Inequality

সবার মজুরি সমান বাড়ে না

মজুরির হারের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ বেশ নীচের দিকেই, এ রাজ্যে দৈনিক মজুরি ২৩৭ টাকা। মজুরি বৃদ্ধির হারও এক-এক রাজ্যে এক-এক রকম।

Advertisement
ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৩ ০৪:৪৫
An image of  Labours

পশ্চিমবঙ্গে মজুরি ২২৩ টাকা থেকে বেড়ে ২৩৭ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৬.৩%। ফাইল চিত্র।

গত পয়লা এপ্রিল থেকে মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা, অর্থাৎ একশো দিনের কাজ প্রকল্পে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে। নতুন মজুরির প্রস্তাবিত তালিকাটা দেখলে দু’টি জিনিস চোখে পড়বেই। প্রথমত, রাজ্যবিশেষে দৈনিক মজুরির হার পৃথক— হরিয়ানায় সবচেয়ে বেশি, দিনে ৩৫৭ টাকা; সবচেয়ে কম মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তীসগঢ়ে, এই দুই রাজ্যের দৈনিক হার ২২১ টাকা। মজুরির হারের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ বেশ নীচের দিকেই, এ রাজ্যে দৈনিক মজুরি ২৩৭ টাকা। দ্বিতীয়ত, মজুরি বৃদ্ধির হারও এক-এক রাজ্যে এক-এক রকম। যেমন, গোয়ায় বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২.২% (৩১৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২২ টাকা); কিন্তু, রাজস্থানে বেড়েছে ১০.৩৯% (২৩১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫৫ টাকা)। পশ্চিমবঙ্গে মজুরি ২২৩ টাকা থেকে বেড়ে ২৩৭ টাকা হয়েছে— বৃদ্ধির হার ৬.৩%।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, একই দেশের মধ্যে এত ভেদ কিসের? রাজ্যে-রাজ্যে এই ফারাক কিন্তু আজকের ঘটনা নয়, ২০০৫ সালে একশো দিনের কাজ প্রকল্প শুরুর সময় থেকে গত দু’দশক ধরেই বিভিন্ন রাজ্যের মজুরি ভিন্ন। এর পক্ষে প্রধান অর্থনৈতিক যুক্তি হল, রাজ্যগুলির মধ্যে জীবনযাত্রার মানের ও ক্রয়ক্ষমতার ভেদ রয়েছে। এ কথাটা হয়তো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বড় শহরগুলোতে তো বটেই, এমনকি মাঝারি-ছোট শহরেও নাগরিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যুক্তিটা অবশ্যই খাটে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সাধারণ জীবনযাপনের জন্য এক রাজ্যের তুলনায় তার পাশের কোনও রাজ্যের শ্রমিককে ৬২ শতাংশ বেশি মজুরি কেন দিতে হবে, তা বোঝা কঠিন। সরকারের তরফ থেকে এর পক্ষে কোনও হিসাব বা সাফাই দেওয়া হয় না, এ বিষয়ে কোনও নিরপেক্ষ গবেষণাও সম্ভবত হয়নি।

Advertisement

বিভিন্ন রাজ্যে মজুরির ফারাক যদি মেনেও নেওয়া যায়, তার বৃদ্ধির হার আলাদা হবে কেন? কোন রাজ্যে কতটা বাড়ানো হবে, সেটা বোঝার আগে, কেন ঠিক এখনই মজুরি বাড়ানো হল, সে প্রশ্নটা করা দরকার। নিন্দকেরা বলবেন, এটা পরিষ্কার ভোট-মুখী নীতি— যে যে রাজ্যে কয়েক দিন পরেই ভোট হবে, সেই সেই রাজ্যের শ্রমিকদের বেশি খুশি রাখা দরকার।

অর্থনীতির যুক্তি অবশ্য বলবে যে, ভারতে শুধু নয়, সম্প্রতি বিশ্ব জুড়েই মূল্যস্ফীতির হার বেড়েই চলেছে, তাই মজুরি বাড়ানো সরকারের কর্তব্য বইকি। তা হলে রাজ্যে-রাজ্যে ফারাক কেন? উন্নত বিশ্বে, বিশেষত ইংল্যান্ডে, মূল্যস্ফীতির হার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারের পতন সামাল দিতে সরকার নানাবিধ নীতির সাহায্য নিয়েছে। যেমন, ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড গত কয়েক মাস ধরে ধাপে ধাপে সুদের হার ক্রমাগত বাড়িয়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি এখনও তাতে বাগ মানছে না যদিও, সে কথা আলাদা। বিলেতের মতো ১০% না হলেও ভারতের মূল্যস্ফীতির হারও বেশ চড়া, ৬ শতাংশের উপরে।

এ-হেন পরিস্থিতিতে মজুরি কত বাড়ানো উচিত? উত্তর সহজ— সর্বত্রই ৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি হওয়া জরুরি, যাতে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে পারে। খেয়াল করা উচিত, হাতেগোনা রাজ্যেই কর্মসংস্থান যোজনায় মজুরি ৭ শতাংশ বা ততোধিক বাড়ানো হয়েছে।

প্রথাগত মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও বেশি চিন্তার হল জীবনযাত্রার মান। মানতেই হবে যে, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং জীবনযাত্রা ভিন্ন ধারার। তবে, মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেখা দরকার জীবনধারণের জন্য ভোক্তার যা যা প্রয়োজন, সেই সব পণ্যের— পরিভাষায় যাকে বলে ‘কনজ়াম্পশন বাস্কেট’— বাজারের অবস্থাটা। আর এখানে কিন্তু রাজ্যে-রাজ্যে ভেদ প্রায় নেই। ভারতের যে কোনও রাজ্যের যে কোনও গ্রামের জন্য কনজ়াম্পশন বাস্কেট কার্যত একই— আর সেই ভাত-কাপড়ের জোগানের জন্যই দরকার মজুরির। অতএব, মজুরি বাড়ানোর নীতি প্রণয়নের আগে জানতে হবে গ্রামের শ্রমিকের ঠিক কতটা না হলেই নয়।

গত আঠারো বছর ধরে গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক সওয়াল-জবাব, অর্থনৈতিক তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। প্রায় ১৫ কোটি লোকের কর্মসংস্থান করেও এই প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন এখনও অঢেল— যেমন, ১০০ দিনের কাজটা বেড়ে ২০০ দিন কেন হবে না ইত্যাদি। আজ যদি মজুরি বাড়ানো হয়, সে তো আনন্দের; তবু প্রশ্ন ওঠে। দুঃখের কথাটা হল, কেউ সেই প্রশ্নগুলো তুলছেন না।

আরও পড়ুন
Advertisement