Education

খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ওরা

বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, কলেজ ছাড়ার মুহূর্তে তাদের কাছে অগ্রাধিকার কোনটি? উত্তরদাতাদের ৭৪ শতাংশ স্নাতক স্তরে কলকাতার বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য কোনও না কোনও পরীক্ষায় বসছে।

Advertisement
ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৪

—ফাইল চিত্র।

নিট থেকে নেট, বিভিন্ন রকম পরীক্ষা কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গে একটা কথা হয়তো চাপা পড়ে যাচ্ছে। সেটা হল, এই সব সংবাদে পড়ুয়া সমাজের উপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে। সাধারণ ভাবেই কলেজ পাশ করে পরের জীবনে পা রাখার দোরগোড়ায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা আর উত্তেজনা কাজ করে। স্নাতকোত্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে যারা, এবং স্নাতক স্তরের পরে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে যারা— সকলের মধ্যেই গড়ে ওঠে এক অস্থিরতার মনোভাব। শেষ সিমেস্টারে তারা অসহায় ভাবে ছোটাছুটি করে, কখনও দেয় সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষা, কখনও রাজ্যের।

Advertisement

সত্যি বলতে, শুধুমাত্র পরীক্ষার তালিকা শুনে অবাক হতে হয়। স্নাতকোত্তর স্তরে পড়বে যারা, তাদের জন্য আছে কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট (পিজি)। এ ছাড়াও রয়েছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রবেশিকা পরীক্ষা, বিভিন্ন আইআইটি-তে বিজ্ঞান তথা কলাবিভাগে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে গেট বা জ্যাম পরীক্ষা। ফলপ্রকাশ হলে পরীক্ষার্থীদের মেধাতালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও চলে ইন্টারভিউ পরীক্ষা। এই সব পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ হয় ফাইনাল সিমেস্টারের পরীক্ষা ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের আগেই।

সম্প্রতি ছোট্ট সমীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম ষষ্ঠ সিমেস্টারের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। প্রসঙ্গত, এখন যারা ষষ্ঠ বা স্নাতক স্তরের ফাইনাল সিমেস্টারে রয়েছে, তারা চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম (সিবিসিএস) প্রক্রিয়ার একেবারে শেষের দিকের শিক্ষার্থী। আর এক বছর পর থেকেই পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়ে যাবে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি)-র পরীক্ষানিরীক্ষা। এত বড় পরিবর্তনের ফলে যে আশঙ্কা, অস্থিরতা জন্ম নিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের উপরে তার প্রভাব কী, তা বুঝতেই এই সমীক্ষা। কলকাতার বিভিন্ন কলেজে স্নাতক স্তরের ফাইনাল সিমেস্টারে পড়া ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর উপর করা এই ছোট্ট সমীক্ষাটির ভিত্তি মাল্টিলেভেল স্যাম্পলিং, যেখানে একের অধিক স্যাম্পল পদ্ধতি একত্রে ব্যবহার করা হয়।

বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, কলেজ ছাড়ার মুহূর্তে তাদের কাছে অগ্রাধিকার কোনটি? উত্তরদাতাদের ৭৪ শতাংশ স্নাতক স্তরে কলকাতার বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য কোনও না কোনও পরীক্ষায় বসছে। ৫৬ শতাংশ মনে করেছে যে, কলকাতার বাইরে পড়তে গেলে তাদের জাতীয় স্তরে বা বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি পেতে সুবিধা হবে, অথবা বিভিন্ন জাতীয় স্তরের সরকারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেও সুবিধা হবে। ১৯ শতাংশ মনে করেছে যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চাইলে কলকাতার বাইরে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়লে সুবিধা পাওয়া যাবে। মেয়েরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে দূরের শহরে পৌঁছে যেতে, আরও একটু ভাল পড়াশোনা, ভাল চাকরির সুযোগের জন্য।

প্রসঙ্গত উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে অন্যান্য শহরে যাওয়া ছেলেমেয়েদের অবসাদের তথ্য, আত্মহত্যার তথ্য আজকে আমাদের অজানা নয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য বলে, প্রত্যেক বছর অন্য শহরে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বাড়ছে প্রায় ৬ শতাংশ।

তবে তার থেকেও বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাদের ভাল চাকরি, উচ্চতর শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে মরীচিকা। সত্যিই কি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, বাইরের রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়লেই চাকরি পাওয়া যায়? কোন তথ্য থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছে সন্তান বা তাদের অভিভাবকরা? যে কোনও শিক্ষা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা বা চাকরির ক্ষেত্রে কতটা সফল হচ্ছে, সেই তথ্যকে বলে ‘প্রোগ্রেশন রিপোর্ট’ বা উন্নতির তথ্য, যা যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের বড় মাপকাঠি। প্রশ্ন জাগে বাইরের যে সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা, তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির তথ্য ঠিক ভাবে দেখে নিচ্ছে তো? নিয়মমতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেই তথ্য তাদের ইন্টারনেট সাইটে থাকার কথা সব সময়। বেশ কিছু ‘কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত ইউনিভার্সিটির জন্ম মাত্র কয়েক বছর আগে— তাদের সময়ব্যাপী ‘প্রোগ্রেশন’ আছে কি? অথচ শিক্ষার্থীরা, তাদের অভিভাবকরা নাভিশ্বাস তুলেও ছুটছে সেই সব প্রতিষ্ঠানে। শুধু ‘প্রোগ্রেশন’ নয়— সর্বভারতীয় ‘ন্যাক গ্রেড’ বা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র‌্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক’ (এনআইআরএফ) তালিকায় তাদের স্থান নগণ্য। তবু তার নিজের শহরের জাতীয় মেধাতালিকায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর নেই। এর প্রতিযুক্তি হিসেবে হয়তো রাজনীতির আবহাওয়ারকথা তোলা হবে। তবে সর্বভারতীয় স্তরের‌্যাঙ্কিংয়ের সময় পঠনপাঠনের আবহাওয়া উপযুক্ত কি না তাও দেখা হয়।

সমীক্ষার আর একটি ফলাফলের দিকে তাকাই। ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বলেছে, তাদের শহরের বাইরে পড়তে চলে যাওয়ার কারণ হল, তারা বাড়ি থেকে দূরে থাকতে চায়। এই উত্তরের মধ্যে আপাতভাবে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। আগেও অনেকেই বাড়ি ছেড়ে আরও এগিয়ে যেতে চেয়েছি, মনে হয়েছে কাজের বা উচ্চশিক্ষার সূত্রে বিদেশে চলে গেলে অভিভাবকদের সঙ্গে নানা মতপার্থক্য মিটে যাবে।

কিন্তু এই ভালবাসার টানাপড়েনটুকু ছাড়াও যে দূরে যেতে চাওয়া— তা এক বিশাল খাদের অনুভূতির জন্ম দেয়। হেসে চলে যায় যারা, তারা ফিরে আসে কি? এই খাদ আমরা অভিভাবকরা খনন করিনি তো? শিক্ষকরা অন্ধ, নিরুত্তাপ থাকিনি তো?

আরও পড়ুন
Advertisement