে পারতেন? টি এস এলিয়ট রচিত বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী আধুনিক কবিতা ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কি আদৌ সম্ভব হত, যদি না প্রেক্ষাপটে থাকত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী ভয়াবহতা?

আজ যখন যুদ্ধ করে, না করেও বা, সমাজজীবনের প্রাত্যহিকতায় আমরা ভিন্নতাকে, অপরত্বকে বৈরীজ্ঞানে সন্দেহ করছি, তাকে ঘৃণার আগুনে দগ্ধ করছি, নৃশংস রিরংসায় গরিষ্ঠতার দাপটে করতালি দিচ্ছি, তখন কি ভাবছি, এই আগুনে আসলে আমরাও পুড়ছি, কেননা নৃশংসতা নৃশংসতাকে, হিংসা হিংসাকে, যুদ্ধ যুদ্ধকে দমন করতে পারে না, বরং তার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে, প্রত্যেক বড় যুদ্ধের আগেই শুনি সেই ছদ্ম লক্ষ্যের কথা: ‘ভবিষ্যতের সব যুদ্ধ বন্ধ করতে এই যুদ্ধের প্রয়োজন’। তবু যুদ্ধ বন্ধ হয় না, যুদ্ধ বেড়ে চলে এবং ছেয়ে ফেলে আমাদের ব্যক্তিক ও সামাজিক অস্তিত্বের সব দিক। তখন যুদ্ধক্ষেত্রের নৃশংসতা ধাবিত হয় সমাজ ক্ষেত্রে, আমাদের ব্যক্তিগত ধমনীতেও। ফলে, কোনও কারণ ছাড়াই আমেরিকার যুদ্ধফেরত সৈনিক বা বন্দুকবাজ কিশোর নির্বিচারে স্কুলের শিশু বা নাগরিকদের চোখের পলকে মেরে ফেলে। এ দেশেও সে-হাওয়া লাগতে শুরু করেছে।

Advertisement

এই ক্রমাগত উত্তেজক হিংসা এক সময় আমাদের ‘ক্লান্ত, ক্লান্ত করে’। তখন আমরা ‘ক্ষান্তি’ চাই, নৃশংসতার উপরে উঠে ‘শান্তি’ চাই। তাই, যদিও প্রাথমিক পাঠে মনে হতে পারে, মহাভারত-এর প্রথম পাঁচটি পর্ব রচিত হয়েছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পাঁচটি পর্বের জন্য, যখন দ্বাদশ পর্বে (শান্তিপর্বে) প্রবেশ করি, বুঝতে শুরু করি এই সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী হিংসা ও নৃশংসতা বিবরণের আয়োজন আসলে যুদ্ধধ্বস্ত ভারতকে ক্ষান্তি ও শান্তির কথা শোনাতে, নৃশংসতার বিরুদ্ধে ‘আনৃশংস্য’ হয়ে ওঠার কথা বলতে। এ সব স-তর্ক বাণী দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী তাঁর নানা রচনায় শুনিয়ে আসছিলেন অনেক দিন ধরে। তারই আরও সম্প্রসারিত উপস্থাপন করলেন সাম্প্রতিক এক বক্তৃতা-সন্ধ্যায়, বহু বিদগ্ধজনের সামনে। মহাভারত থেকে উপনিষদ, রবীন্দ্রনাথ থেকে গান্ধী, ফ্রয়েড থেকে জার্মান মনঃসমীক্ষক এরিক ফ্রম— ছুঁয়ে গেলেন নৃশংসতা-বিরোধী ভারতীয় শাস্ত্রের ‘দয়ধ্বম্’ ধারণাটির নিরিখে।

অনেকে যদি দেশীয় শাস্ত্র, পুরাণ ততটা মনোযোগে না পড়েও থাকেন, তবুও বজ্রনাদে শোনা ব্রহ্মার বাণী— ‘দ-দ-দ’-র মর্মবাণী, ভুবনবিখ্যাত এলিয়টি কাব্যের শেষ অংশের কল্যাণে (‘হোয়াট দ্য থান্ডার সেড’), ‘দত্ত-দয়ধ্বম্-দাম্যত’ এই ত্রয়ীর কথা শুনেছেন অবশ্যই। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী লন্ডন শহরের ‘নষ্ট ভূমি’-তে দাঁড়িয়েও নৈতিক জীবন যাপনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় সেই ত্রয়ীর অন্যতম— দয়ধ্বম্-কে যদি কামনাশূন্য সহমর্মিতা ভাবি, তবে আধুনিক মনঃসমীক্ষার এক সুপরিচিত উদ্গাতা, এরিক ফ্রম-এর (১৯০০-১৯৮০) কথাও মনে পড়ে যেতে পারে। জার্মান ইহুদি পরিবার সঞ্জাত ও পরবর্তী কালে জার্মান মার্ক্সবাদী ভাবুকদের গোষ্ঠী ‘ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুল’-এর এই সদস্যটি গোড়ায় ফ্রয়েড দ্বারা অনুপ্রাণিত থাকলেও, পরে বুঝতে পারেন ব্যক্তিকে তার সামগ্রিক সত্তা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনুধাবন না করলে তার যথাযথ মনঃসমীক্ষা ও চিকিৎসা সম্ভব নয়। ফ্রম-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এসকেপ ফ্রম ফ্রিডম। পরে প্রকাশিত হয় অতি জনপ্রিয় দি আর্ট অব লাভিং। তারও অনেক পর প্রকাশিত দি আর্ট অব লিসনিং-এ তিনি বলেছেন মনঃসমীক্ষকদের জন্য একান্ত কাঙ্ক্ষিত গুণ ‘এমপ্যাথি’র কথা, যার সঙ্গে দয়ধ্বম্-এর একটা সংযোগ আছে।

এই যে এমপ্যাথি বা সমানুভূতি— এ কেবল ‘আহা-উহু’ সহানুভূতি জানানো নয়, তার কষ্টের গভীরতা ও চরিত্র উপলব্ধি করে স্বার্থশূন্য ভাবে সমমর্মী হওয়া। সমানুভূতি হল অন্যের পীড়ায় কাতরতা, যার উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্ঠুরতা। নিষ্ঠুরতার প্রতি প্রবৃত্তিগত ঝোঁক থাকে মানুষের। যদিও আধুনিক পশ্চিমি সভ্যতা নানা উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশের মধ্যে স্বার্থান্ধ প্রতিযোগিতার যে বীজ বপন করেছে, তার ফলেই আগেকার স্থানিক সংঘাত ক্রমশ বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে, তবুও এই হিংসার প্রবৃত্তি কেবল পশ্চিমের দান নয়। সব দেশেই, এ দেশেও, তার মূল গভীর-প্রসারী: মহাভারত থেকে সম্রাট অশোক অবধি উদাহরণগুলিতেই তা স্পষ্ট।

প্রসঙ্গত ওঠে মহাভারতের মহাবলশালী ভীমচন্দ্রের কথা। বৃকোদর আখ্যায়িত ভীমের বাল্যকালের নানা কাজকর্ম আমাদের মনে নির্ভেজাল কৌতুক উৎপন্ন করে। প্রয়াত শাঁওলী মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ নাটকের দ্রৌপদীও ভীমকে অন্য সব স্বামীর চেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রেমিক মনে করেছেন। কিন্তু তা বলে, কেবল শপথ করেছিলেন বলে, যে ভাবে তিনি যুদ্ধের শেষে দুঃশাসনের বুক চিরে কবোষ্ণ রুধির আঁজলা ভরে পান করেছেন এবং সেই দৃশ্য যে ভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী কাব্যে-নাট্যে, ‘পাণ্ডবানী’র মতো সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা ইত্যাদিতে পুনর্নির্মিত হয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে, তাকে নৃশংসতা এবং তার পুনর্নির্মাণ ছাড়া কী বা বলা যায়? এর বিপরীতে যুধিষ্ঠিরকে নেহাত নির্বিরোধী এবং বাহ্যত জুয়ার প্রতি দুর্বল, ফলত ফ্যাকাশে লাগতে পারে, কিন্তু— বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের মতো অরিন্দমের চোখেও— তিনিই মহাভারতের আসল নায়ক, যিনি সব সময় অতি সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণ ভাবে বিভক্ত ন্যায়ের পথ অনুসরণ করতে গিয়ে বার বার সংশয়ে ভুগেছেন, একটার পর একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন।

এই সংশয় ও দ্বিধাই কিন্তু এক জন নৈতিক মানুষের পরিচয়, যিনি চালিত হন জিঘাংসার দ্বারা নয়, সমানুভূতির দ্বারা। তিনিই চেষ্টা করতে পারেন ‘আনৃশংস্য’ হয়ে ওঠার। দয়া, সমবেদনা, সহ-ক্রন্দনের দ্বারা, আত্মধর্মের সমালোচনা ও পরধর্মের নিন্দা না করে আমরা এই চরিত্রে উন্নীত হতে পারি। অন্যের বেদনার বিষয়ে নীরবতাও এক ধরনের নৃশংসতা। যদিও বাস্তবে দেখি কোনও এক পক্ষের নৃশংসতার বদলা নিতে অনেক ধর্মীয় পরম্পরায় প্রবাহিত হচ্ছে ‘দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ’-এর অনুমোদন। প্রশ্ন ওঠে, এক জন চরম নৃশংস ব্যক্তিকে (ধরা যাক, হিটলারকে) কত বার ‘হত্যা’ করবেন? এক বার, দশ বার, হাজার বার? এক বার ‘মারলেই’ তো সে ‘মরে’ গেল! মরা-কে কত বার মারবেন?

এই প্রসঙ্গেই ‘সক্ষমতা’ বা ‘সক্ষম’ হওয়া (যা, ইংরেজি ‘কেপেবিলিটি’ অর্থে, অমর্ত্য সেনের কল্যাণে জনপ্রিয়) কথাটি নিয়ে নতুন করে ভাববার অবকাশ আছে। সক্ষমতা-র মধ্যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ‘ক্ষমতাবান’ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত আছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে তার মধ্যে ‘ক্ষমা’ করার গুণও ব্যক্ত রয়েছে। এই পরিবর্তিত পাঠে সক্ষম কথাটি— স+ক্ষম অর্থাৎ ‘ক্ষমার সঙ্গে’ও বোঝায়। এই কারণেই গান্ধীজি ‘ক্ষমা’ করার গুণকে ‘সবলের গুণ’ বলেন, কারণ, দুর্বল কখনও ক্ষমা করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথও বার বার ক্ষমা-র কথা, কঠিন ন্যায়বিধানের সময়েও সমানুভূতি রাখার কথা বলেন (“প্রভু, দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার”)।

তা হলে, ‘আনৃশংস্য’ ও ‘সমানুভূতি’সম্পন্ন হব কী করে? এখানে অরিন্দম ফ্রয়েড বর্ণিত দুই বিপরীত-যুগ্ম— রমণেচ্ছু জীবন (‘ইরস’) ও মরণ (থানাটস)— এই দুই প্রবৃত্তিকে ‘রমণ’ ও ‘মরণ’ বলে আখ্যা দিয়ে, এই অক্ষরগুলিকে খানিক এ দিক ও দিক করে আর একটি প্রবৃত্তি—‘নরম’ হওয়ার কথা বলছেন। এই নরম হওয়ার দিকে এগোলে, ফ্রয়েড-কথিত দ্বিমাত্রিক প্রবৃত্তির কারাগার থেকে হয়তো আমরা মুক্তি পেতে পারি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement