Uniform Civil Code

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং

অবিভক্ত দেওয়ানি বিধির মূল বক্তব্য (যদি তেমনটি সরকার বাহাদুর যথার্থ বলে ভাবেন) হবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন আইনি অনুশাসন উপেক্ষা করে একই আইনের আওতায় সব নাগরিককে নিয়ে আসা।

Advertisement
সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪৭
UCC

—প্রতীকী ছবি।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পিছনে রাজনৈতিক যুক্তি, নির্বাচনী রণকৌশল বিলক্ষণ আছে, কিন্তু তার নিজস্ব বাস্তব দর্শন এবং যুক্তিও আছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে— গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক দেশের কর্তৃত্ব হাতে নিলেও তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করেনি। রাষ্ট্রীয় পরিসরে হিন্দুত্ববাদী আচারের সংখ্যা ও প্রাবল্য বেড়েছে। বিরোধী পক্ষের মোটামুটি সবাই, এবং দেশ-বিদেশের এক বড় অংশের মানুষজন এটা মেনে নিচ্ছেন না। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত আলোচনা, বিশেষ করে তাকে আইনানুগ করার প্রয়াস, নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

অবিভক্ত দেওয়ানি বিধির মূল বক্তব্য (যদি তেমনটি সরকার বাহাদুর যথার্থ বলে ভাবেন) হবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন আইনি অনুশাসন উপেক্ষা করে একই আইনের আওতায় সব নাগরিককে নিয়ে আসা। এই প্রক্রিয়া বা নীতি এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক দেশ, অন্তত খাতায়-কলমে এখনও তা-ই। বিধিটি কী ভাবে লিখিত হবে, সেখানে কী লেখা থাকবে বা থাকবে না, কেমন ভাবে সর্বসাধারণের জন্য ‘অভিন্ন’ করা হবে দেওয়ানি বিধি, সেগুলো পরের কথা। দেশের আইন সব নাগরিকের জন্য সমান। যে কোনও ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে সচেতন ভাবেই দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সবচেয়ে বড় মুকুটটিকে কিছুতেই ভূলুণ্ঠিত করা উচিত নয়। এই প্রশ্নটি নিয়ে অযথা বিবাদ-বিতর্ক বাঞ্ছনীয় নয়।

সব ধর্মই ব্যক্তিগত পরিসরে ঈশ্বরসাধনার ব্যাপার, রাষ্ট্রতন্ত্রের ব্যাপার নয়। যেমন সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুশাসনের কাছাকাছি থেকে ভোটের ব্যবসা অত্যন্ত নিন্দনীয়, তেমনই সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অস্তিত্বকে সর্বশক্তিমান ও মহান আখ্যা দিয়ে অন্য ধর্মের নাগরিকদের যন্ত্রণা দেওয়া ঘোর অন্যায়। আর যে-হেতু সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব অনেক বেশি হওয়া উচিত, তাই সব সময় সংখ্যালঘু ধর্মজাত সমালোচনাযোগ্য অনুশাসন বাদ দিয়ে এক বিধি তৈরি করা যেন পিছনের দরজা দিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা না হয়। সবই আমাদের মনে রাখা উচিত। কোনও সভ্য, সুচেতন দেশে ধর্ম রাষ্ট্রতন্ত্রকে গিলে ফেলে না। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলেই গর্বিত, এই ধারণাটির কোনও বিকল্প নেই।

এই প্রসঙ্গে এ বছর বঙ্গভঙ্গ দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে এ ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদ, জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী— সবার মন্তব্য আবার নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। যে-হেতু বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ধর্ম রাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে আবর্তিত, তাই বঙ্গভঙ্গকেও অভিজ্ঞতা এবং নতুন দৃষ্টিতে দেখা উচিত। শ্যামাপ্রসাদ এবং নেহরুর মতাদর্শ দুই মেরুতে অবস্থিত। তবু বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদের বক্তব্য নেহরু এবং পটেল মেনে নিয়েছিলেন। কারণ দু’পক্ষেরই দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে বাংলা ভাগের জন্য যতই ব্রিটিশদের গালমন্দ করি, আইনসভায় পশ্চিমবঙ্গের সদস্যরা এই প্রস্তাবের সপক্ষে ৫৮টি ভোট দেন, বিপক্ষে ২১টি। পূর্ববঙ্গের সদস্যদের ক্ষেত্রে এর ঠিক উল্টো হয়। তাই বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের জন্যই বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল। তা হলে ব্রিটিশদের সঙ্গে আমাদেরও ভর্ৎসনা প্রাপ্য। শ্যামাপ্রসাদের যুক্তিটি নেহরু মেনে নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর যুক্তির মধ্যে এমন কিছু ছিল যা ভবিষ্যতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াত— তিনি বলার চেষ্টা করেন যে, যদি অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুদের সংখ্যা বেশ খানিকটা কম হয় তা হলে অবিভক্ত বাংলা এক দিন ধর্মীয় পথ ধরে হাঁটতে শুরু করবে। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ তকমা যদি আইনগত ভাবে না থাকে তা হলে সংখ্যালঘুরা বিপদে পড়বে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ।

শ্যামাপ্রসাদের যুক্তিটি নেহরু এবং অবশ্যই পটেল মেনে নিয়েছিলেন। যে কারণে সেই সময় হিন্দুমহাসভার প্রবক্তা বঙ্গদেশে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় শাসনের আওতা থেকে বাঁচাতে সচেষ্ট ছিলেন। সেই কারণেই নেহরু ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত সহস্র সমস্যা সত্ত্বেও সংখ্যালঘুগোষ্ঠীকে স্বস্তি দিয়েছে, শান্তি দিয়েছে এত কাল, তাঁরা নিজেদের অরক্ষিত ভাবেননি। কিন্তু আজ সময় পাল্টাচ্ছে।

কার মনে কী ছিল বা আছে বোঝা শক্ত। আমরা তাঁদের প্রকাশিত মন্তব্য, বক্তব্য, যুক্তি এ সব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি তিনি কী বলতে চাইছেন। নেহরু এবং শ্যামাপ্রসাদ দু’জনেই অশিক্ষিত এবং কুশিক্ষিত যুক্তির শিকার হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের মতো করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। নেহরু এই বিরাট দেশটার রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য রাখতে চেয়েছিলেন সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করে। অবিভক্ত বাংলায় সংখ্যালঘু সমানাধিকার পাবে না, শ্যামাপ্রসাদ সেই আশঙ্কাকে চিহ্নিত করেছিলেন। অর্থাৎ ধর্মের অনুশাসন ভাল বা খারাপ যা-ই হোক না কেন, তাকে রাষ্ট্রতন্ত্রের থেকে শত হস্তে দূরে রাখাটাই কাম্য। ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার এটিই একমাত্র এবং মৌলিক শর্ত।

আরও পড়ুন
Advertisement