এত দিনে রাহুল গান্ধী যেন রাজনীতিতে প্রকৃত উৎসাহ নিচ্ছেন
Rahul Gandhi

এ বার আসল কঠিন পথ

মনমোহন সিংহ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই রাহুল গান্ধীকে তাঁর সরকারের মন্ত্রী হতে বলেছিলেন। সনিয়া গান্ধীরও তেমনটাই ইচ্ছে ছিল।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৫

—ফাইল চিত্র।

রাহুল গান্ধীকে কাছ থেকে দেখা যে কেউ জানেন, তাঁর মনের কথা ও মুখের কথায় বিশেষ ফারাক থাকে না। রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে এটা মস্ত দোষের তালিকায় পড়ে। কিন্তু রাহুল গান্ধী কারও সঙ্গে বিরক্তি সহকারে কথা বললে তা তাঁর মুখ দেখে বোঝা যায়। পোড়খাওয়া রাজনীতিকদের মতো মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রেখে তিনি মনের ভাব লুকিয়ে রাখতে পারেন না।

Advertisement

এখানেই বোন প্রিয়ঙ্কার সঙ্গে রাহুলের সবচেয়ে বড় ফারাক। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার ব্যবহার বা মুখের হাসি দেখে বোঝার উপায় থাকে না, তাঁর মনে কী রয়েছে। সনিয়া গান্ধীর মধ্যেও এই গুণ রয়েছে। আর সেই কারণেই কংগ্রেসের অন্দরে কোনও সঙ্কট তৈরি হলে, কোনও রাজ্যের বিক্ষুব্ধ নেতার ক্ষোভ নিরসনে প্রিয়ঙ্কাকে ময়দানে নামানো হয়।

মনমোহন সিংহ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই রাহুল গান্ধীকে তাঁর সরকারের মন্ত্রী হতে বলেছিলেন। সনিয়া গান্ধীরও তেমনটাই ইচ্ছে ছিল। মনমোহন জানতেন, রাহুল সরকারে যোগ দিলে সরকারের ভিতর থেকে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে দেখার সুযোগ পাবেন। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বাড়বে। বিশেষ করে জোট সরকারে শরিকদের নিয়ে কী ভাবে কাজ করতে হয়, তাঁদের নানা চাপ কী ভাবে হাসি মুখে সামলাতে হয়, তা রাহুল বুঝতে পারবেন।

মনমোহন সিংহকে অনেকেই অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে দেখেন। বাস্তবে, নরেন্দ্র মোদীর মতো বাকপটু না হলেও তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছিল প্রশ্নাতীত। এক বার নয়, মনমোহন একাধিক বার রাহুলকে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বলেছিলেন। তিনি জানতেন, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে এই অভিজ্ঞতা রাহুলের কাজে লাগবে।

রাহুল গান্ধীকে রাজি করানো যায়নি। সে সময় শাসক দলে থেকেও তাঁর ভূমিকা ছিল বিদ্রোহীর মতো। কখনও তিনি ইউপিএ সরকারের অধ্যাদেশের বিরোধিতা করছেন। কখনও কংগ্রেসের সংগঠনে তাঁর পছন্দের তরুণ নেতাদের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি তুলছেন। তিনি আসলে কোন পক্ষে লড়ছেন, মোগল না রাজপুত— বোঝা যেত না। কেন তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে চান না, তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি।

এখানেই রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি ‘দায়িত্ব ছাড়া ক্ষমতা’ উপভোগ করতে চান। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ব্যর্থতার দায় নিয়ে তিনি কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। একই অভিযোগ ফিরে এসেছিল। তার কারণও ছিল। সভাপতির পদ না থাকলেও রাহুলই আসলে পর্দার পিছন থেকে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতেন। পরবর্তী কালে রাহুলকে ফের কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্বে ফেরানো হোক বলে কংগ্রেসের অন্দরে দাবি উঠলেও তিনি রাজি হননি। স্বাভাবিক ভাবেই ফের একই অভিযোগ উঠেছিল।

বলা বাহুল্য, এ বার লোকসভায় বিরোধী দলনেতা না হলে রাহুলের গায়ে পাকাপাকি ভাবে ‘দায়িত্বহীন ক্ষমতাভোগে বিশ্বাসী’-র তকমা লেগে যেত। এবং এই প্রথম রাহুল গান্ধী লোকসভায় বিরোধী দলনেতার আসনে বসে বোঝালেন, তিনি দায়িত্ব নিতে তৈরি।

কংগ্রেসের অন্দরমহল যারপরনাই আহ্লাদিত। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর গদির দিকে রাহুলের জয়যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। লোকসভার বিরোধী দলনেতার আসনের ঠিক উল্টো দিকেই প্রধানমন্ত্রীর আসন। কতটুকু আর দূরত্ব! বাস্তব হল, আসলে রাহুল গান্ধীর ঠিক এখন থেকেই দুর্গম যাত্রাপথ শুরু হচ্ছে। বিরোধী দলনেতার আসন থেকে প্রধানমন্ত্রীর আসন পর্যন্ত ওই রাস্তাটুকুই সবচেয়ে খাড়াই, সবচেয়ে কঠিন।

রাহুল বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই বলেছেন, তিনি শুধু কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা নন, তিনি ইন্ডিয়া জোটের সমস্ত বিরোধী দলের নেতা, তাঁকে সকলের হয়ে কথা বলতে হবে, সবাই সংসদে বলার সুযোগ পাচ্ছেন কি না, তা দেখতে হবে। এগুলো মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে ততটাই কঠিন। নানা রকমের শরিক দলকে নিয়ে জোট চালানো যে কতখানি শক্ত, মনমোহন সিংহ ইউপিএ সরকারের দশ বছরে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। এ বার রাহুল গান্ধীকে একই সঙ্গে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, এম কে স্ট্যালিনের ডিএমকে, শরদ পওয়ারের এনসিপি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার মতো দলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। এখন তাঁরা সংবিধান রক্ষায় সকলে এককাট্টা রয়েছেন বলে দাবি করছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে সুযোগ এলে কেউই প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি ছেড়ে দেবেন না।

রাহুল গান্ধীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, ২০০৪ বা ২০০৯-এ কংগ্রেসের যে শক্তি ছিল, এখন সেই তুলনায় কংগ্রেস অনেকটাই দুর্বল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে দাঁড়িয়ে ২০২৪-এর কংগ্রেসকে যে ‘পরজীবী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, তাতে আদতে কোনও ভুল নেই। কংগ্রেস বাস্তবিকই লোকসভায় ১০০টি আসনেও জিতে আসতে পারেনি। এই নিয়ে টানা তিনটি লোকসভা ভোটে কংগ্রেস লোকসভায় একশোর গণ্ডি পেরোতে পারল না। বিজেপি এ বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বলে কংগ্রেস উল্লাস করতে পারে, কিন্তু কংগ্রেস নিজে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা-পরবর্তী চুরাশি সালের লোকসভা ভোটের পরে একার জোরে আড়াইশো আসন জিততে পারেনি। দেশের ১৩টি রাজ্যে কংগ্রেস এ বার কোনও আসন জেতেনি। যে সব রাজ্যে কংগ্রেস বনাম বিজেপির মুখোমুখি লড়াই, সেখানে কংগ্রেসের ফল বেশ খারাপ।

লোকসভায় এ বার কংগ্রেসের আসন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু যে ১৬টি রাজ্যে কংগ্রেস একা লড়েছে, সেখানে রাহুল গান্ধীর দলের ভোটের হার কমেছে। গুজরাত, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ— তিনটি রাজ্যের ৬৪টি আসনে কংগ্রেস মাত্র দু’টি আসনে জিতেছে। উত্তরপ্রদেশ থেকে তামিলনাড়ুতে কংগ্রেসের সাফল্য সবটাই অখিলেশ যাদব ও স্ট্যালিনের দাক্ষিণ্যে। এবং যথা সময়ে তাঁরা এর বিনিময়ে নিজেদের পাওনা আদায় করে নিতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে ‘পরজীবী’ বলে নরেন্দ্র মোদীর আক্রমণকে রাহুল গান্ধী যদি সমালোচনার বদলে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ হিসেবে দেখেন, তা হলে কংগ্রেসেরই মঙ্গল।

কংগ্রেসের জন্য আশার কথা হল, প্রথম ভারত জোড়ো যাত্রার পর থেকেই রাহুল গান্ধীর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এই প্রথম মনে হচ্ছে, তিনি রাজনীতি উপভোগ করছেন। আমজনতার সংস্পর্শে প্রাণশক্তি খুঁজে পাচ্ছেন। রাহুল নিজে তা স্বীকারও করছেন। তাঁর ঘন ঘন বিদেশযাত্রা এখন আর খবরের শিরোনামে আসছে না।

রাহুল গান্ধীকে চিনতে হলে, বুঝতে হলে তাঁর ২০১৯-এর হারের পরে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগপত্র বার বার পড়া উচিত। সেই পদত্যাগপত্রের মধ্যে একটা অসহায়তা ছিল। রণক্ষেত্রে একা সেনাপতির বর্ম খুলে তরোয়াল নামিয়ে রাখার গ্লানি ছিল। তিনি তখন থেকেই বলছিলেন, বিজেপি-আরএসএসের থেকে সংবিধানকে রক্ষা করাটাই আসল লড়াই। বিজেপিকে হারাতে হলে প্রথমে নরেন্দ্র মোদীর সুউচ্চ ভাবমূর্তিকে ধাক্কা দিতে হবে। তিনি কংগ্রেসকে মতাদর্শের জন্য লড়াই করা ক্যাডার-ভিত্তিক দল হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। সে সময় রাহুল গান্ধীর পাশে তাঁর দলের নেতারাই দাঁড়াননি। সেই হতাশা থেকেই কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন রাহুল।

এখন গোটা বিরোধী শিবিরের মুখে রাহুল গান্ধীর কথার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সবাই সংবিধানের জয়গান গাইছেন। কিন্তু এ সব সাময়িক। রাহুল গান্ধীর আসল চ্যালেঞ্জ কংগ্রেসের হাল ফেরানো। কংগ্রেস এখনও নেতাকেন্দ্রিক দল। তাই ডুবন্ত নৌকাতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটে না। রাহুল গান্ধীর উচিত, মোদীর বিরুদ্ধে আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া। ঘরোয়া দ্বন্দ্ব সামলানোর কাজ পুরোপুরি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের উপরে ছেড়ে দিলে ভাল।

রাহুল বরং শরিক দলের নেতানেত্রীদের নিয়ে চলা অভ্যাস করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেসেজ করলে পত্রপাঠ তার উত্তর দিন। মনে যা-ই থাকুক, মুখে তা সব সময় প্রকাশ করা চলে না। এটাই রাজনীতির নিয়ম।

আরও পড়ুন
Advertisement