দিল্লির সব সরকারই উদ্বাস্তুদের প্রতারণা করে চলেছে
Refugees

উদ্বাস্তু থেকে অপরাধী

১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু হত্যা ও নির্যাতনের মর্মান্তিক পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ চলে আসেন, পালিয়ে এলেন তফসিলি মুসলিম ঐক্যের প্রতীক পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।

Advertisement
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৬
refugees

দেশান্বেষী: ভারত ও বাংলাদেশ সীমানা পেরিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে পশ্চিমপানে। ১৯৭১।

বা‌ংলার উদ্বাস্তু সমস্যার অবহেলার শুরু একেবারে দেশভাগের সময় থেকেই। পঞ্জাবে সংখ্যালঘু বিনিময় হল, বাংলায় হল না। ভারতের অন্তর্ভুক্ত (পূর্ব) পঞ্জাবে ১৯৪১ সালে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৩৩.১%, বিনিময়ের ফলে তা ১৯৫১ সালে কমে হল ১.৮%। এই সমাধান বাংলায় গ্রহণ করা হল না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু উদ্বাস্তু আগমন অব্যাহত রইল।

Advertisement

১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু হত্যা ও নির্যাতনের মর্মান্তিক পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ চলে আসেন, পালিয়ে এলেন তফসিলি মুসলিম ঐক্যের প্রতীক পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। সংসদে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য সাংসদ দাবি তুললেন সংখ্যালঘু বিনিময়ের। প্রধানমন্ত্রী নেহরু সে প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খানের সঙ্গে চুক্তি করলেন যাতে বলা হল দু’দেশের সংখ্যালঘুরা যে যার দেশে ফিরে যাবে। বাংলার উদ্বাস্তুদের সঙ্গে নেহরু ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের প্রতারণার ইতিহাসের সেই শুরু। নেহরু মন্ত্রিসভার দুই বাঙালি মন্ত্রী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী দু’জনেই এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করলেন। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যাকে পাকাপাকি প্রতিষ্ঠিত করে দিল দিল্লির সরকার।

প্রতারণার রেশ চলল উদ্বাস্তু পুনর্বাসনেও। পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক অন্যান্য সাহায্যের টালবাহানা ইত্যাদি নিয়ে উত্তাল হল বাংলার উদ্বাস্তু আন্দোলন। কিন্তু ১৯৭১ পর্যন্ত নাগরিকত্ব প্রসঙ্গটি ওঠেনি। কংগ্রেস সরকার সবাইকেই এই দেশের মানুষ বলে গ্রহণ করেছে, যাঁরা সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁদের জন্য সাহায্য বা পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা নিয়েছে তা অপ্রতুল হলেও। ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনে অবিভক্ত ভারতের অংশ (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে আসা ভারতীয় বংশোদ্ভূত যে কোনও ব্যক্তিরই ভারতীয় নাগরিক হওয়ার অধিকার স্বীকৃত, নাগরিকত্বের শংসাপত্রের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে আবেদন সাপেক্ষ। সরকারি চাকরি, কিছু ব্যবসা ইত্যাদি ছাড়া নাগরিকত্ব প্রমাণের তেমন কোনও প্রয়োজন কারও পড়েনি, উদ্বাস্তুদের এ নিয়ে ভাবতে হয়নি। ফলে উদ্বাস্তুদের অনেক দাবির মধ্যে কোথাও নাগরিকত্বের দাবি আসেনি। বরং এই সময়ের নির্বাচনে উদ্বাস্তুদের ভোটে বামপন্থী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিলে ভারত সরকার একটি সার্কুলার জারি করে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের আবেদন নেওয়া বন্ধ করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গঠিত হয়, কিন্তু এই ঘোষণা জারি থাকে। ৯ মে, ১৯৭৫-এ সংসদে ভারত সরকার যে নীতি ঘোষণা করে তাতে বলা হয় যে, ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে আসা কাউকে ভারতে স্থান দেওয়া হবে না। এ ভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের আবেদন করা বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার।

তখন থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা হয়ে গেলেন এক নেই-রাষ্ট্রের মানুষ। তাঁরা উদ্বাস্তু নন, নাগরিক হতেই পারবেন না, ফলে এই অদৃশ্য উদ্বাস্তুরা তাঁদের পরিচয় তৈরি করলেন ভুয়ো কাগজপত্র দিয়ে বানানো আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি। এ পর্যন্ত তা-ও চলছিল, কিন্তু হিন্দু উদ্বাস্তুদের উপর সবচেয়ে নির্মম আঘাতটি হানল ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে এনডিএ-র কেন্দ্রীয় সরকার। ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনে নতুন একটি বিষয় যুক্ত হল: বেআইনি অভিবাসী অর্থাৎ যাঁরা বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশ করেছেন। কংগ্রেস বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল, বিজেপি আর এক ধাপ এগিয়ে সেই উদ্বাস্তু সমাজের অস্তিত্বকেই বেআইনি করে দিল, উদ্বাস্তুরা হয়ে গেলেন অপরাধী। শুধু তা-ই নয়, এঁদের সন্তানসন্ততি, পরবর্তী প্রজন্ম সবাই বেআইনি অভিবাসী, অপরাধী। রাজ্যসভায় মনমোহন সিংহ ও জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী প্রতিবাদ করলেন, কিছু হল না। এই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন বা অর্থনৈতিক সাহায্য তো দূরের কথা, দিল্লির এনডিএ সরকারের পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা উদ্বাস্তু সমাজকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিল। আজকের নাগরিকত্ব নিয়ে এত বিতর্ক, আন্দোলনের শুরুর কারণ এটাই।

দশ বছর পর ২০১৪ সালে আবার দিল্লিতে একক শক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হল ভারতীয় জনতা পার্টি। দশ বছর পূর্বে কৃত অন্যায়ের প্রতিকারে আনা হল নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বা সিএএ। ২০১৬ সালে সংসদে আনা এই প্রস্তাব সেই লোকসভার আয়ুতে পাশ করাতে অক্ষম হল কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্বাস্তুরা উদ্বেগে রইলেন। ২০১৯-এর নতুন সংসদে ১১ ডিসেম্বর পাশ হয়ে গেল সিএএ। যদিও আইনটির প্রধান ত্রুটি এই যে, কেবলমাত্র ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আসা উদ্বাস্তুরা এই আইনের সুবিধা পাবেন। আইনটির লক্ষ্য নির্যাতনে চলে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় নিশ্চিত করা, কিন্তু সেই আক্রমণ কি ২০১৫ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গেছে? আসলে দিল্লির সরকার বাংলার উদ্বাস্তুদের নিয়ে আইন করার সময় তার নিজের দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্বাস্তু কর্মকাণ্ডের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ন্যূনতম প্রয়োজন বোধ করে না, সবই হয় দিল্লির একক মর্জিতে। আইন পাশ হলে তা প্রণয়নের জন্য এর বিধি বা রুল তৈরি করতে হয়। এই বিধি তৈরি করা কোনও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়, একটি বিধির নমুনা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল উপযুক্ত দফতরেও। কিন্তু চার বছর সময় লাগল সেই বিধি প্রণয়নে। এই অমার্জনীয় অন্যায় আড়াল করতে বিভিন্ন কুযুক্তি দেওয়া হল, কোভিড ইত্যাদি, যদিও আইপিএল ক্রিকেট থেকে নির্বাচন, দেশের কোনও কাজ এর মধ্যে বন্ধ থাকেনি। এই ইচ্ছাকৃত বিলম্ব ছিল উদ্বাস্তুদের প্রতি চরম অবজ্ঞার সূচক। এই বিধির প্রস্তুতিতেও পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের কোনও মতামতের তোয়াক্কা করেনি দিল্লির সরকার। তার পর, যেন নির্বাচনের সুবিধা তুলতে, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রকাশিত হল সেই বহুপ্রতীক্ষিত সিএএ-র বিধি। ১৯৫৫ সালে অর্থাৎ ৭০ বছর আগে নাগরিকত্ব আইনে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য যে বিধি ছিল, এই ২০২৪-এর নতুন বিধি সামান্য বদল-সহ একেবারে তার জ়েরক্স কপি। এই বিধি তৈরি করতে দু’চার দিনের বেশি সময় লাগে না। দিল্লির সরকারের উদ্বাস্তুদের প্রতারণার এ এক চরম উদাহরণ। তার পর এই বিধিতে চাওয়া হল উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে বসবাসের শংসাপত্র, অগাধ জলে পড়লেন উদ্বাস্তুরা। বিভিন্ন আক্রমণ অত্যাচারের সময় কোনও ক্রমে অবৈধ ভাবে ভারতে পালিয়ে আসা মানুষজন কি শংসাপত্র নিয়ে আসতে পারেন? কেউ এসেছেন চল্লিশ বছর আগে, কেউ পঁচিশ বছর আগে, থেকেছেন রেললাইনের ধারে ভাঙা ঝুপড়িতে, মাঠেঘাটে, অনেক বার পাল্টাতে হয়েছে সেই সামান্য আশ্রয়টুকুও। তার মধ্যে তোরঙ্গে গুছিয়ে রাখতে হবে শংসাপত্র!

ফলে এই বিধি উদ্বাস্তুদের সঙ্গে প্রতারণা মাত্র। এ ছাড়াও বিধিতে আছে আরও অন্যায্য দাবি। উদ্বাস্তুরা এর থেকে মুখ ঘুরিয়েছেন, তবু ঝাঁপিয়েছে কিছু সুযোগসন্ধানী, যারা আশ্বাস দিচ্ছে আবেদন করতে, পরে জোগাড় করা যাবে জাল শংসাপত্র। আর যদি আবেদন গ্রাহ্য না হয় তবে কী হবে? কারণ আবেদনে আপনি নিজেই হলফনামা দিয়েছেন আপনি বাংলাদেশি নাগরিক, তা হলে একমাত্র সমাধান ভারত থেকে নির্বাসন। অন্ধকার ভবিষ্যতের সামনে বাংলার অবহেলিত প্রতারিত উদ্বাস্তুরা।

গত ৭৫ বছরের পূর্ব পাকিস্তান/ বাংলাদেশের ইতিহাস দেখায় যে, মুসলিমপ্রধান এই দেশে কখনও হিন্দু নির্যাতন বন্ধ হয়নি। স্বাধীনতার সময়ে সব দেশনেতার প্রতিশ্রুতি ছিল উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন। ফলে উদ্বাস্তুদের আগমনের কোনও দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা অন্যায়, তা প্রত্যাহার করা আশু প্রয়োজন। প্রয়োজন সব উদ্বাস্তুকে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদান। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের অন্ধকার নিরসনের উপায় পশ্চিমবঙ্গকেই ভাবতে হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement