ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত বদলের সঙ্গে বদলেছে রামকথাও
Ramayana

কল্পনাকথার পরম্পরা

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর সংজ্ঞায় কবিতা যেমন শক্তিশালী আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, বাল্মীকির শোকের অভিঘাতে সৃষ্ট রামায়ণ তেমনই মিলন-বিচ্ছেদের এক করুণরসের কাব্য।

Advertisement
কণাদ সিংহ
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৩ ০৪:৪৫
ramayana.

আজকের ভারতে রামায়ণ নিয়ে অতিসংবেদনশীলতা অচেনা নয়। —ফাইল চিত্র।

রামায়ণ-নির্ভর ছবি আদিপুরুষ মুক্তি পেল সদ্য। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির প্রাবল্য, প্রেক্ষাগৃহে হনুমানের জন্য আসনের ঘোষণাও শোনা গেছে রামভক্তদের হৃদয় জয়ের আশায়। আজকের ভারতে রামায়ণ নিয়ে অতিসংবেদনশীলতা অচেনা নয়। অথচ, এফ ই পার্জিটার ইতিহাস-পুরাণ পরম্পরার আলোচনায় মহাভারত বা পুরাণগুলির মতো গুরুত্ব রামায়ণকে দেননি। রামায়ণও নিজেকে মহাভারতের মতো ‘ইতিহাস’ বলে দাবি করেনি। সংস্কৃত পরম্পরায় তার প্রধান পরিচয় ‘আদিকাব্য’।

রামায়ণের শুরুতেই নারদের কাছে বহু গুণের এক বিস্তারিত তালিকা দিয়ে বাল্মীকি জানতে চান সে রকম মানুষের নাম। নারদ জানান, এত গুণের সমাহার দেবতাদেরও নেই, তবে রামের কথা লোকমুখে শোনা যায় (জনৈঃ শ্রুতঃ)। বাল্মীকিকে তিনি শোনান রামের কাহিনি। এর পর এক জোড়া মিলনরত ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর একটির নিষাদের হাতে মৃত্যু এবং অন্যটির কাতরতায় বিচলিত বাল্মীকি নিষাদকে অভিশাপ দেন ছন্দোবদ্ধ পদে। নিজ কবিপ্রতিভা উপলব্ধি করে রচনা করেন রামায়ণ, যা বাদ্যযন্ত্র-সহ পরিবেশন করেন তাঁর শিষ্যরা।

Advertisement

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর সংজ্ঞায় কবিতা যেমন শক্তিশালী আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, বাল্মীকির শোকের অভিঘাতে সৃষ্ট রামায়ণ তেমনই মিলন-বিচ্ছেদের এক করুণরসের কাব্য। এর নায়ক এক আদর্শ মানুষ, যিনি দেবদুর্লভ গুণাবলিসম্পন্ন, দেবতা নন। তাঁর কাহিনি বাল্মীকির উদ্ভাবন নয়, লোকমুখে প্রচলিত। বাল্মীকি রচিত কাব্যও প্রচারিত হয়েছে মৌখিক ভাবে, কলাকুশলীদের মাধ্যমে। এই পরিবেশকদের নাম যেমন কুশ ও লব, ‘কুশীলব’ তেমন প্রাচীন ভারতের কলাকুশলী-চারণকবিদের একটি গোষ্ঠীও। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র জানায়, যথেষ্ট আয় করতে না পারলে ডাকাতিতে লিপ্ত হওয়ার দুর্নাম ছিল নিম্নবর্গীয় কুশীলবদের। মধ্যযুগের সাহিত্যে বাল্মীকি প্রথম জীবনে ডাকাত ছিলেন বলে যে কাহিনি চালু, তার উৎস কি কুশীলব পরিচয়?

বাল্মীকি রামায়ণে সাতটি কাণ্ড। অনেক পণ্ডিতের মতে ‘অযোধ্যাকাণ্ড’ থেকে ‘যুদ্ধকাণ্ড’ প্রাচীনতম অংশ। এই আখ্যানের উদ্ভব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে। কোশল-বিদেহ অঞ্চল তখন উত্তর ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ‘বালকাণ্ড’-এর পৌরাণিক কাহিনি ও‌ ‘উত্তরকাণ্ড’ সংযোজিত হয়েছে পরে, যখন চারণকবিদের মৌখিক কাব্য লিখিত রূপ পেয়েছে ব্রাহ্মণদের হাতে। মৌর্য-পরবর্তী যুগে রচিত মনুস্মৃতি ও মহাভারতের ব্রাহ্মণায়িত শান্তিপর্বে যে ‘রাজধর্ম’-এর পরিচয় পাওয়া যায়, তারই মূর্ত রূপ যেন উত্তরকাণ্ডের ‘রামরাজ্য’। পাশাপাশি রাম হয়ে উঠেছেন বিষ্ণুর অবতার।

রামায়ণের গোড়ায় নারদের সংক্ষিপ্তসারেও ‘অযোধ্যাকাণ্ড’ থেকে ‘যুদ্ধকাণ্ড’ অবধি কাহিনিই বর্ণিত। মিলনে বিচ্ছেদ আনা নিষাদকে কবির অভিশাপ দিয়ে যে কাব্য শুরু, তা রাবণের মৃত্যু ও রাম-সীতার পুনর্মিলনে শেষ হওয়াই স্বাভাবিক। রামের সীতাকে পরিত্যাগ এবং সীতার পাতালপ্রবেশ এর মেজাজের সঙ্গে বেমানান। তা ছাড়া যে বাল্মীকি নারদের মুখ থেকে রামের কথা শুনেছিলেন, উত্তরকাণ্ডে তাঁর রামের পরিচিত ও সীতার আশ্রয়দাতা হিসাবে আবির্ভাবও অসঙ্গতিপূর্ণ। রামায়ণের কাহিনিকাঠামো বাঁধা রূপকথার ছকে: দুয়োরানির ছেলে সুয়োরানির ষড়যন্ত্রে বনে নির্বাসিত, রাক্ষসপুরীতে বন্দিনি রাজকন্যাকে উদ্ধার করে রাজ্যে ফেরেন। রাজ্য ও রাজকন্যা লাভেই গল্পের পরিণতি। ভবভূতি উত্তররামচরিত নাটকে ‘উত্তরকাণ্ড’-এর বিসদৃশতা তুলে ধরে লক্ষ্মণের মুখ দিয়ে বাল্মীকিকেই প্রশ্ন করেছেন, এই কি তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য? বাল্মীকিও অসঙ্গতি শুধরে রাম-সীতার মিলন ঘটান সেখানে। রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের মাত্রা’ ও ‘কাদম্বরীচিত্র’ প্রবন্ধের মতেও, সামাজিক প্রয়োজনে উত্তরকাণ্ডের ‘জোড়াতালি দেওয়া’ রামায়ণের সাহিত্যগুণকে নষ্টই করেছে। সুপ্রাচীন বৌদ্ধ রামকথা দশরথ জাতক, মহাভারতে বর্ণিত ‘রামোপাখ্যান’, ভাস-এর (আনুমানিক খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক) প্রতিমানাটকঅভিষেকনাটক— কোথাও নেই উত্তরকাণ্ডের কাহিনি। মৌর্য-পরবর্তী যুগে রচিত জৈন বিমলসূরির পউমচরিঅ-তে রামরাজ্য ও সীতাবিসর্জনের কাহিনি থাকলেও পরিণতি আলাদা। কালিদাসের রঘুবংশ-তে (খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক) অবশ্য উত্তরকাণ্ডের কাহিনি উপস্থিত। রামায়ণের ব্রাহ্মণায়ন ও উত্তরকাণ্ডের সংযোজন সম্ভবত মৌর্য-পরবর্তী যুগের ঘটনা। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে রূপ পেয়েছিল ‘সাতকাণ্ড রামায়ণ’।

রবার্ট গোল্ডম্যান, স্যালি গোল্ডম্যান, জন ব্রকিংটন-এর মতে বাল্মীকি রামায়ণ-ই রামকথার কেন্দ্রীয় গ্রন্থ। অন্য দিকে এ কে রামানুজন দেখান, তিনশো রকম রামকথা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ রামকথাকে চেনে এই বিভিন্ন রূপে। তবে পলা রিচম্যান ‘বহু রামায়ণ’ তত্ত্বের সমর্থক হয়েও স্বীকার করেন, সব রামকথার প্রভাব সমান নয়। বাল্মীকির রামায়ণ, তামিলে কম্পন-এর ইরামাবতারম, অওয়ধিতে রচিত তুলসীদাসের রামচরিতমানস ও হিন্দিতে নির্মিত রামানন্দ সাগরের সিরিয়ালের প্রভাব সর্বাধিক। এদের গুরুত্ব জনপ্রিয়তায়, ঐতিহাসিকতায় নয়। ১৯৭৫-৭৬’এ ব্রজবাসী লালের রামায়ণ প্রত্নতত্ত্ব প্রাচীন রামায়ণ কাহিনির সপক্ষে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পায়নি। অযোধ্যার প্রত্নতত্ত্বে মধ্যযুগের মসজিদের নীচে মন্দিরের অস্তিত্ব নিয়ে তরজাই মুখ্য। কিষ্কিন্ধ্যা, লঙ্কার ঐতিহাসিকতা আরও অনিশ্চিত। বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করেই বানর-দল যে ভাবে সমুদ্রতীরে পৌঁছয়, তাতে দাক্ষিণাত্যের ভূগোল সম্পর্কে বাল্মীকির অস্পষ্টতাই ধরা পড়ে। লঙ্কা সম্ভবত কবিকল্পনার ফসল।

রোমিলা থাপর অবশ্য দেখিয়েছেন, রামকথা ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর না হলেও ইতিহাস-সচেতন। রাম যেন ‘আদর্শ’ চরিত্রের ঐতিহাসিক প্রতীক। এই আদর্শ বদলেছে প্রত্যেক পরম্পরার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের বদলে। দশরথ জাতক-এর প্রেক্ষাপট পরিবারকেন্দ্রিক কৌমজীবন। বড় রানির সন্তানদের ছোট রানি বিষ খাইয়ে হত্যা করতে চাইলে অসহায় রাজা দশরথ বনে পালাতে বলেন তাঁর তিন সন্তান রামপণ্ডিত, লক্ষ্মণপণ্ডিত ও সীতাকে। বৌদ্ধ গণসঙ্ঘগুলির সৃষ্টিকাহিনির মতোই ভাই-বোনের বিবাহ এখানে স্বীকৃত। রাম এখানে শোকে অবিচলিত আদর্শ বোধিসত্ত্ব। বাল্মীকি রামায়ণে আবার কোশল-বিদেহে সংগঠিত কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। দশরথ, জনকের রাজত্বে রয়েছে কৃষিসভ্যতা, বেতনভুক প্রশাসন, স্থায়ী সেনা। দক্ষিণের আরণ্যক কৌমভিত্তিক গোষ্ঠীপতি রাবণের সহযোগী অবশ্য আত্মীয়রাই; ধর্মাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, যৌনতার ক্ষেত্রে সুসংহত রাষ্ট্রীয় সমাজের নিয়ম না মানা অরণ্যবাসীরা এখানে মনুষ্যেতর বানর বা রাক্ষস। নির্বাসিত রাম অরণ্যের বিপদসঙ্কুল জগতে রাক্ষস মেরে নিরাপত্তা দেন ঋষিদের, যৌন স্বেচ্ছাচারের শাস্তি দেন শূর্পণখা ও বালীকে, রাক্ষস ও বানর সিংহাসনে বসান বশংবদ বিভীষণ ও সুগ্রীবকে। যুদ্ধনীতি ভেঙে বালীকে হত্যা করে দাবি করেন, বালীর আপাত-স্বাধীন অরণ্যরাজ্যেও তিনি দণ্ডবিধানের অধিকারী। উত্তরকাণ্ডে রাম মনু-কথিত রাজধর্মের প্রতিভূ, বর্ণাশ্রম-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যে শূদ্র শম্বুকের ধর্মাচরণের ফল হয় মৃত্যুদণ্ড। সতীত্ব নিয়ে বিশুদ্ধবাদিতা মেনে সীতাকে নির্বাসন দেন রাম।

মৌর্য-পরবর্তী যুগে দাক্ষিণাত্যেও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রসার ঘটে। কলিঙ্গরাজ খারবেলের মতো রাজা হয়ে ওঠেন জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক। বাল্মীকি রামায়ণ-এর রাক্ষস-বানরদের চিত্রায়ণ জৈনদের পক্ষে মেনে নেওয়া ছিল কষ্টসাধ্য। বিমলসূরি জানান, রামের প্রকৃত বৃত্তান্ত হারিয়ে গেছে ‘মূর্খ কুকবি’র রচনায়, যেখানে রাবণের দশটি মাথা, কুম্ভকর্ণ ছ’মাস ঘুমোন, বানরেরা যুদ্ধ করে। অলৌকিকতাবর্জিত পউমচরিঅ-তে রাবণের জন্ম মেঘবাহন বংশে (যে বংশে জন্ম খারবেলেরও!)। রাম-রাবণের দ্বন্দ্ব সেখানে দুই মর্যাদাবান রাজপুরুষের দ্বন্দ্ব। আদর্শ জৈন রাম অহিংস। লক্ষ্মণের হাতে হয় রাবণবধ।

ভবভূতির প্রেমিক রাম, প্রেমে প্রতারিত চন্দ্রাবতীর বয়ানে এক নিষ্ঠুর, অসংবেদনশীল পুরুষ। তুলসীদাসের রাম হিন্দি বলয়ের সর্বোচ্চ ঈশ্বর, আবার কৃত্তিবাসের রাম প্রবর্তক বাঙালির শারদীয়া দুর্গোৎসবের। ইন্দোনেশিয়া, তাইল্যান্ডে তো বটেই, রাম আদর্শ রাজা মালয়েশিয়ার ইসলামি রামকথা হিকায়ত সেরী রাম-এও। একরৈখিক ঐতিহাসিকতার জায়গা কোথায় এই বহুমুখী সাহিত্য পরম্পরায়? বাল্মীকি রামায়ণের প্রারম্ভের ভাবানুবাদ রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায়, নারদের কাছে শোনা রামকথাকে কাব্যরূপ দিতে দ্বিধাগ্রস্ত বাল্মীকি প্রশ্ন তোলেন, শোনা কথার ভিত্তিতে ‘ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে’? নারদ স্মরণ করান সাহিত্যের সত্য: “সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।” বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তিন দশক পরে, অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি মন্দিরের উদ্বোধন আসন্ন। আমরা কি মনে রেখেছি বাল্মীকির মনোভূমির রামকে, যিনি সত্য রক্ষার্থে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন অযোধ্যার অধিকার?

আরও পড়ুন
Advertisement