বৃহৎ শক্তির কাছে নত হওয়ার শিক্ষা ভুলেছে মানুষ
Delhi Flood

জল বিপদসীমার উপরে

এত বেশি পরিমাণ জল যমুনায় এসে পড়ল কেন, সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। তার পিছনে কোনও ভাবেই কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেই। জুলাই মাসে হিমালয় পাহাড়ে দুই-তিন-চার দিনের প্রবল বর্ষণকে স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়।

Advertisement
জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৩ ০৫:০৮
flood

বন্যা: যমুনার জল ভাসিয়ে দিয়েছে লাল কেল্লার পিছনের রাস্তাটিকে। ভাসছে গোটা অঞ্চলই। ১৫ জুলাই ২০২৩, দিল্লি। ছবি: পিটিআই।

১২ জুলাই রাত একটায় দিল্লির পুরনো রেলব্রিজের নীচে যমুনা নদীর জল স্ফীত হয়ে ২০৭.৫৫ মিটার উচ্চতা স্পর্শ করল, এবং বেড়েই চলল। ফলে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট, রাজঘাট, আইটিও-সহ বিরাট এলাকা তিন থেকে চার ফুট জলের নীচে চলে গেল। পর দিনও সেই জল নামার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। জানা গেল যে, দিল্লি থেকে মাত্র চার ঘণ্টার দূরত্বে হরিয়ানায় যমুনা নদীর উপরে তৈরি হথনী কুণ্ড জলাধারে অতিরিক্ত জল এসে পড়ায় বাধ্য হয়ে জলাধারের ত্রিশটি গেট খুলে দিতে হয়, ফলে প্রথম দু’ঘণ্টা ধরে প্রতি সেকেন্ডে দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার ঘন ফুটেরও বেশি জল দিল্লি শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে এই আকস্মিক প্লাবন ঘটিয়েছে। তার পরও জল বাড়া অব্যাহত থাকে, কিন্তু তার তীব্রতা কমে।

যে কোনও বড় শহরের মতো রাজধানীতেও নিকাশি নালাগুলোর মুখ বন্ধ থাকায় সে জল বেরিয়ে যেতে পারে না। অবশ্য বেরিয়ে কোন দিকে যেত, সেও এক সমস্যা। প্রাকৃতিক ভাবে যে কোনও ভূভাগেরই সবচেয়ে নিচু অংশ হল নদী। ফলে যে কোনও জায়গা থেকে গড়ানো জল নানা পথ বেয়ে নদীতে গিয়েই পড়ার কথা। কিন্তু প্রত্যেকটি শহরের পাশ দিয়ে, এমনকি দূর দিয়ে, বয়ে যাওয়া নদীগুলির পাড় প্রায়ই শহরের চেয়ে উঁচু। বরাক ব্রহ্মপুত্র বা সুন্দরবনের মতো তাদের পাশে উঁচু পাশবাঁধ রয়েছে, যাতে বর্ষা বা বন্যার জল ঢুকতে না পারে। এ ছাড়া আবাসন সৌন্দর্যায়ন, চওড়া রাস্তা— কোনও না কোনও প্রয়োজনে নদীর পাড় কোথাও খোলা নেই। সুতরাং জল বেরিয়ে নদীতে পড়ার পথ বন্ধ। শহরের মধ্যে জল ধারণের যে জলাশয়গুলি ছিল, সেগুলিও সব চাপা পড়েছে। অর্থাৎ জলের যে প্রথম বিশেষত্ব— গড়িয়ে যাওয়া— তার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে শহর।

Advertisement

এত বেশি পরিমাণ জল যমুনায় এসে পড়ল কেন, সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। তার পিছনে কোনও ভাবেই কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেই। জুলাই মাসে হিমালয় পাহাড়ে দুই-তিন-চার দিনের প্রবল বর্ষণকে স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়। কিন্তু সেখানেও সেই বর্ষাজল নেমে আসার পথগুলি অবাধ নেই। যেখানে প্রকৃতিরই প্রাধান্য, সেখানে বসবাসকারী মানুষরা বরাবর প্রকৃতির নিয়মে অরণ্য ও বন্যপ্রাণের মতোই থেকেছেন— অধিক শক্তিমানের নিয়ম মেনে, পাহাড়-জঙ্গল-জলধারায় কোথাও বৃহৎ হস্তক্ষেপ না করে। গত দু’দশকে বহু বার প্রকৃতির সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করে জঙ্গল-নদী-পাহাড়ের প্রাথমিক প্রাকৃতিক স্থিতি নষ্ট করা হয়েছে ‘উন্নয়ন’-এর নামে। সে কাজ করতে গিয়ে শত শত মানুষের প্রাণ গিয়েছে। হিমালয়ে ক্রমাগত বিস্ফোরণ ঘটানোর দরুন যে ভূস্খলন হচ্ছে, তারবীভৎস ক্ষত থেকে হিমাচলপ্রদেশের রক্তপাত এখনও শুকোয়নি। এই সব ধসের কারণে ঝর্না বা নদীর গভীরতা থাকছে না। পাহাড়ি বৃষ্টির জলকে ধারণ করার সহজ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আর, সেই বালিপাথর-সমেত জল যখন নীচে নদীতে এসে মিশছে, স্বভাবতই তা-ও জমছে নদীগর্ভে। বিশেষত যেখানে নদীর ধারার উপরে আড়াআড়ি বাঁধের কিংবা জলাধারের পাঁচিল তোলা হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহপথ রুদ্ধ হয়েছে, তার পিছনে সেই কাদা-বালি-পাথর জমছে আরও অনেক বেশি। নদীর সেই অংশের জলধারণ ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। তার সঙ্গে আছে নদীর দু’পাশ থেকে দখলদারি ক্রমশ নদীতে নেমে এসে তার প্রবহমানতার পথ আরও সঙ্কীর্ণ করে দেওয়া।

এখন ওয়াকিবহাল অনেকেই বলছেন যে, দিল্লি শহরের মধ্যে যমুনার গতিহ্রাসের অন্যতম কারণ, দশ কিলোমিটার ধারার উপরে পঁচিশটি ব্রিজ হওয়া। এর কোনওটিই কিন্তু এক দিনে হয়নি। হিমাচলপ্রদেশের দশ দিন আগেকার জলপ্রলয় যে-হেতু এই যমুনারই উপর দিয়ে নেমেছিল, এবং সেই ধারার সঙ্গে নামছিল গত কয়েক দিন ভয়ঙ্কর ধসে ভাঙতে থাকা পাহাড়, সেই স্থল ও জল যে দিল্লির দিকেই আসছে, এটা অপ্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেই তিন-চার দিনে কিছুই করার ছিল না আর। জলের স্বাভাবিক ধারা রোধ করার দরুন যা কিছু ঘটার, সবই ঘটেছে। নদীখাতে জমা মাটি-পাথর তুলে ফেলার যে পন্থার কথা বলা হয়, তা এতই অবাস্তব যে, এখন হয়তো তা আর ছোটরাও বিশ্বাস করবে না।

শোনা গেল মাননীয় কেন্দ্রীয় জলমন্ত্রী বলেছেন যে, হথনী কুণ্ডের পিছনে কোনও জল জমার প্রশ্ন নেই, কারণ এটি বাঁধ নয়, ব্যারাজ। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী, অবশ্যই তিনি অনেক বেশি জানেন, তবু আমরা, অন্য একটি প্রাচীন ব্যারাজের রাজ্যে ভুক্তভোগী লোকেরা তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করি ১৯৭৫ সালে নির্মিত ফরাক্কা ব্যারাজের পিছনে নদীতে ভেসে আসা পলিমাটি জমে তার গভীরতা ভীতিজনক ভাবে হ্রাস পাওয়ার দিকে। সে ক্ষেত্রে ব্যারাজকে বাঁচানোর জন্য স্লুস গেট খুলে অনিয়ন্ত্রিত জল ছাড়া ভিন্ন উপায় থাকে না।

দিল্লির যে সকল অঞ্চল বিপন্ন হয়েছে, জল নেমে যাওয়ার পর যাঁদের দুর্দশা কয়েক দিনে আরও তীব্র হল, তাঁদের জন্য গভীর সহানুভূতি রইল বহু বার ওই একই দুর্দশাগ্রস্তদের তরফ থেকে। কিছু কথা তবু রয়ে যায়। বন্যা ভারতের মানুষদের কাছে কোনও অজানা বিষয় নয়। এক কালে এখানকার মানুষরা বন্যার সঙ্গে বাস করতে জানতেন শুধু নয়, নিয়মিত নদীবন্যাকে সুচারু ভাবে ব্যবহারও এ দেশের সভ্যতার অংশ ছিল। মাত্র একশো বছর আগেও। আজ তবে দিল্লির জলডুবি আমাদের এতখানি উতলা করছে কেন? কারণ দিল্লিতে গত সপ্তাহে যা ঘটেছে, তার কারণ কোনও ‘ক্লাউড বার্স্ট’ নয়। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অপেক্ষাকৃত শান্ত নদীটির বর্ষাকালীন স্বাভাবিক জলস্ফীতি নয়। এই নদীজপমালা ধৃতপ্রান্তর দেশে অসংখ্য নদীর প্রত্যেকটির উপরে-পাশে-মাথায় যে বেনিয়ম উচ্ছৃঙ্খলা বছরের পর বছর ধরে জমে উঠেছে, আজও উঠছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণামের কিছু অংশ দিল্লিতে ঘটল। উত্তরকাশীতে, কেদার-শ্রীনগরে, ঋষিগঙ্গা-তপোবনে এ রকম বিপর্যয় সাম্প্রতিক কালে বারে বারে ঘটেছে। আমাদের মনে তেমন দাগ কাটেনি। পরের কোনও তুমুল খবরে ঢাকা পড়ে গিয়েছে সেই জনপদগুলির যন্ত্রণাকথা। এ বার দেশের রাজধানী। এই রাজধানীর ক্রমবর্ধমান বৃহত্তর অঞ্চলে জলের প্রয়োজন বেড়েই চলেছে বলে হিমাচল থেকে নেমে আসা ক’টি ছোট-মাঝারি নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে সেই সরবরাহ নিয়মিত রাখা চলছিল, আমরা জানি না।

মাত্র তিনশো বছর আগেও আরাবল্লী আর যমুনা, এই দুই প্রাকৃতিক সুরক্ষার মাঝখান দিয়ে এগারোটি নদীধারা ছিল। তারই কূলে অঞ্চল পাল্টে পাল্টে গড়ে উঠেছে হস্তিনাপুর থেকে নয়াদিল্লি। সমস্ত ব্যবস্থাটি গ্রাস করে ফেলা মহাজনপদ আজ নিজের চাহিদার কাছে পণবন্দি। সেই বন্দিত্বের উগ্র শাসন এক ঝলক দেখা দিয়ে গেল।

টিহরী বাঁধ তৈরির সময়ে বিরোধী বিশেষজ্ঞরা একটা হিসাব দিয়েছিলেন— যদি ওই বাঁধ ভাঙে, তা হলে কত ক্ষণ লাগবে সেই জল ইলাহাবাদ পর্যন্ত পৌঁছতে। ঈষৎ ঠাট্টা করেই বলেছিলেন, ইলাহাবাদ পর্যন্ত নামার হিসাবটা জরুরি, কারণ সেখানে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ছিল। কিন্তু না ভাঙলেও ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকটা বড় বাঁধের পিছনের রিজ়ার্ভার। কেন্দ্রীয় জল কমিশন তেমনটিই দেখায়। প্রতিটি নদীর খাত মাটিতে ভরা।

ভয় পাচ্ছি, অস্থির হচ্ছি কারণ দেশের বিরাট ও প্রাচীন শহরগুলোর অধিকাংশই যে বড় নদীর ধারে। আর, একটি নদীও নেই অগণন বাঁধের শিকলবিহীন। তবে কি ভরে ওঠা রিজ়ার্ভার বাঁচাতে যে কোনও দিন ত্রিশ-পঞ্চাশ-ষাটখানা স্লুস গেট খুলে যাবে যে কোনও জনপদের উপরে?

আরও পড়ুন
Advertisement