Law

আইন আছে, অধিকার নেই

আজ ছত্রিশ বছর বয়সেও দু’বাচ্চার মা মালা একই ভাবে উবু হয়ে বসে ঘর মোছে। আজও কাজের বাড়ির দাদাদের চোরা দৃষ্টি অহরহ তার বুক-পিঠ ছুঁয়ে যায়।

Advertisement
প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২২ ০৫:৩৮
সন্দেহের ট্র্যাডিশনও চলতে থাকে।

সন্দেহের ট্র্যাডিশনও চলতে থাকে।

একখানা কলা আর হাফ পাউরুটির প্যাকেটটা কৃতজ্ঞচিত্তে ব্যাগে ঢোকায় মালা (পরিবর্তিত)। ক’জনই বা এমন হাত খুলে দিতে পারে বাড়ির কাজের মেয়েকে? ঠিকই, লোকজন এলে মাঝে-মাঝে একটু বাড়তি বাসন মাজা, দু’চার পদ বেশি রান্না করার ভার আসে তার ঘাড়ে। কিন্তু মালা লক্ষ করে দেখেছে, যে দিন সে রকম কেউ আসার থাকে না, সে দিনও ঘর মোছা, বাসন মাজা, রান্নার বাইরে কখনও আসবাব ঝাড়া, কখনও রান্নাঘরের তাক পরিষ্কার, কিছু-না-কিছু লেগেই থাকে। এ সব কাজের আলাদা পয়সা হয় না। কিন্তু, না-ও করা যায় না। এক বার করেছিল— পত্রপাঠ সেই বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ভাঙা মাসের মাইনেটুকুও জোটেনি।

মুশকিল আরও অনেক। কাজের বাড়িতে কিছু খোয়া গেলেই সবাই তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। সে বার এক বৌদি তো বললেই ফেললেন, “আংটিটা খুলে এই গ্যাসের পাশেই রেখেছিলাম জানো, তুমি তো এ দিকটাতেই কাজ করছিলে…।” এর পর কয়েক জোড়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এসে স্থির হয় মালার উপরে। সে প্রাণপণে গ্যাসের আশপাশ, নীচে খোঁজে কোনও এক মিরাকলের অপেক্ষায়। কিন্তু মিরাকল ঘটে কালেভদ্রে, আর সংসারের এটা-সেটা খোয়া যায় নিরন্তর। তাই সন্দেহের ট্র্যাডিশনও চলতে থাকে, সমানে।

Advertisement

যদিও প্রায় কেউ জানে না, তবু মালাদের জন্যে আইন কিন্তু এ দেশেও আছে। ২০০৮ সালের ‘গৃহকর্মী নিবন্ধন, সামাজিক নিরপত্তা ও কল্যাণ’ আইন অনুযায়ী বছরে অন্তত পনেরো দিনের সবেতন ছুটি পাওয়ার কথা। ১৯৪৮ সালের ন্যূনতম মজুরি আইনের ২২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাজ্যভিত্তিক যে অনুমোদিত মজুরি, তা পাওয়ার কথা; পাওয়ার কথা সপ্তাহান্তে অন্তত একটা দিনের সবেতন ছুটি, থাকা-পরার সর্ব ক্ষণের কাজের ক্ষেত্রে দিনে অন্তত দশ ঘণ্টা বিশ্রাম, আরও কত কী।

তবে, এ সব পাওনাগন্ডা খাতায়-কলমে, আইনি ভাষাতেই থাকে। আর আইন বড় গোলমেলে জিনিস। পনেরো বছর বয়েসে প্রথম ঘর মোছা বাসন-মাজার কাজ শুরু করেছে মালা। সে যখন উবু হয়ে ঘর মুছত, ঘোষেদের একতলার ভাড়াটে বৌদির বড় ছেলে কিছু না কিছু বাহানায় ঘুরঘুর করত আশপাশে। কিন্তু গৃহকর্মী নিবন্ধন আইনে পঞ্চদশীদের সুরক্ষার কথা বলা হয় না, কারণ আঠারো না হলে গৃহকর্মী হিসেবে যোগদানই যে আইনসম্মত নয়। পেটের টানে সেই আইন ভাঙে মালারা। আইনত দোষের শুরু তো সেখানেই। বাকিদের তাই দোষে দোষে দোষক্ষয়!

আজ ছত্রিশ বছর বয়সেও দু’বাচ্চার মা মালা একই ভাবে উবু হয়ে বসে ঘর মোছে। আজও কাজের বাড়ির দাদাদের চোরা দৃষ্টি অহরহ তার বুক-পিঠ ছুঁয়ে যায়। সময় বদলালেও ওদের জীবন বদলায় না, কালকের ক্ষত আজ খানিক কম চিনচিন করলে আমরা ভাবি, এই তো বুঝি সব সেরে গেল! আসলে তাকে সয়ে যাওয়া বলে। মালাদেরও সয়ে যায় সব। ছত্রিশের মালা আজ যখন আইনের চোখে ‘গৃহকর্মী’, তখন এ সব চোরা দৃষ্টি সয়ে সয়ে তার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, তা নিয়ে আর ভাবাই আসলে সময়ের অপচয়।

এ সব অভ্যাস না করে উপায়ও নেই। এত আকছার ঘটে যে, সইয়ে না-নিলে কাজে টিকে থাকাই দায়। কতটা সাধারণ এ সব ঘটনা? ২০০৬ সালে ৫০০ শিশু গৃহকর্মীর উপর করা সমীক্ষার ফল বলছে যে, প্রতি একশো জনে সাতষট্টি জন শিশুই কাজের বাড়িতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার। দেড় দশকে ছবিটা পাল্টেছে, ভাবতে ভরসা হয় না। এই নির্যাতনের আইনি শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু যদি জানতে চান বিগত কয়েক বছরে কতগুলি এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, বা শতকরা কত জন অপরাধীর শাস্তি হয়েছে, তা হলেই মুশকিল। কারণ এ রকম অসংগঠিত ক্ষেত্রে গৃহকর্মীর সংখ্যার যথার্থ হিসাব রাষ্ট্রের কাছে নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য বলছে, এ দেশের সরকারি তথ্যভান্ডার অনুযায়ী গৃহকর্মীর সংখ্যা যেখানে মাত্র সাড়ে চল্লিশ লক্ষ, সেখানে প্রকৃত সংখ্যাটা দুই থেকে আট কোটির মাঝামাঝি কিছু একটা। সাংখ্যমানের এই বিরাট ব্যবধানের কারণ শুধুই কি মালাদের দু’পয়সার জীবনের হিসেব রাখার অনীহা? সমস্যা আরও গভীর। কাকে গৃহকর্মী বলব, কাকে বলব না; গৃহকর্মীদের একমাত্রিক বেতন নির্ধারণ করলে ভোটবাক্সে তার কী রকম ছায়া পড়বে; শিশুশ্রমকে, মূলত কন্যাশিশুশ্রমকে বাবুবাড়ির ঠিকা কাজের শ্রমের থেকে সত্যিই আলাদা করে ফেললে তাদের পরিবারের ভাতকাপড়ের কতটুকু দায় রাষ্ট্র নিতে পারবে— এ সব জটিল, অসম আর্থ-রাজনৈতিক সমীকরণে চাপা পড়ে যায় মালাদের হেডকাউন্ট।

এ-সব নিয়ে দুঃখ আছে মালাদের, কিন্তু কষ্ট নেই আর। স্বামী-পরিত্যক্ত মালা ছেলেপুলে আর শাঁখা সিঁদুর নিয়ে ঠিকা কাজ করে সংসার চালায়। হোক না স্বামী দশ, বারো কি চোদ্দো বছরেরও বেশি সময়ের নিরুদ্দেশ। এই শাঁখা সিঁদুর আর কদাপি বিবাহিতের তকমাটুকুই মালাদের ‘ভদ্র’ বাড়িতে কাজ পাওয়ার, একচিলতে বস্তিবাড়িটুকু ভাড়া পাওয়ার অলিখিত, প্রাথমিক লাইসেন্স।

আরও পড়ুন
Advertisement