সমস্যা বিপুল, কিন্তু বিভিন্ন সূচকে তার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে কি
Society

হাতি নিয়ে লোফালুফি

বিভিন্ন সূচকের অন্তর্নিহিত তথ্য কী ভাবে সংগৃহীত হয়েছে, সেই খোঁজ করলেই বোঝা যাবে যে, বেশির ভাগ সূচক তৈরিতে ব্যবহৃত তথ্যই প্রশ্নযোগ্য।

Advertisement
অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২২ ০৬:১৬
‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ বা ‘কিউএস’-এর মতো সংস্থার তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং নিয়েও আমাদের সমাজে বিস্তর হইচই হয়।

‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ বা ‘কিউএস’-এর মতো সংস্থার তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং নিয়েও আমাদের সমাজে বিস্তর হইচই হয়। প্রতীকী ছবি।

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হতে পারে, তবে ভারত তর্কময়। আয়ারল্যান্ড ও জার্মানির দুই বেসরকারি সংস্থার তৈরি ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’-এর ক্রমতালিকা প্রকাশ পেতেই দেশ জুড়ে বিতর্ক— ভারত সেখানে ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭তম স্থানে। হতাশার দেশজোড়া বহিঃপ্রকাশ গত বছরের তুলনায় ক্রমতালিকায় ছ’ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার জন্য হতে পারে, হওয়া সম্ভব ভারতের চেয়ে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের এগিয়ে থাকার জন্যও। কিংবা হয়তো ক্ষুধার্ত ভারতের প্রতি সহমর্মিতায়। সরকার অবশ্য এই ক্রমতালিকা তৈরির পদ্ধতিকে নস্যাৎ করেছে। আমাদের মতো রাজনীতি-কেন্দ্রিক সমাজের প্রবল টানাপড়েন অবশ্য চলতেই থাকে। বাস্তবিক অর্থেই সূচক বা ক্রমতালিকায় আবিষ্ট আমরা। জীবন-ব্যাপী ইঁদুর-দৌড়ে শামিল হতে হতে স্কোর এবং র‌্যাঙ্কিং-এর সাপলুডো খেলার এক ক্লান্তিকর সংস্কৃতি সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে আমাদের জিনের মধ্যেও।

টমাস পিকেটি-র মতো অর্থনীতিবিদদের নেতৃত্বাধীন প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব-এর তৈরি ‘বিশ্ব অসাম্য সূচক’ হোক, কিংবা সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের তৈরি গণতন্ত্রের সূচক, বা লিঙ্গবৈষম্য অথবা দুর্নীতি নিয়ে ধারণার সূচক— বছরব্যাপী এমন কয়েক ডজন সূচকের খবরে হইচই হয় বার বার। ২০২১-এর শেষে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ইনডেক্স’ নিয়ে দেশ জুড়ে বিস্তর চাপান-উতোরের সময় পিকেটি-কে ইমেলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভারতের সাম্প্রতিক তথ্য তাঁরা কী ভাবে পেয়েছেন। কারণ, ভারতে রোজগার-সংক্রান্ত কোনও সরকারি সমীক্ষা হয় না, সরকারি ভাবে শেষ যে উপভোক্তা সমীক্ষার তথ্য পাওয়া যায়, সেটাও এক দশক পুরনো।

Advertisement

জবাবে পিকেটি যে রেফারেন্সগুলো দেন, তা সবই বেশ পুরনো। সাম্প্রতিক কোনও সমীক্ষার তথ্য সেখানে খুঁজে পেলাম না। বোঝা গেল, সময়ের সঙ্গে রোজগার কী ভাবে বদলাতে পারে, তার বিবিধ অনুমানের ভিত্তিতে আগের তথ্যের পিঠে সওয়ার হয়ে অনুমান করা হয়েছে এখনকার রোজগার ইত্যাদি। অতিমারি-বিধ্বস্ত দেশে বা গোটা পৃথিবীতেই অসাম্য যে বাড়ছে, তাতে কারও বোধ হয় বিশেষ সন্দেহ নেই। কিন্তু অসাম্যের এই সূচক অনেকখানিই অনুমিতির উপর নির্ভরশীল, এবং তা বাস্তবসম্মত কি না, জানার উপায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ হল, অনুমানগুলি বদলালে সূচকের মানও বদলাবে। এ সব ফলাফলের মধ্যে তাই নিহিতই থাকে আঙুল তোলার অবকাশ।

কোনও সূচকের মান নির্ণয়ে কোন কোন বিষয়ে নজর দেওয়া হবে, আর তাদের তুলনামূলক গুরুত্ব কী অনুপাতে হবে, তা ঠিক করা সহজ নয় নিশ্চয়ই। যেমন, আলোচ্য ক্ষুধার সূচকের ক্ষেত্রে দেখা হয়েছে চারটি বিষয়— কত শতাংশ জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় পুষ্টি কম হচ্ছে; পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের কত শতাংশের উচ্চতা তাদের বয়সের জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখার তুলনায় কম; তাদের কত শতাংশের ওজন তাদের উচ্চতার জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখার তুলনায় কম; এবং, শিশুমৃত্যুর হার। ক্ষুধার সূচক পরিমাপে দেখা সম্ভব আরও অনেক কিছুই। কিন্তু কেন চারটি, এবং ঠিক এই চারটি মাপকাঠিই নেওয়া হচ্ছে, এবং তাদের গুরুত্ব কেন সমান, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিশ্চয়ই। রীতিমতো অঙ্ক কষে এ সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত মডেল নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে তেমনটা হয়নি, সেই সন্দেহের কারণও যথেষ্ট। মাপকাঠিগুলি বদলালে, বা তাদের গুরুত্বের বদল ঘটলে ক্ষুধা সূচকের (বস্তুত, যে কোনও সূচকেরই) মানও পরিবর্তিত হতে পারে অনেকটা। উল্টেপাল্টে যেতে পারে ক্রমতালিকাও। তাই এ জাতীয় কোনও সূচকের মান আগের বছরের থেকে সামান্য বাড়ল না কমল, বা বিশ্ব-ক্রমতালিকায় দেশ দু’ধাপ এগোল, না কি তিনধাপ পিছিয়ে পড়ল, সেটা বিশেষ গুরুত্বের হওয়া উচিত নয়। কিন্তু খবরের শিরোনাম হয় সেগুলোই।

বিভিন্ন সূচকের অন্তর্নিহিত তথ্য কী ভাবে সংগৃহীত হয়েছে, সেই খোঁজ করলেই বোঝা যাবে যে, বেশির ভাগ সূচক তৈরিতে ব্যবহৃত তথ্যই প্রশ্নযোগ্য। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার মানুষের ‘ধারণা’র সমীক্ষা করে সংগৃহীত হয় আংশিক তথ্য। কিন্তু রাজা এবং ফকিরের ‘অসুখ’ সম্পর্কিত ধারণাতে যে বিস্তর ফারাক থাকা সম্ভব! ক্ষুধা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণমান পরিমাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন পদ্ধতি কতটা যুক্তিযুক্ত, বা এ সব ক্ষেত্রে কী ভাবে সমীক্ষার ‘নমুনা’ বাছা হয়, বা কী ভাবে তাদের ‘ধারণা’কে সাংখ্যমানে পরিবর্তিত করা হয়, তা নিয়ে রাশিবিজ্ঞান-ভিত্তিক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ বা ‘কিউএস’-এর মতো সংস্থার তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং নিয়েও আমাদের সমাজে বিস্তর হইচই হয়। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন এক নয়, তাদের কর্মপদ্ধতি আলাদা, ভিন্ন তাদের সংশ্লিষ্ট সমাজ, এমনকি সামাজিক কর্তব্যসম্পর্কিত ধ্যানধারণাও। তাই শিকাগো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে বিশ্বভারতীকে এক তুলাদণ্ডে ওজন করা যুক্তিহীন।

ভাবা যাক ‘হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স’-এর কথা, যা পরিমাপ করে একটা দেশের পাসপোর্টের শক্তি। আগে থেকে ভিসা না নিয়ে কোনও দেশের পাসপোর্টধারী ব্যক্তি যত বেশি সংখ্যক দেশে ভ্রমণ করতে পারেন, পাসপোর্টের ক্ষমতা তত বেশি। কিন্তু কোনও পাসপোর্টে ভিসা ছাড়া আমেরিকা যাওয়া যাচ্ছে, না কি যাওয়া যাচ্ছে মোজ়াম্বিক, তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। যে কোনও সূচকেরই পক্ষে-বিপক্ষে হইচই করার আগে বোঝা দরকার এ বিষয়গুলো।

প্রায় দু’দশক আগে শ্রীলঙ্কায় এক কনফারেন্সে কথা বলেছিলাম বিঘ্নিত ক্রিকেট খেলায় ব্যবহৃত ডাকওয়ার্থ-লুইস (এখন ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন) পদ্ধতির অন্যতম স্রষ্টা টনি লুইসের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ক’জন ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন সেই সংখ্যাটাই কি যথেষ্ট হতে পারে? সচিন তেন্ডুলকর আউট হয়েছেন, না হননি; বা বিপক্ষে গ্লেন ম্যাকগ্রা বল করবেন কি না, তার কি কোনও গুরুত্ব নেই? মুচকি হেসে লুইস বললেন, অত জটিল হলে পদ্ধতিটা কেউই বুঝবে না। খেলার মজাই মাটি হবে!

নানাবিধ প্রচলিত সূচকও কিন্তু একই ভাবে সংজ্ঞায়িত। বহু-বিজ্ঞাপিত এই সূচকগুলিও কি তবে হয়ে উঠেছে খেলার প্রকরণ? নিছকই মজা? সরলীকৃত করার প্রয়োজনে হয়ে ওঠে গড়সাপ্টা? পার্থক্য এটাই যে, এই খেলাগুলোতে লোফালুফি করা হচ্ছে অসাম্য, গণতন্ত্র, শিক্ষা, ক্ষুধার মতো জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— ফলে সমাজে যথেষ্ট হইচই পড়ে। হাতি নিয়ে লোফালুফি খেলা নিশ্চয়ই বল লোফার চেয়ে অনেক কঠিন। বস্তুনিষ্ঠা সেখানে সবিশেষ জরুরি। অন্তর্নিহিত তথ্য এবং তার প্রয়োগও হওয়া উচিত প্রশ্নহীন।

আমাদের সমাজে যে ক্ষুধা যথেষ্ট, অসাম্য ব্যাপ্ত, সে নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই। কোভিড-উত্তর দেশে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্যও সম্ভবত ক্রমবর্ধমান। এমনকি ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার ইনডেক্স বা ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট-বর্ণিত রূপচিত্রের চেয়েও পরিস্থিতি খারাপ হওয়া সম্ভব। কে জানে! কিন্তু ক্ষুধার সূচকে আমরা পাকিস্তানের থেকে পিছিয়ে, না জ়াম্বিয়ার চাইতে এগিয়ে, বা আমাদের সমাজের অসাম্য ভুটানের চেয়ে বেশি, না ইয়েমেনের চেয়ে কম— এ সব তুলনা নিছকই ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করা।

আমাদের সমাজে তাই ক্ষুধা, দারিদ্র, অসাম্য, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে শাসক, বিরোধী, এবং অবশ্যই সচেতন নাগরিকদের নিয়মিত হইচইয়ের প্রয়োজন আছে। তবে এ সব আলোচনা, গঠনমূলক সমালোচনা ইত্যাদি জারি থাকুক সম্বৎসর। কেবলমাত্র এই গড়সাপ্টা সূচক আর র‌্যাঙ্কিংগুলি নিয়ে লোফালুফি খেলার সময় নয়।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আরও পড়ুন
Advertisement