রাজনৈতিক ও আর্থিক সর্বনাশে তলিয়ে যাচ্ছে এই দেশ
Turmoil

এখন অমৃতকাল চলছে

জটায়ু থাকলে এ বছরের গোড়াতেই বেশ কয়েকটি উপন্যাস বেরিয়ে যেত— বিবিসির দর্পণে মোদীর দর্পচূর্ণ, অমৃতকালের অমৃতসরে অমৃতপালের আবির্ভাব, ইত্যাদি।

Advertisement
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৩ ০৪:২২
A Photograph of Kiran patel

সুরক্ষিত: উর্দিধারী নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিচরণরত কিরণ পটেল, দিল্লি, ১৭ মার্চ। ছবি: পিটিআই।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ভারতে এখন অমৃতকাল চলছে। অমৃতকুম্ভের আর সন্ধান করার প্রয়োজন নেই। দেশ এমনিতেই অমৃতসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। অমৃতকালে ঘটনাপ্রবাহের গতি বেশ দ্রুত এবং গতিপথ বেশ অপ্রত্যাশিত। তাতে অমৃতের ছোঁয়া কতটা আছে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও রহস্য রোমাঞ্চের উপাদান পরতে পরতে। জটায়ু থাকলে এ বছরের গোড়াতেই বেশ কয়েকটি উপন্যাস বেরিয়ে যেত— বিবিসির দর্পণে মোদীর দর্পচূর্ণ, আদানির বন্দরে হিন্ডেনবার্গের হানা, তুষারাবৃত গুলমার্গে প্রবঞ্চক পর্যটক, অমৃতকালের অমৃতসরে অমৃতপালের আবির্ভাব।

রাজনৈতিক তাৎপর্য থেকে আলাদা করে যদি এই ঘটনাপ্রবাহকে দেখা যেত, তা হলে সত্যিই বলা যেত অমৃতকাল বড়ই রোমাঞ্চকর। কিন্তু রাজনৈতিক ও আর্থিক সর্বনাশকে তো উপেক্ষা করার কোনও উপায় নেই। মোদী সরকার অধিকাংশ প্রশ্নেই মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। আদানি প্রসঙ্গে যৌথ সংসদীয় সমিতির তদন্তের দাবিতে সংসদে যাতে আলোচনা না হতে পারে সে জন্য রাহুল গান্ধীকে ক্ষমা চাইতে হবে রব তুলে শাসক দল সংসদের অধিবেশন আটকে রেখেছে। বিদেশের মাটিতে দেশের সরকারের সমালোচনা কবে থেকে দেশদ্রোহ হয়ে গেল? রাহুল গান্ধীর বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক বা সমালোচনা করা যেতেই পারে, কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ এবং সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া সরকার তো খাপ পঞ্চায়েতের মতো চলতে পারে না।

Advertisement

আদানি গোষ্ঠী হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করার হুমকি দিয়েও সে পথে এগোনোর সাহস করেনি। সরকারি তদন্ত না হলেও, আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে নতুন নতুন অনুসন্ধানলব্ধ তথ্য ক্রমেই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা ও রবি নায়ারের মতো ভারতীয় লেখক সাংবাদিকরা অনেক আগেই এই আদানি রহস্য উন্মোচন করতে শুরু করেছিলেন। সে জন্য তাঁদের আদানির তোপের মুখে পড়তে হয়েছে, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র মতো ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা থেকে সরে যেতে হয়েছে পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতাকে। এখন গোটা ছবিটা ক্রমেই বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

গত দশ বছরে এবং বিশেষ করে কোভিড পর্যায়ে আদানির যে চোখ-ধাঁধানো উত্থান আমরা দেখেছিলাম, তার মূলে ছিল বিভিন্ন আদানি কোম্পানির শেয়ারের মূল্যে নাটকীয় উল্লম্ফন। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই শেয়ার বাজারের কলকাঠি ছিল আদানি পরিবার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সাজানো কোম্পানি বা শেল কোম্পানির হাতে। সেই চড়া শেয়ার বন্ধক রেখে ব্যাঙ্ক থেকে এসেছে অঢেল ঋণ। আর মোদী সরকারের সৌজন্যে দেশের ভিতরে একের পর এক কয়লা খনি, বিদ্যুৎ কারখানা, বন্দর, বিমানবন্দর, রেলওয়ে, সিমেন্ট কারখানা আর বিদেশে বাজার দখল ও মুনাফা অর্জনের অবাধ আয়োজন। কৃষিকেও আদানির হাতে তুলে দেওয়ার সাজানো ছককে কোনও মতে কৃষক আন্দোলন কিছুটা আটকে দিয়েছে। আদানির যেমন হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টকে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করার সাহস নেই, মোদী সরকারও একই ভাবে সংসদে বা কোনও সাংবিধানিক সংস্থার কাছে এ প্রশ্নে জবাবদিহি করতে নারাজ।

আদানির পতনে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের চাকরি খোয়ানোর কোনও প্রশ্ন নেই, কারণ আদানি গোষ্ঠী নিজেই সাকুল্যে হাজার তেইশের বেশি লোকের কর্মসংস্থানের দাবি করে না। কিন্তু যে বিপুল পরিমাণ ঋণের উপর আদানির মুনাফা ও সম্পত্তির পাহাড় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই ঋণ পরিশোধ বন্ধ হলেই ভারতে নেমে আসবে বিরাট ব্যাঙ্ক বিপর্যয়। সেই বিপর্যয় বা তাকে এড়াতে সরকার যে ব্যবস্থাই করুক, তার সঙ্গে কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থ ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে। আমেরিকায় আবার যে ভাবে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলেছে, তাতে পনেরো বছর আগের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের আশঙ্কা ও উদ্বেগ আবার আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হতে শুরু করেছে। তখন ভারতের অর্থব্যবস্থা, বিশেষ করে ব্যাঙ্কিংব্যবস্থা সেই সঙ্কট মোটামুটি এড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। কিন্তু নোট বাতিল আর বেসরকারিকরণের ধাক্কায় পর্যুদস্ত ব্যাঙ্কশিল্প, এবং কোভিড ও অন্য নানাবিধ কারণে বিপর্যস্ত অর্থব্যবস্থা আজ কী ভাবে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করবে?

ক্ষমতাবলে আদানি প্রসঙ্গকে যতই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হোক, স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক অর্থনীতির এই বৃহত্তম কেলেঙ্কারির ধারাবাহিক বিস্ফোরণ অব্যাহত থাকবে। কিরণ পটেলের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়তো তুলনায় সহজ, কিন্তু রণনীতি ও রাজনীতির দিক থেকে তার তাৎপর্যও কম নয়। কাশ্মীর এখন কেন্দ্রশাসিত, গোটা এলাকা সেনাবাহিনীর দখলে। সেই কাশ্মীরে গত কয়েক মাস ধরে জ়েড প্লাস নিরাপত্তা বেষ্টিত হয়ে এক গুজরাতবাসী উচ্চপদস্থ সরকারি অতিথি হিসাবে বিভিন্ন অতিসংবেদনশীল এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক অতিরিক্ত নির্দেশকের পরিচয়ে। মার্চের গোড়ায় কাশ্মীর পুলিশ কিরণ পটেলকে শ্রীনগরের পাঁচতারা হোটেল থেকে আটক করে, আর দিন দশেক পরে খবর বেরোয় তিনি আসলে এক জন প্রবঞ্চক।

সামাজিক মাধ্যমে কিরণ পটেল কিন্তু স্পষ্টতই বিজেপির এক অনুগত সৈনিক। আটক হওয়ার সময় কিরণ পটেলের সঙ্গে যে দু’জন ছিলেন, তাঁদের আশ্চর্যজনক ভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদের এক জন অমিত পাণ্ড্য, গত কয়েক দশক ধরে যিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর জনসংযোগ আধিকারিক সেই হিতেশ পাণ্ড্যর সুপুত্র। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ভুয়ো কার্ড ছাপিয়ে কাশ্মীরে যদি জ়েড প্লাস নিরাপত্তা বেষ্টিত হয়ে এত আরামে ঘুরে বেড়ানো যায় তা হলে মেনে নিতে হবে ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থা এতটাই খেলো যে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারলে যা খুশি করা যায়।

এই কাশ্মীরেই ২০১৯ নির্বাচনের আগে পুলওয়ামা ঘটেছিল। কী করে সিআরপিএফ কনভয়ের মাঝে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক নিয়ে একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে দিল, তার আজও বিশ্বাসযোগ্য উত্তর মেলেনি। যেমন উত্তর পাওয়া যায়নি সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যোগ প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও ডিএসপি দেবেন্দ্র সিংহকে কেন নিছক চাকরি থেকে ছাঁটাই করেই ছেড়ে দেওয়া হল।

সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে অকেজো করে জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে অবনমিত করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার যুক্তি ছিল, জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতে শক্তিশালী হবে। এর আগে নোট বাতিল করার সময়ও একই যুক্তি ছিল, কালো টাকা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবাদও নির্মূল হবে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারি প্রচার আর বাস্তবের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।

উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে পঞ্জাবের বুকেও। কৃষক আন্দোলনের সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল, কৃষক ঐক্যে ফাটল ধরাতে নানা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। পথ-দুর্ঘটনায় দীপ সিধুর মৃত্যুর পর রহস্যজনক ভাবে দুবাই থেকে অমৃতপাল সিংহের প্রত্যাবর্তন এবং দীপ সিধু প্রতিষ্ঠিত 'ওয়ারিস পঞ্জাব দে' সংগঠনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পঞ্জাবের বুকে নাটকীয় পটপরিবর্তন নিয়ে এসেছে। উঁকি দিতে শুরু করেছে ভিন্দ্রানওয়ালে পর্বের বিভিন্ন বিপজ্জনক লক্ষণ। ধার্মিক পবিত্রতা রক্ষার নামে সহিংসতা নতুন বিপদ হিসাবে মাথা তুলছে।

পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, গভীর আর্থিক সঙ্কট, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রহস্যজনক ষড়যন্ত্রের উঁকি— এ সব নিয়ে সংসদে আলোচনার কোনও সুযোগ আর নেই। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী খোলাখুলি সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করছেন। আদানি কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানের জন্য সরকারের কোনও দায় নেই, মেহুল চোক্সীর ক্ষেত্রে ইন্টারপোল রেড নোটিস প্রত্যাহৃত, কিন্তু বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে ইডি এবং সিবিআই অভিযান চলছে। মোদী হঠাও পোস্টারের জন্য গ্রেফতারি চলছে, বিবিসি-র তথ্যচিত্র দেখানোর অভিযোগে দিল্লির ছাত্র-গবেষকদের উপর শাস্তি নেমে আসছে, ভরা সংসদে মোদী ও আদানির সখ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বলে ২০১৯ সালের পুরনো নির্বাচনী ভাষণের প্রসঙ্গে রাহুল গান্ধীকে দু’বছরের কারাদণ্ড শুনিয়েছে গুজরাতের এক কোর্ট। তাঁর সাংসদ পদে কোপ পড়েছে।

ভগত সিংহ, মাস্টারদারা কি আজকের ভারতে আবার শহিদের মৃত্যু বেছে নিতেন?

চুপ, অমৃতকাল চলছে।

আরও পড়ুন
Advertisement