Education

সন্তানকে ‘সফল’ করার বাজি

হেরে যাওয়ারাই অবশ্য একমাত্র নয়। দু’তিন বছর একনিষ্ঠ সাধনার পরে সোনার মুকুট পরে বেরিয়ে আসে কিছু ছাত্রছাত্রী। আমরা সেই বিজয়ীদের দেখি।

Advertisement
অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৩ ০৫:৪০
Representational image of students and education.

মাসকয়েকের পুরনো সরকারি তথ্য বলছে, ‘কোচিং ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া’ কোটায় গত চার বছরে আত্মহত্যা করেছে ৫২ জন পড়ুয়া। প্রতীকী ছবি।

রাজস্থানের শহর কোটা-র নাম শোনেননি, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়া সন্তানের উচ্চ মধ্যবিত্ত মা-বাবাদের মধ্যে এমন লোক বিরল। একটা শহর, যার অর্থব্যবস্থা বহুলাংশে দাঁড়িয়ে আছে আইআইটি-র প্রশিক্ষণের কোচিং সেন্টারের উপর। কোটায় শুধুমাত্র কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যবসার পরিমাণ বছরে ৬০০০ কোটি ছাড়িয়েছে। প্রতি বছর সেখানে নাম লেখায় গড়ে দু’লক্ষ পড়ুয়া, শ্রেষ্ঠ হওয়ার লড়াইয়ে। প্রতি দিন তৈরি হয়ে চলে সেই পরীক্ষার জন্য, এক বার যে বৈতরণি পার করতে পারলেই অনন্ত সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকবে। ‘সফল’ বলে চিনবে লোকে।

তবে, মাসকয়েকের পুরনো সরকারি তথ্য বলছে, ‘কোচিং ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া’ কোটায় গত চার বছরে আত্মহত্যা করেছে ৫২ জন পড়ুয়া। এই সংখ্যা এখন বেড়েছে। দেখা গিয়েছে, আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে প্রথম সারিতে জায়গা করেছে ঠিকঠাক রেজ়াল্ট করতে না পারা, অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ার ভয়। কারণের তালিকায় উপরে রয়েছে মা-বাবার প্রত্যাশা পূর্ণ না করতে পারার হতাশা, শারীরিক ক্লান্তি, মানসিক ক্লেদ।

Advertisement

হেরে যাওয়ারাই অবশ্য একমাত্র নয়। দু’তিন বছর একনিষ্ঠ সাধনার পরে সোনার মুকুট পরে বেরিয়ে আসে কিছু ছাত্রছাত্রী। আমরা সেই বিজয়ীদের দেখি। সমাজ দেখে। পাড়া দেখে। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় যে বিজ্ঞাপনগুলো বেরোয়, অনেক ছবির শেষে সেখানে স্থান পায় কয়েকটা শূন্য ফ্রেম। নীচে লেখা থাকে, আমাদের ছাতার তলায় এলে পরের বছর এখানে ছাপা হতে পারে তোমার ছবিও। মা-বাবারা সেই বিজ্ঞাপন দেখেন। আর, আশার আঁকশি দিয়ে গেঁথে ফেলেন সন্তানসন্ততিকে। সেই সন্তানদের মধ্যে যারা পারে, তারা পারে। আর যারা পারে না, তাদের মধ্যে কেউ মধ্যরাতে ঘরের দরজা এঁটে জীবন শেষ করে ফেলে। দু’চার দিন পরে গন্ধ বেরোয়। ঘরের দরজা ভাঙা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি কোচিং সেন্টারের সবার আগে প্রয়োজন অভিজ্ঞ মনোবিদের। যারা ইঁদুরদৌড়ে শামিল হতে পারছে না ঠিকঠাক, তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলা প্রয়োজন। যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি এঞ্জিনিয়ারিং নয়, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চেয়েছিল, অথবা নাটক করতে চেয়েছিল, তাদের কোচিং-এর জাঁতাকল থেকে মুক্তি জরুরি। আশাহত বহু বাবা-মা শেষ অবধি মেনেছেন যে, সন্তানের মনের খবর জানতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন প্রতি দিন। শেয়ার মার্কেটের রিপোর্টের মতো তাঁদের মোবাইলের পর্দায় রোজ সকালে হাজির হয়েছে ছেলেমেয়ের উন্নতির গ্রাফ। কিন্তু সন্তানের আখেরে কিসে ভাল, তা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি কোচিং সেন্টারের কেউ।

কত জন পড়ুয়া স্বেচ্ছায় দু’তিন বছরের এই নির্বাসন মেনে নিয়েছে, আর কত জন বাধ্য হয়েছে নিছক বাড়ির চাপে— এ নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়েছে কি না জানা নেই। জানা উচিত। খবরে পড়েছি, আত্মহনন করা এক ছাত্রের ঘর থেকে নাকি শেষের কয়েক দিন, রাত্রিবেলা ভেসে আসত গোঙানির আওয়াজ, কান্নার শব্দ। মনের গভীরে গুমরে মরছে আরও অনেকেই। দেরি হয়ে যাওয়ার আগে ওদের কথা শোনা আমাদের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

বিমানে যাত্রা করে কোটায় পৌঁছতে গেলে আজও জয়পুরেই নামতে হয়। সেখান থেকে আরও সাড়ে চার ঘণ্টার পথ। কোটায় বিমানবন্দর থাকলেও কম সংখ্যক যাত্রীর কারণে ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক উড়ান বন্ধ হয়ে যায়। বিমানবন্দরটি ফের চালু করা হবে কি না, তা নিয়ে তর্ক হয়। আন্তর্জালে দেখলাম, এক দল অভিভাবক বলছেন, “বিমান পরিষেবা চালু হলে ছেলেমেয়ের মুখগুলো ইচ্ছে করলেই দেখতে পাই। ওরা যে পড়ে পড়ে ক্লান্ত।” অন্য এক দল বলছেন, “এ সব ঠুনকো সেন্টিমেন্ট রাখুন তো মশাই! প্লেন চালু হলেই দুম করে বাড়িতে আসার বায়না করবে মাসে একটা শনিবার। এখন একটা দিনও পড়া নষ্ট করা চলবে না।” যুক্তির পিঠে যুক্তি চাপে। তর্ক বাড়ে তর্কে। শুধু পড়ুয়াদের মনের খবর শোনার চেষ্টা করে না কেউ।

খবরে প্রকাশ, রাজ্যের বেসরকারি প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোকে লাগাম দেওয়ার জন্য রাজস্থান সরকার একটি বিল আনতে চলেছে। টপারদের মাথায় মুকুট পরিয়ে বিজ্ঞাপনের দিন নাকি শেষ হতে চলেছে দ্রুত। পড়ুয়ার মনের স্বাস্থ্য কেমন আছে, মনোবিদের তত্ত্বাবধানে তা নিয়মিত পরখ করতে বাধ্য থাকবেন প্রশিক্ষণ শিবিরের কর্তাব্যক্তিরা। মার্কশিটের পাশাপাশি তা শেয়ার করা হবে পড়ুয়ার পরিজনদের সঙ্গেও।

বাস্তবে এই বিলের প্রয়োগ কতটা হবে জানি না। যে সন্তানের কপালে যুদ্ধজয়ের তিলক এঁকে কোটায় পাঠিয়েছেন, সেই ছেলে কিংবা মেয়ের মনের খবরে আগ্রহ থাকবে তো মা-বাবার? তারা ফিরে আসতে চাইলে হাসি মুখে দরজা খুলতে পারবেন তো, তাকে নিজেদের সমূহ পরাজয় না ভেবে?

আরও পড়ুন
Advertisement