নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত জেনেও মানুষ যে কারণে তাঁকে ভোট দেন
West Bengal Panchayat Election 2023

কলঙ্ক যেন পদ্মপাতায় জল

২০১৩-র জুলাইতে একটা সমীক্ষা করে লোকনীতি-সিএসডিএস। এখনকার মতোই সে সময়ে আকাশে-বাতাসে অনেক দুর্নীতির অনুরণন।

Advertisement
অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:১৯
A Photograph of election

স্থানীয় পর্যায়ে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মানুষ যে দুর্নীতির মুখোমুখি হন, আপাত ভাবে তা যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে ইভিএম-এ। ফাইল ছবি।

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট এসে গিয়েছে। এ বছরই কর্নাটক, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান-সহ সাতটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের দামামাও শোনা যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে বিভিন্ন রাজনীতিক এবং তাঁদের কিছু ঘনিষ্ঠ জনের সম্বন্ধে হরেক দুর্নীতির ‘অভিযোগ’ও যেন পুঞ্জীভূত হচ্ছে পাল্লা দিয়ে। অভিযুক্ত মানেই তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যান না— আদালতে অভিযোগ প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই। প্রমাণ বা অপ্রমাণ অবশ্য বেশ দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি। মিডিয়া-ট্রায়াল এবং জনতার আদালতে বিচার যদিও অনেক ক্ষেত্রেই হয় চটজলদি। কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রভাব ঠিক কী? দুর্নীতির অভিযোগ কী ভাবে সাধারণ ভোটারকে প্রভাবিত করে?

আর কে লক্ষ্মণের বহুল-পরিচিত এক কার্টুনে দেখা গিয়েছিল, দুর্নীতি প্রতিরোধের অংশ হিসেবে এক রাজনীতিকের টেবিলের নীচের অংশটা কাঠের তক্তা দিয়ে আটকানো। ‘কমন ম্যান’ সেখানে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নীরব দর্শক। তবে দুর্নীতির অভিযোগকে প্রাধান্য দিয়ে ‘কমন ম্যান’ ইভিএম-এর বোতাম টেপেন, এ কথা হলফ করে বলা কঠিন। আসলে জনগণের একটা বড় অংশের কাছে এই সব দুর্নীতি আলোছায়ায় ঢাকা। এ দেশের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ বা দুর্গম এলাকায় মিডিয়ার প্রসার এখনও অপ্রতুল। আবার ২০০৩ থেকে যদিও নির্বাচনে প্রার্থীদের নিজেদের অপরাধমূলক তথ্য প্রকাশ্যে দিতে হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার সেই তথ্যের সহজে নাগাল পান না নিশ্চয়ই।

Advertisement

২০১৩-র জুলাইতে একটা সমীক্ষা করে লোকনীতি-সিএসডিএস। এখনকার মতোই সে সময়ে আকাশে-বাতাসে অনেক দুর্নীতির অনুরণন। সমীক্ষাতে দেখা যায়, টেনেটুনে পঞ্চাশ শতাংশ জনগণ তখন কয়লা দুর্নীতির কথা শুনেছে; ২জি কেলেঙ্কারির নাম শুনেছে ৪০%; আর অন্যান্য দুর্নীতির কথা জানে এক-তৃতীয়াংশেরও কম মানুষ। এবং, শোনা মানেই পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা নয়, জানা মানেই অভিযুক্তকে অপরাধী ধরে নেওয়া নয়। সমীক্ষাতে ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তাঁরা কোন দলকে ভোট দেবেন। দেখা গেল, দু’টি প্রধান দল, অর্থাৎ কংগ্রেস এবং বিজেপি-কে ভোটদানের ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের পছন্দের উপর এই সব দুর্নীতি সম্পর্কে তাঁদের জানা বা না-জানার প্রভাব প্রায় শূন্য, বা অতি সামান্য— যা রাশিবিজ্ঞানের নিরিখে মোটেই তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এমন নয় যে, ভারতের ভোটাররা দুর্নীতিকে পাত্তা দেন না। আসলে ভোটাররা দুর্নীতি সম্পর্কে যে ভাবে ভাবেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা যে ভাবে তাঁদের প্রচারে এই বিষয়টিকে তুলে ধরেন, এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। রাজনৈতিক দলগুলি হয়তো দুর্নীতির প্রশ্নটিকে একটা চমক হিসেবে উপস্থাপনায় বেশি আগ্রহী— ও দিকে ভোটাররা বড়সড় দুর্নীতির চেয়েও তাঁদের প্রাত্যহিক দিনযাপন সম্পর্কে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন।

স্থানীয় পর্যায়ে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মানুষ যে দুর্নীতির মুখোমুখি হন, আপাত ভাবে তা যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে ইভিএম-এ। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে লোকনীতি-সিএসডিএস পরিচালিত ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ সমীক্ষায় প্রতি পাঁচ জন উত্তরদাতার মধ্যে এক জন বলেছেন, সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ‘কাজ’ করাতে গুরুত্বপূর্ণ কাউকে চিনতে হয়, বা ঘুষ দিতে হয়। কিন্তু এই সব ‘কাজ’ যে-হেতু করেন প্রশাসনিক আধিকারিকরা, সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দল নয়— স্থানীয়-স্তরের দুর্নীতিও ভোটারদের ভোটদানের ভিত্তি হিসেবে দানা বাঁধে কম। আমাদের ‘পার্টি সোসাইটি’র পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসনের ধূসর পার্থক্য ভোটারদের কাছে অস্পষ্ট হয়েই থাকে।

কোনও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলেই ভোটাররা তাঁর প্রতি বিমুখ হবেন, এমন কোনও সহজ সূত্র নেই। উল্টো উদাহরণ বরং প্রচুর। ২০১৪-র লোকসভায় নির্বাচিত সাংসদদের অন্তত ৩৪ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলছিল তাঁদের নির্বাচনের সময়। ২০১৯-এ এই অনুপাত দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে। এ সবের অনেকটা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকের দৈনন্দিন পেশা বা নির্বাচনের সময়কার কৌশলের ফল। ভোটাররাও সেটা জানেন। অবশ্য কিছু রাজনীতিকের বিরুদ্ধে থাকে গুরুতর অভিযোগও, তবু তাঁরা ভোট পান এবং জেতেন। বার বার। গুরুতর অর্থনৈতিক অভিযোগ থাকাকালীন মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা, লালু প্রসাদ যাদব। ভোটাররা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই এই সব দুর্নীতির অভিযোগকে ‘জাহাজের খবর’ বলে উপেক্ষা করেন। তাঁরা তাঁদেরকেই চান, যাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সংগ্রামকে একটু সহজ করতে সাহায্য করতে পারবেন বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন।

ফিলিপিন্স থেকে পাকিস্তান, ভোটারদের মানসিকতা সর্বত্রই এই রকম। এমনকি পশ্চিমি দেশগুলিতেও। আমেরিকান সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০২০-র শেষ দিকে চারটি দেশে সমীক্ষা চালায়। তাতে নিজেদের দেশের ‘বেশির ভাগ রাজনীতিকই দুর্নীতিগ্রস্ত’ এই বক্তব্যে সহমত হন ৬৭% আমেরিকান, ৪৬% ফরাসি, ৪৫% ব্রিটিশ, এবং ২৯% জার্মান ভোটার। ২০১৬-র আমেরিকান নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প হিলারি ক্লিন্টনের উপর দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন বার বার, তাঁর বিচারের হুমকি দিয়েছেন। ভোটাররা কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেননি। ইটালিতে অপরাধ ও রাজনীতির পারস্পরিক নির্ভরতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই তো দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ইজ়রায়েলে ক্ষমতায় ফিরলেন নেতানিয়াহু।

ওয়াশিংটনের ‘কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর সিনিয়র ফেলো মিলন বৈষ্ণব তাঁর ২০১৭-র বই হোয়েন ক্রাইম পেজ়: মানি অ্যান্ড মাসল ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স-এ বলছেন, ভোটারদের কাছে অপরাধমূলক রেকর্ডধারী কিংবা অভিযুক্ত প্রার্থীদের সমর্থনের একটি কৌশলগত যুক্তি রয়েছে। সামাজিক উত্তেজনার আবহে এবং রাষ্ট্রের প্রতি ভরসা কম থাকলে অনেক ভোটারই এমন এক শক্তিশালী ব্যক্তির কাছে আশ্রয় নিতে চান, যিনি সংশ্লিষ্ট বিশেষ সামাজিক বা জাতিগত সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাসন-ঘাটতি পূরণ করতে পারেন। যেমন, যত দিন না উত্তরপ্রদেশের ভোটাররা বুঝবেন যে, লখনউয়ের সরকার তার ক্ষমতা রাজ্যের সুদূরপ্রসারী অঞ্চলে অভিক্ষেপে সক্ষম, তত দিন নিজেদের স্বার্থ দেখাশোনার জন্য তাঁদের এক জন স্থানীয় ‘অভিভাবক’-এর প্রয়োজন থাকবে। বৈষ্ণব কিন্তু বলছেন, ভোটাররা দুর্নীতির অভিযোগগুলি সম্পর্কে অবহিত, তবু তাঁরা এমন প্রার্থীদের ভোট দেন।

বৈষ্ণবের বক্তব্য নিয়ে ভাববার কিংবা তর্কের অবকাশ থাকতেই পারে, তবে মোটের উপর ভোটাররা যে রাজনীতিকদের সততা এবং যোগ্যতাকে তুলাদণ্ডের দু’দিকে বসিয়ে ওজন করেন না, সে কথা স্পষ্ট। তবু, ভারতে কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোয়ার উঠেছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে। ভোটাররা তাতে শামিলও হয়েছেন। আশির দশকের শেষে বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে তৈরি হওয়া ঝড়ে উড়ে যায় রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস। ভারতের রাজনীতিও সেই সঙ্গে বদলে যায় পাকাপাকি ভাবে। বফর্স-সংক্রান্ত অভিযোগ থেকে রাজীব গান্ধীর মুক্তি পেতে কেটে যায় আরও দেড় দশক। কিন্তু ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে কত সংখ্যক মানুষ সেই ধারণার শরিক ছিলেন, রাজনীতিতে সেটাই আসল কথা। এর দু’দশক পরে দুর্নীতির প্রশ্ন আবার আসে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে। সৌজন্যে ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন’ আন্দোলন, যা জন্ম দেয় আম আদমি পার্টির। এ সময়েই সর্বভারতীয়-স্তরে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপি এবং মোদীর বক্তব্য সময়-গুণে খানিক অতিরিক্ত হাওয়ার জোগান পায় নিশ্চয়ই। ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ ভোটে হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।

কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির প্রশ্নই কি রাজনীতির পাশা উল্টে দিতে পারে? না কি দিন-বদলের অমোঘ ক্ষেত্রটা প্রস্তুত হয়েই থাকে? কোনও এক অনুকূল পরিস্থিতিতে উপযুক্ত দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা ‘না খানে দুঙ্গা’র প্রতিশ্রুতি সেই সলতেতে আগুনের স্ফুলিঙ্গটুকুর জোগান দেয় মাত্র। তাই কোনও রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মানেই তাঁদের জনসমর্থনে ফাটল ধরা, সমীকরণটা এত সরল নয়। অভিযুক্ত নেতা বা পার্টি কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত, বিরোধী দলই তো প্রধানত তা জনগণকে বোঝায়। সোশাল মিডিয়া-বিধ্বস্ত আজকের প্রচার এবং পাল্টা প্রচারের যুগে অভিযোগ, প্রতিরোধ, পাল্টা অভিযোগ ইত্যাদি মিলেমিশে পুরোটাই কিন্তু ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। কখনও আবার অতি-ব্যবহারের চেষ্টাতেও জীর্ণ হয়ে ওঠে ধারালো অস্ত্রখানা।

আরও পড়ুন
Advertisement