Bulldozer Politics

শাসনযন্ত্র যখন প্রাণ কাড়ে

কানপুরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে মূল অভিযুক্ত জ়াফর হায়াত হাসমির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বাড়ি কিছুটা ভেঙে দেয় কানপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটি।

Advertisement
আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ ০৫:৫১
Picture of demolition through bulldozer.

প্রশাসনের ‘কড়া পদক্ষেপ’ করার উপায় হিসেবে শুরু হয়েছে বুলডোজ়ারের বহুল ব্যবহার। ফাইল চিত্র।

গরু যে ভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে পুরোদস্তুর এক রাজনৈতিক অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই ভাবেই বুলডোজ়ারও হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক যন্ত্র— বন্দুক ও কার্তুজের মতোই। প্রশাসনের ‘কড়া পদক্ষেপ’ করার উপায় হিসেবে শুরু হয়েছে বুলডোজ়ারের বহুল ব্যবহার। গত বছর জুন মাসে সহারানপুর ও কানপুরে হিংসা ছড়ানোয় মূল অভিযুক্তদের সম্পত্তি ধ্বংস করার কাজ শুরু করে উত্তরপ্রদেশ সরকার। ‘কড়া শাসনের যন্ত্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই বুলডোজ়ার। সহারানপুরে অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগে ধৃত দুই অভিযুক্ত মুজ়াম্মিল ও আব্দুল ওয়াকিরের বাড়ি বুলডোজ়ার চালিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। কানপুরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে মূল অভিযুক্ত জ়াফর হায়াত হাসমির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বাড়ি কিছুটা ভেঙে দেয় কানপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটি। কানপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটি যদিও জানায় যে অনুমোদিত নকশার বহির্ভূত হওয়ায় ওই অংশটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। কানপুরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (আইনশৃঙ্খলা) আনন্দপ্রকাশ তিওয়ারি বলেন, “ওই সম্পত্তিতে মূল অভিযুক্তের বিনিয়োগ ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।”

প্রশাসন 'কড়া পদক্ষেপ' করছে— এই ভেবে অনেকেই উল্লসিত হতে পারেন, হয়েওছিলেন। সুশাসন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনের এই কঠোর মুখ— এমন মনে করে, নৈতিকতার প্রশ্নটিকে সরিয়ে রেখে সাময়িক ভাবে প্রশংসা আদায়ের চেষ্টাও হয়। এর পর অবৈধ জমি ও সম্পত্তির দখল উচ্ছেদের জন্য ব্যবহার শুরু হয় বুলডোজ়ারের। আর এই বুলডোজ়ার চালিয়ে ‘সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার’ করতে গিয়েই এ বার কানপুরে রুবা এলাকার মাদৌলি গ্রামে প্রাণ গেল প্রমীলা দীক্ষিত ও তাঁর মেয়ে নেহার। পুলিশ প্রথমে আত্মহত্যার তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলেও পরবর্তী কালে মহকুমা শাসক, পুলিশ আধিকারিক ও বুলডোজ়ার চালক-সহ মোট তেরো জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করে। ডিভিশনাল কমিশনার রাজ শেখর আশ্বাস দিয়েছেন, “তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দোষীদের রেয়াত করা হবে না।” উঠছে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রসঙ্গ, সেই সঙ্গে প্রমীলা দেবীর পরিবারকে জমি, ছেলেকে চাকরি দেওয়ার কথাও। প্রমীলা দেবীর ছেলে শিবম আক্ষেপ করে বলেছেন, “ঘরে যখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল, মন্দির ভেঙে দেওয়া হল, সকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মা আর বোনকে পুড়ে যেতে দেখল। কেউ কিছু করল না। জেলাশাসকও কিছু করলেন না।” মনে পড়তে পারে, যোগী আদিত্যনাথের জয়ের পর মথুরার বিজেপি সাংসদ হেমা মালিনী বলেছিলেন, “বুলডোজ়ারের সামনে কিছুই দাঁড়াতে পারে না।” ঠিক কথাই। বুলডোজ়ারের সামনে আসলে কিছুই দাঁড়াতে পারে না।

Advertisement

আর চিন্তাও সেখানেই। গত বছর উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার আগেই বোঝা গিয়েছিল, এই যন্ত্রটি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে এবং তার পরবর্তী কালেও এক বিশেষ ভূমিকা নেবে। সেই আশঙ্কা সত্যি করে যোগী হয়ে উঠলেন ‘বুলডোজ়ার বাবা’। আরও ভয়ঙ্কর যা— এই প্রবণতা শুধু উত্তরপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ রইল না। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানও বুলডোজ়ারের ‘কড়া শাসন’ দেখিয়ে হয়ে উঠলেন ‘বুলডোজ়ার মামা’।

গণতন্ত্র বা ‘ডেমোক্র্যাসি’র যে ‘ডেমোস’ তা কিন্তু আসলে খুব সুশৃঙ্খল জনতা নয়, ‘মত্ত’ জনতা। যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সর্বদা নেতারও থাকে না। সেটা বুঝতে আমাদের খুব বেশি কষ্ট হবে না যদি আমরা মহাত্মা গান্ধীর দিকে তাকাই। তাঁর মতো ‘গণ’মোহিনী কর্তৃত্বের হাত থেকেও অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের রাশ চলে গিয়েছিল, ঘটেছিল চৌরিচৌরার ঘটনা।

সমস্যা হল, চলতি প্রথা ও রীতিনীতির বাইরে গিয়ে শাসনকাঠামোয় নতুন কিছু শুরু হলে তা প্রায় উন্মাদনার পর্যায়ে চলে যায়। শাসনতন্ত্রে নতুন এই ‘কড়া শাসনের যন্ত্র’ সেই কাজটাই করেছে। তার ব্যবহার সাময়িক এক জনপ্রিয়তা এনে দেয় বটে, তবে নেতৃত্বের হাত থেকে এর রাশ চলে গেলে তা হতে পারে প্রাণঘাতী। আমলাতন্ত্র সাধারণত রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অনুগত ও আজ্ঞাবহ হিসেবেই কাজ করে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকিপ্রতিভা স্মরণ করা বিধেয়, “কৃপাণ খর্পর ফেলে দে দে!/ বাঁধন কর ছিন্ন, মুক্ত কর এখনি রে...” বাল্মীকির এই আদেশের পরেই আনুগত্য সরিয়ে “রাজাটা খেপেছে রে, তার কথা আর মানব না।” বেরিয়ে আসতে কিন্তু বেশি সময় লাগেনি। বাল্মীকি শেষ পর্যন্ত দস্যুদলকে নিরস্ত করে অসহায় বালিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আয় মা, আমার সাথে, কোনো ভয় নাহি আর।”

“রাজা মহারাজা কে জানে, আমিই রাজাধিরাজ।/ তুমি উজির, কোতোয়াল তুমি,/ ওই ছোঁড়াগুলো বরকন্দাজ।”— এমন ঘোষণা হলে আমরা কি কোনও দিন কোনও এক বাল্মীকিকে একই ভাবে সামনে এগিয়ে আসতে দেখব? বুলডোজ়ারের দানবীয় অস্তিত্বকে স্তব্ধ করে যিনি বলতে পারবেন, ‘কোনো ভয় নাহি আর’?

আরও পড়ুন
Advertisement