জেতার আগেই পদের দাবি ছাড়লে তার গুরুত্ব কমে যায়
Rahul Gandhi

রাহুল না হলে, কে

বিরোধী জোট প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কাউকে তুলে ধরতে না পারলে বিজেপির পক্ষে ‘নরেন্দ্র মোদীর কোনও বিকল্প নেই’ বলে প্রচার করাও সহজ হয়ে যায়।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৮
Rahul Gandhi.

রাহুল গান্ধী। —ফাইল চিত্র।

ভারত জোড়ো যাত্রার সময় রাহুল গান্ধী প্রতিটি রাজ্যে অন্তত একটি করে সাংবাদিক সম্মেলন করতেন। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রশ্ন উঠত, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে! রাহুল সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, ভারত জোড়ো যাত্রার মূল বিষয় থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে। ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।

Advertisement

রাহুল গান্ধীর সমস্যা হল, তিনি যতই এই ফাঁদ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, তাঁর দলের সিংগভাগ নেতা গান্ধী পরিবারের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন না। তাঁরা এই ফাঁদে পা দেন। বেশির ভাগ সময়ই ইচ্ছাকৃত ভাবে। গান্ধী পরিবারের প্রতি আনুগত্য প্রমাণে তাঁরা সুযোগ পেলেই বলে দেন, কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রাহুল গান্ধীই। তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত। তিনি বলে দিয়েছেন, বিরোধী দলগুলি মিলে ‘ইন্ডিয়া’ নামক জোট করলেও কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রাহুল গান্ধীই। অমিত শাহ আগেই বলেছিলেন, রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরতে কংগ্রেস নতুন করে ইন্ডিয়া জোট তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করছে। গহলৌত কার্যত তাতেই সিলমোহর দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি মাঠে নেমে পড়ে বলেছে, এ হল বিপর্যয়ের পথে বিমান-যাত্রার টিকিট কাটা।

পটনা, বেঙ্গালুরুর পরে এ বার মুম্বইতে বিরোধী জোটের তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলন বসছে। বিরোধী দলগুলির ‘ইন্ডিয়া’ নামক জোটের নেতানেত্রীরা এখনও পর্যন্ত তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী কে, সেই প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে চলছেন। শুধু এড়িয়ে চলা নয়। বিজেপি যাতে কোনও ভাবেই বিরোধী জোটের মধ্যে কোনও এক জনকে তুলে ধরে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে দিতে না পারে, সে বিষয়ে তাঁরা বিশেষ ভাবে সতর্ক। কারণ তা হলেই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের লড়াই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাবে। বিজেপির পক্ষে সযত্নে তৈরি করা নরেন্দ্র মোদীর সুউচ্চ ভাবমূর্তি ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো সহজ হয়ে যাবে।

মুশকিল হল, বিরোধী জোট প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কাউকে তুলে ধরতে না পারলে বিজেপির পক্ষে ‘নরেন্দ্র মোদীর কোনও বিকল্প নেই’ বলে প্রচার করাও সহজ হয়ে যায়। বিরোধী শিবিরের অনেক নেতানেত্রী মনে করেন, লোকসভা নির্বাচনকে রাজ্যওয়ারি নির্বাচন হিসাবে লড়তে হবে। প্রতিটি রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী বিজেপির মোকাবিলা করতে হবে। এটা ঠিকই যে, নরেন্দ্র মোদী নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মাকে কাজে লাগিয়ে আর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বৈতরণি পার করাতে পারছেন না। তা বলে লোকসভা নির্বাচনকে রাজ্যওয়ারি লড়াইয়ের যোগফল হিসাবে দেখলে গোড়াতেই গলতি হতে পারে। জাতীয় স্তরে তাঁর কোনও বিকল্প নেই, তা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিতে নরেন্দ্র মোদী নিজেই তাঁর তৃতীয় দফার সরকারে কী কী কাজ হবে, তা বলতে শুরু করেছেন। এর পাল্টা জবাব হিসাবে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে কী করবে, তা-ও বলা দরকার। তাতে আর্থিক নীতি, দেশের নিরাপত্তা ও বিদেশ নীতির মতো সব বিষয়েই ইন্ডিয়া জোটের ভাবনা কী, তার রূপরেখা থাকা দরকার। বিশেষত ইন্ডিয়া জোট কী ভাবে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার কথা ভাবছে, তা তরুণ ও মধ্যবিত্তের সামনে স্পষ্ট করা দরকার।

রাহুল গান্ধী একাধিক বার বলেছেন, একমাত্র কংগ্রেসই এই বিকল্প ভাবনার সন্ধান দিতে পারে। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি বিজেপি-আরএসএস’এর বিভাজন নীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ভাবনাকে তুলে ধরেছিলেন। তার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব নিয়ে মোদী সরকারের দিকে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছিল ভারত জোড়ো যাত্রা থেকে। এতে কোনও ভুল নেই, সেই চাপের মুখেই এখন মোদী সরকার আজ পেঁয়াজের রফতানিতে রাশ টেনে, কাল চালের রফতানি বন্ধ করে যেন তেন প্রকারেণ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া। ডাক পিয়নের বদলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি চাকরির চিঠি বিলি করছেন। কংগ্রেস নেতারা এই সব দৃষ্টান্ত তুলে ধরেই বলতে থাকেন, রাহুলই একমাত্র জাতীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। তাই তাঁকেই কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়া উচিত।

মুখের কথা ও মনের ভাবনার মধ্যে অবশ্য বিস্তর ফারাক। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ২০২৪-এ ফের মোদী সরকারের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাই প্রবল। কিন্তু কোনও ভাবে যদি ইন্ডিয়া জোট সরকার গঠনের জায়গায় চলে আসে এবং সংখ্যার জোরে আঞ্চলিক দলগুলির বদলে কংগ্রেসই প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হয়ে ওঠে, তা হলে রাহুল গান্ধী আদৌ প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন কি না, তা নিয়ে কংগ্রেসের সিংহভাগ নেতারই সংশয় রয়েছে। তার বদলে রাহুল কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গেকে এগিয়ে দেবেন, এমন সম্ভাবনাই বেশি। ঠিক যে ভাবে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের আগে জেদ ধরেছিলেন, তিনি নিজেও কংগ্রেস সভাপতি হবেন না, সনিয়া বা প্রিয়ঙ্কার মতো গান্ধী পরিবারের অন্য কাউকেও হতে দেবেন না।

রাহুল গান্ধী অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের মনের কথা প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে বলেন না। অনেক রাজনৈতিক প্রশ্নের তিনি দার্শনিক উত্তর দেন। মেঠো রাজনীতি বরাবরই সাদা না কালো, ভাল না খারাপ, হ্যাঁ কি না, তা স্পষ্ট ভাবে শুনতে চায়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব সেখানে প্রশ্রয় পায় না। কিন্তু রাহুল গান্ধী হ্যামলেটের মতো সেই ‘টু বি অর নট টু বি’-র মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন। ২০১৩-য় লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, ক্ষমতা হল বিষ। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হতে নারাজ। আবার ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে বলেছিলেন, দল কোনও দায়িত্ব দিলে তিনি তা পালনে রাজি। ২০১৯-এর আগেও বেঙ্গালুরুতে এক আলোচনা সভায় রাহুল একই কথা বলেছিলেন। সামনে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। রাহুল গান্ধীর কি এখন স্পষ্ট করে বলে দেওয়া উচিত, তিনি এ বার অন্তত প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নেই?

সমস্যা হল, রাহুল গান্ধী যদি এখনই বলে দেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নেই, তা হলে প্রথমেই হার স্বীকার করে নিলেন বলে ভুল বার্তা যাবে। তাতে শুধু কংগ্রেসের সমস্যা নয়, গোটা ইন্ডিয়া জোটের সমস্যা। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদ পাওয়ার পরে তা ছেড়ে দিলে তার মূল্য অনেক বেশি। আগেভাগেই প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে সরে দাঁড়ালে রাজনীতি তার কদর করে না।

২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার গঠনের সময় সনিয়া গান্ধীর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ছিল। তিনি মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে নিজে সরে দাঁড়ান। অন্তরাত্মার ডাক নয়, গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের নেতারা জানেন, সেই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল রাহুল গান্ধীর জেদ। তিনিই চাননি মা প্রধানমন্ত্রী হোন। সনিয়ার সেই সিদ্ধান্ত তাঁর ভাবমূর্তিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস তার রাজনৈতিক সুবিধাও পেয়েছিল। সেই মনমোহন সরকারেই রাহুল গান্ধীর সামনে একাধিক বার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এলেও তিনি তা হতে চাননি। সনিয়াও তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারেননি। রাহুলের তাই কোনও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাই নেই। সেই তুলনায় ইন্ডিয়া জোটে একাধিক রাজ্যের বর্তমান, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রয়েছেন। যাঁদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। কিন্তু তাঁরা ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মায় সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন কি?

দিনের শেষে ইন্ডিয়া জোটের সামনে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইন্ডিয়া জোট কী কৌশল নেয়, বিজেপিও তার অপেক্ষায় থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement