Violence

নৃশংসতাকে স্বীকার করে নিচ্ছি

সে সমাজের ‘প্রতিফলন’ দেখাবার মতো কোনও ওয়েব সিরিজ় অবশ্য থাকবে না। কারণ সে দিন সিরিজ় বানানোরও প্রয়োজন থাকবে না।

Advertisement
অভিষেক বসু
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২২ ০৫:১২
নৃশংসতা।

নৃশংসতা।

তথাকথিত নায়কের চেয়ে হয়তো অন্য চরিত্রেরা বেশি আকর্ষণীয়। আদর্শ, নীতি, মহত্ত্ব ইত্যাদি বজায় রাখতে গিয়ে নায়কেরা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই একমেটে, আলুনি হয়ে দাঁড়ায়। আর পৃথিবীর ভালমন্দ মেশানো ধূসর বাস্তবতাকে ঠিক সাদায় কালোয় চুলচেরা ভাগ করাও তো যায় না। পথের পাঁচালী-র শিশু অপুর যেমন, অনেকেরই সহানুভূতি তেমন মেঘনাদ বা কর্ণের প্রতি। ইউরোপীয় সাহিত্যেও ডন কিহোতে বা পিকারেস্ক জাতীয় বহু নভেলের মধ্যে ভবঘুরে, ছিটেল, খুচরো অপরাধী চরিত্রেরা গুরুত্ব পেয়েছে। অনেক আগে থেকেই এদের নাম অ্যান্টিহিরো। অর্থাৎ কিনা হিরোদের যা করবার কথা, এরা তার উল্টোটাই করে।

তাই বলে অ্যান্টিহিরোরা ভিলেন নয়। এক অর্থে প্রোটাগনিস্ট বা কেন্দ্রীয় চরিত্র। অমিতাভ বচ্চনের সেই ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ পর্যায়ের ফিল্মের কথা মনে করলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। সামাজিক রাজনৈতিক নানা রকম অসাধুতা আর অসাম্যের মোকাবিলা করতে চরিত্রকে এমন পথ নিতে হচ্ছে যাকে নিষ্ঠুর বা অন্যায় বলে মনে হতে পারে— অথচ সেই পথেই অ্যান্টিহিরোরা দুষ্টদের দমন ও শিষ্টের পালন করে থাকে। মূলধারার হিন্দি ছবিতে অবশ্য অ্যান্টিহিরো এবং হিরো সেই কবেই মিলেজুলে গিয়েছে। আর সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন ফিল্ম আর ওয়েব সিরিজ়ে তো নৃশংসতা আর গালাগালির ছড়াছড়ি। যে ধরনের জাতি বা নারীবিদ্বেষী কথা আগে লোকে ব্যক্তিগত আলোচনাতেও বলতে দু’বার ভাবত— আজকাল ফিল্মের সংলাপে বা টিভি চ্যানেলের বিতর্কে বেমালুম বলে দেওয়া যায়। উৎসাহী দর্শকও পাওয়া যায়।

Advertisement

এর মধ্যে কি আমাদের নিজস্ব ঘৃণা আর নৃশংসতার ইচ্ছাপূরণ হয়? এ প্রশ্নের কোনও ফর্মুলা উত্তর নেই। এক দিকে, রত্নাকরের বাল্মীকিতে উত্তরণের গল্প। যেমনটা খুঁজে পাওয়া যায় চোর এবং যৌনকর্মী থেকে জঁ জেনের ক্রমে লেখক ও সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী হয়ে ওঠার আখ্যানে। এক দিকে যদি রূপান্তর, তবে অন্য দিকে সেই অ্যান্টিহিরোরা কিন্তু সামাজিক রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কাঠামো নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে দিত। যেমন, ডন কিহোতে কাল্পনিক রোম্যান্সের দুনিয়ায় বাস করতে গিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল উইন্ডমিলের সঙ্গে, সরাইখানার যৌনকর্মীকে ভেবে বসল ‘ড্যামসেল-ইন-ডিসট্রেস’— আর এই প্রক্রিয়া সমাজের ও সাহিত্যের নিরর্থকতা উন্মোচিত করে দিল। এই জিনিসটি আজকের অ্যান্টিহিরোদের মধ্যে কতটা দেখা যায়— সেটাই প্রশ্ন। দেখা গেলেও সমস্যা মেটে না। নবারুণ ভট্টাচার্যের আখ্যানের অন্তর্কাঠামোর রাজনৈতিকতাকে বাদ দিয়ে আমরা তুলে নিতে চাই শুধু গালাগালের চটকদার উদ্ধৃতি। গ্যাংস অব ওয়াসেপুর-পরবর্তী ভারতীয় ফিল্মে বা সিরিজ়ে অপরাধ-কেন্দ্রিকতার যে জোয়ার এসেছে, তার মধ্যে কি সেই ভাবে বৃহত্তর সমাজ-পরিবেশের কোনও সুলুকসন্ধান থাকে? রাজনৈতিক নেতা, মাফিয়া, পুলিশ-প্রশাসন, সন্ত্রাসবাদ, এই সবের যোগসাজশের যে গড়পড়তা ছক, তার বাইরে কি আমাদের নজর যায়? যে রকমের ধূসরতায় গডফাদার জাতীয় ছবির মধ্যে বলা হয়ে যায় অপরাধের সঙ্গে বাকি সমাজের দ্বন্দ্ব এবং সহাবস্থানের জটিল সম্পর্ক? তেমন কোনও গভীর অন্তর্দৃষ্টি কি আদৌ তৈরি হয়? না কি, কতটা অনুপুঙ্খে আর ভয়াবহ ভাবে নৃশংসতা দেখানো হল, গালিগালাজের তোড় কতটা, যৌনতার কথা বাদই থাক— সেই সবের উপরেই নির্ভর করে সমবেত প্রতিক্রিয়া? এমন সহজ সমীকরণ অনেকে করে থাকেন যে, মানুষ কেবলই হিংস্র হয়ে যাচ্ছে, আর তার প্রতিফলন পড়ছে আমাদের সাহিত্য আর অন্যান্য শিল্পে। প্রতিফলনের এই সরল তত্ত্বে খুব একটা ভরসা হয় না, কারণ চার পাশের সমস্ত মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছেন, এমনটা তো মনে হয় না।

আবার নৃশংসতার কারণ হিসেবে শুধুমাত্র ফিল্ম বা সিরিজ়কে, ভিডিয়ো গেমসকে দায়ী করার মধ্যেও এক ধরনের অতি-সরলীকরণ আছে। তলিয়ে দেখলে মনে হয়, নৃশংসতার এক ধরনের বাজার তৈরি হচ্ছে দুনিয়া জুড়ে। আর বাজার হচ্ছে মানে হিংসার এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছে।

আমাদের দেশে ধর্ষক বা খুনিদের সংবর্ধনা দেখে এই রকম কথাই মনে হয়। এর বিপজ্জনক দিক হল, আমি নৃশংসতাকে স্বীকার করে নিচ্ছি, তার প্রশংসা ও সমর্থন করছি, এবং এই প্রক্রিয়ায় এক দিন নিজের নৃশংস হয়ে ওঠার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছি। নিজের কাছে প্রথমে নৃশংসতার কিছু ‘কারণ’ থাকে, তা অন্যদের কাছে যতই কুযুক্তি মনে হোক না কেন, তবুও থাকে। যে ‘ওরা’ ওই রকম করে, সুতরাং ওদের ‘শিক্ষা’ দিতে হলে এই রকম নির্মমতাই প্রয়োজন! কালে কালে এমন দাঁড়ায় যে, কারণগুলি অবান্তর হয়ে যায়। তখন নৃশংসতা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে। হয়তো এক দিন এই গোঁজামিল দেওয়া ‘কারণ’-এরও আর দরকার হবে না। জাতপাত, ধর্মসম্প্রদায়, লিঙ্গপরিচয় নিয়ে নানা ধরনের নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতায় এমনই অভ্যস্ত হয়ে যাব যে, শুধু সেই ভাষাতেই কথা বলব। সে সমাজের ‘প্রতিফলন’ দেখাবার মতো কোনও ওয়েব সিরিজ় অবশ্য থাকবে না। কারণ সে দিন সিরিজ় বানানোরও প্রয়োজন থাকবে না।

তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement