আদর্শগত সংগ্রামে সবচেয়ে বড় সহায় সাধারণ মানুষ
Society

আমাদের টিনের তলোয়ার

দ্য ফিউচার ইন দ্য পাস্ট নামক গ্রন্থে ‘ইন ডিফেন্স অব হিস্ট্রি’— ইতিহাসের সপক্ষে— নামক একটি অধ্যায়ে নবতিপর ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপর ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসের বহু স্বরের কথা।

Advertisement
কৌশিক সেন
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:২১
protest.

সম্মেলক: বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবিতে প্রতিবাদী মিছিল, যন্তর মন্তর, দিল্লি, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬। —ফাইল চিত্র।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে লেখা ‘ধ্বংসস্তূপে আলো’-তে কবি শঙ্খ ঘোষ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। দাঙ্গা যখন হয়, তখন তাকে প্রতিহত করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু আগুন যখন স্বাভাবিক নিয়মেই নিবে যায়, আমরা ভাবি সাম্প্রদায়িকতা বুঝি প্রতিহত হল। শঙ্খ ঘোষ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন দাঙ্গাকে আটকানোর পর প্রাথমিক ত্রাণ আর প্রাথমিক স্লোগানের পরে ভাবনা শুরু করতে হবে প্রতি দিনের জীবিকা নিয়ে, প্রতি দিনের দায়িত্ব নিয়ে, অধিকার নিয়ে, প্রতি দিনের শিক্ষা নিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে। শঙ্খ ঘোষের লেখায় শুধুমাত্র আক্ষেপ, উপদেশ বা সমালোচনা ছিল না। ছিল আত্মসমালোচনা এবং আত্মানুসন্ধানের আকুতি।

দ্য ফিউচার ইন দ্য পাস্ট নামক গ্রন্থে ‘ইন ডিফেন্স অব হিস্ট্রি’— ইতিহাসের সপক্ষে— নামক একটি অধ্যায়ে নবতিপর ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপর ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসের বহু স্বরের কথা। ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চা ও রচনার কাঠামোকে ভেঙে বেরিয়ে কী ভাবে পড়তে হবে ইতিহাসকে, সেই কথা জানান আমাদের এই অক্লান্ত শিক্ষিকা। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন, ইতিহাসচর্চা, গবেষণা ও পাঠের যে নব নব ধারা স্বনির্ভরতার পথে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, সেই বৌদ্ধিকচর্চা আটকে দেওয়ার ক্ষতিকর রাজনীতির প্রকাশ ঘটিয়েছে বর্তমান ভারতবর্ষের বিজেপি সরকার, যে অশুভ প্রভাবের লক্ষণ নতুন ভাবে প্রকট হয়েছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। তার চালক রাজনীতির বার্তা ছিল: বাবরি মসজিদ ধ্বংস হল গজনির সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণ ও সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের পাল্টা দাওয়াই, এ পথেই ইতিহাসকে সমান সমান করে দেওয়া গেল। এই ভ্রান্ত এবং বিপজ্জনক ধারণা প্রচণ্ড দ্রুততার সঙ্গে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষ থেকে শুরু করে যাঁরা মুক্তচিন্তার অধিকারী, তাঁরা সকলেই ইতিহাসের এই ইচ্ছাকৃত ভুল ও বিপজ্জনক ব্যাখ্যায় ভীত, আশঙ্কিত এবং আক্রান্ত। কবে, কখন, কী ভাবে কাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে জেলে পোরা হবে কেউ জানেন না।

Advertisement

এক কবি এবং এক ইতিহাসবিদ ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন ভাবনায় আমাদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন প্রশ্নটা আসলে শুধুমাত্র এক দিন, দু’দিন অথবা দশ দিন ধরে চলা একটা দাঙ্গা বা ধ্বংসকাণ্ডের নয়, আমাদের ভিতরে যে অবিশ্বাস আর বিভেদের সাপটা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে, সেই সাপটাকে চিন্তিত করতে এবং বিতাড়িত করতে যত দেরি করব, তত পুষ্ট হবে সে। অথচ, আমরা জানি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে বেশির ভাগ মানুষই সুস্থ ভাবে ও সভ্য ভাবে বেঁচে থাকতে চান। বেঁচে থাকতে চান একত্রে পরস্পরের অবলম্বন হয়ে। আমার দেশ এখনও শ্মশান হয়ে যায়নি, কারণ আমার দেশের খেতে না-পাওয়া, শিক্ষা না-পাওয়া, বেঁচে থাকার ন্যূনতম পুঁজিটুকু না পাওয়া গরিব মানুষ এখনও বড় সভ্য, বড় সহনশীল। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো, এক দিন কেউ এসে আমার বসবার ঘরে খাটিয়া এনে শুয়ে বলবে, ‘আমার গাছতলা ভাল্লাগে না’। কিংবা ধানখেতে কাদাজল মাখা বিরাট উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া এক জন মানুষ হয়তো আমার সদ্য কেনা গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলবে, “তোমরা যারা কোনো দিন কাদাজল মাখোনি... সেই তোমরাই শস্য নিয়ে রাহাজানি করো, আর আমার সন্তানরা থাকে উপবাসী, তোমাদের লজ্জা করে না? আমি আসছি...”। কিন্তু ওঁরা আসেন না। আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। ওঁরাও ঘুমোন, ক্লান্তিতে, লকডাউনের ভারতবর্ষে, দীর্ঘ পথ পার হওয়ার পর রেললাইনের উপর। ঘুমোন, ঘুমিয়েই থাকেন, যত ক্ষণ না রেলগাড়ির চাকা পিষে দিচ্ছে ওঁদের।

এই যে আমার দেশের মানুষ, যাঁরা শঙ্খ ঘোষের কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়েননি, জানেন না রোমিলা থাপরের নাম, সেই তাঁদের ধর্মের নামে, জাতের নামে, রাজনৈতিক পতাকার রঙে বিভ্রান্ত করার আয়োজন সারা ক্ষণ চলছে। কমবেশি সমস্ত রাজনৈতিক দল এই কপটতার অংশীদার। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন বিরোধীদের যে, মনোনয়ন জমা দিতে না পারলে তাঁরা যেন ওঁর কাছে যান, তখন নগ্ন হয়ে পড়ে ক্ষমতার আস্ফালন। তৈরি হয় এই শঙ্কা যে, তৃণমূল কংগ্রেস, যারা পশ্চিমবঙ্গে প্রবল ভাবে ক্ষমতায় আছে, তারা একটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য জুড়ে এমন এক অস্থির এবং সন্ত্রস্ত পরিবেশ তৈরি করে, এরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন থাকবে কী ভাবে?

শঙ্খ ঘোষের কথাতেই ফিরে যাই। দাঙ্গা নাহয় পুলিশ, সামরিক বাহিনী, প্রশাসনিক তৎপরতা দিয়ে ঠেকানো গেল, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাকে আটকানো যাবে কী উপায়ে? নির্বাচনে জয়ী হওয়াটা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন বিজেপি আরএসএস-এর মতাদর্শকে রুখে দেওয়া। ইতিহাসকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করে হিন্দুত্বের যে পাঠ এরা দেশবাসীকে গেলাতে চাইছে, তা তো আদতে তাদের প্রাণপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের বিপজ্জনক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রয়াস। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই মতাদর্শকে আরও ক্রূর ভাবে আরও কূট ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত। একটা-দুটো নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায়, কিন্তু এই দক্ষিণপন্থী ও বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজন প্রতি দিনের আদর্শগত সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের সবচেয়ে বড় সহায় সাধারণ মানুষ। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সাধারণ মানুষকে আজ্ঞাবহ ভোটার হিসাবেই দেখতে চায়, তাই তারা মতাদর্শগত সংগ্রামে কতটা আগ্রহী, সেই সন্দেহ থেকেই যায়।

রোমিলা থাপর ‘সার্চিং ফর দ্য পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ বা জনপরিসরের বুদ্ধিজীবীর সন্ধানে শীর্ষক একটি লেখায় ব্যাখ্যা করেন, কী ভাবে এক জন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে নানান ভাবে আক্রান্ত, তবু তাকে মুখ খুলতেই হবে, দাঁড়াতেই হবে প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের বিপরীতে। তার জন্য প্রয়োজন দেশের মানুষকে চেনা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটি নাটক জন্মান্তর প্রযোজনা করেছে ‘মুখোমুখি’ নাট্যদল। পৌলমী চট্টোপাধ্যায়-বিলু দত্তরা মিলে সৌমিত্রবাবুর একটি অপূর্ণ ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়েছেন। তিনি কেন বহু বার এই নাটকটি মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন, তা বুঝলাম প্রযোজনাটি দেখার পর। সময় কিছু শিল্পকর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে, আরও পরিণত ভাবে প্রকাশ করার পরিসর দেয়। এই নাটকটি উনি লিখেছিলেন ১৯৯৩ সালে। নাটকটি মঞ্চস্থ হল ২০২৩ সালে। বাবরি মসজিদ ভাঙা, পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা আরএসএস-এর প্রভাব, বাম জমানার অধঃপতন, সমস্তই স্পষ্ট। ১৯৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই, কিন্তু ২০২৩-এ বসে এ নাটক দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে আপনি বাম জমানা পার হয়ে পৌঁছে গেছেন তৃণমূলের রাজত্বকালে, কিন্তু গরিব মানুষের উপর দলীয় রাজনীতির পীড়নের কোনও হেরফের হয়নি, বরং নতুন মাত্রা পেয়েছে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রচিত এই নাটক আমাদের রাজ্য ও দেশের গরিব, ভূমিহীন, খেতে না-পাওয়া মানুষদের দুর্দশার কথা বলে। জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার রুপোলি পর্দার জনপ্রিয় নায়ক, এই নাটকের মূল চরিত্র, নতুন ধরনের চলচ্চিত্র বানাবে বলে এসে পড়ে এক গ্রামে, এসে ওঠে ওই গ্রামেরই এক বিত্তশালী ব্যক্তির বাড়িতে, যে এক সময় টালিগঞ্জে বাংলা চলচ্চিত্রে টাকা লগ্নি করেছিল। নায়ক জ্যোতির্ময় ক্রমশ চিনতে পারে তার দেশটাকে, বুঝতে পারে এ ভাবেও জন্মান্তর হয়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, বর্গা আইন, সব কিছুর শুরুটা যতই মহৎ হোক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু কুক্ষিগত করে নেয় মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবান। তাদের হাতের পতাকার রংগুলো বদলে যেতে থাকে। সবিস্ময়ে একটা সময় নায়ক জ্যোতির্ময় তার সহকারী অরূপকে বলে, “বেশি টাকার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেসটা এই রকমই। এক্সপ্লয়েট অ্যান্ড প্লান্ডার। নইলে হবে না। তুই-আমিও এদের এক্সপ্লয়েট করা টাকার সামান্য শেয়ার পেয়েছি কিন্তু। গোবিন্দবাবু এই সব টাকাই তো ছবিতে ইনভেস্ট করেছিলেন না?” গ্রাম পর্যবেক্ষণ করতে আসা জ্যোতির্ময়ের চোখ দিয়ে যেন আমাদেরও জন্মান্তর ঘটে।

রোমিলা থাপরের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল-এর বর্ণনা অনুযায়ী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর সাধ্যমতো, সামর্থ্যমতো সময়-এর দাবি মেনে কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। নিজের অপারগতা, নিজের না-পারাগুলোকেও ব্যক্ত করেছেন তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। ২০২০ সালের এক রাতে তিনি লিখছেন, “আর্ট ইজ় দ্য প্র্যাক্টিস অব আর্ট— তার অভাবে শিল্পী যে দৈন্যের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায় তার বেদনা অসীম। তবু এই খাতাটার সাঁকো যদি সৃষ্টিশীলতার দূর পাড়ে পৌঁছতে সাহায্য করে তবে তাই করার চেষ্টা করব। আমার তো হাতে অন্য কোনও হাতিয়ার নেই।”

এই হাতিয়ারই আমাদের মস্ত অবলম্বন। রাজনৈতিক দলগুলির মিথ্যে গলাবন্দি আর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে এই হাতিয়ারই আমাদের টিনের তলোয়ার।

আরও পড়ুন
Advertisement