Adani Group

কয়েকটি সংখ্যায় আদানি-কাণ্ড

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট আরও বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক করেছে, যার ভিত্তিতে আমরা গত কিছু সপ্তাহ ধরে আদানি গোষ্ঠীর কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি।

Advertisement
দিগন্ত মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:০৬
adani.

প্রতীকী ছবি।

জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আদানি গোষ্ঠী নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দোষারোপ ও পাল্টা দোষারোপ, রাজনৈতিক চাপানউতোর ইত্যাদি বাদ দিয়ে যদি জানতে চাওয়া হয় যে, নিছক অঙ্কের হিসাবে গোলমালগুলো কোথায় ছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনেকের কাছেই এখনও অস্পষ্ট। এই লেখায় আমরা শুধু সংখ্যার হিসাব দিয়ে সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করব। প্রথম সংখ্যাটি হল ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দামের অনুপাতে বাজারে তার ঋণের পরিমাণ। কোনও ব্যবসায়িক সংস্থা যদি শেয়ার বিক্রি করে দু’কোটি টাকা তোলে, আর এক কোটি টাকা বাজার থেকে ঋণ নেয়, তা হলে সেই সংস্থাটির ক্ষেত্রে এই অনুপাত হবে ১/২। এই অনুপাত ২-এর উপরে যাওয়া সুলক্ষণ নয়। আদানি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অনুপাতটি ছিল ২০— শেয়ার বিক্রি করে এক টাকা পেলে বাজার থেকে ঋণবাবদ সংস্থাটি তুলত ২০ টাকা।

কোনও কোনও সময় এমনটা ঘটতে পারে— বিশেষত, কোনও নতুন সংস্থার ক্ষেত্রে, যার হাতে নতুন ধরনের দুর্দান্ত কাজের সুযোগ আছে, কিন্তু বাজারে সংস্থার শেয়ারের অত কদর হয়নি, তাকে বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বেশি ধার করতে হতে পারে। কিন্তু আদানি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে, তাদের ব্যবসার পরিমাণও বহু হাজার কোটি টাকা। তাদের জন্য এই অনুপাত অস্বাভাবিক। শেয়ারের মূল্য যদি এতটাই কম হয়— অর্থাৎ, বাজার যদি সংস্থাটিকে যথেষ্ট মূল্যবান না মনে করে— তা হলে বাজার এত ঋণ কেন দেবে? এইখানেই সন্দেহের তির আদানি গোষ্ঠীর দিকে।

Advertisement

দ্বিতীয় সংখ্যাটি হল ঋণের উপর প্রদেয় সুদ এবং বার্ষিক আয়ের অনুপাত। এই অনুপাত স্বভাবতই ১-এর চেয়ে বেশ কম হওয়া উচিত— অনুপাত ১-এর যত কাছাকাছি, বার্ষিক আয়ের তত বেশি অংশ শুধু সুদ মেটাতেই চলে যাবে। সুদ মেটালে সংস্থার ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হবে, ঋণ পরিশোধের তো প্রশ্নই ওঠে না। আদানি গোষ্ঠীর এই অনুপাত ছিল ৩, সম্প্রতি তাকে কিছুটা সামলে ২.৫-এ নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ, সংস্থার সুদের বোঝা হল বার্ষিক আয়ের আড়াই গুণ। কোনও সাধারণ উপায়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা কঠিন। ভারতীয় শেয়ার বাজারের আধিকারিকরা এর তদন্ত করছেন।

কোনও সংস্থার ঘরে নিয়মিত কী পরিমাণ নগদ ঢুকছে— যাকে বলা হয় ক্যাশ ফ্লো— তা সেই সংস্থার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নির্ধারণ করে। আদানি গোষ্ঠীভুক্ত সাতটি ‘লিস্টেড’ সংস্থার মধ্যে পাঁচটির ক্ষেত্রেই ‘লিকুইডিটি’-জনিত সমস্যা রয়েছে। যদি কোনও সংস্থার ঋণ বা তার উপর সুদ সেই সংস্থার বাৎসরিক আয়ের তুলনায় অনেক বেশি হয়, তা হলে অংশীদারদের সমূহ বিপদ, কারণ সে ক্ষেত্রে লভ্যাংশ বণ্টন নয়, অগ্রাধিকার পাবে ঋণ পরিশোধ।

এ ছাড়াও আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল যে, তারা এমন দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবহার করছে, যেখানে কর এবং হিসাব পরীক্ষার নিয়মকানুন বেশ শিথিল। আদানি গোষ্ঠী তার আয় এবং শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর জন্য ও শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির পুঁজির ভারসাম্যের কুশনিং প্রদান করার জন্য প্রভূত করছাড় পাওয়া যায়, এমন দেশের গোষ্ঠীভুক্ত সংস্থাগুলির একটি ওয়েব ব্যবহার করে। এদের অনেক অংশীদারই পারিবারিক সম্পর্কভুক্ত বা বৈদেশিক শেল কোম্পানি।

অভিযোগ উঠেছে যে, এই গোষ্ঠীর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ‘কার্যত অস্তিত্বহীন’ ছিল এবং গোষ্ঠীর ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি আদানি এন্টারপ্রাইজ়-সহ শেয়ার বাজারে ‘লিস্টেড’ সংস্থাগুলি চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) পদে প্রচুর বদল দেখা গেছে— আট বছরে পাঁচটি। এটিও সংস্থার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের বিচারে একটি বিপদসঙ্কেত। আদানি এন্টারপ্রাইজ় এবং আদানি টোটাল গ্যাসের স্বাধীন নিরীক্ষক ধান্দারিয়া শাহ নামক একটি ছোট অডিট ফার্ম, যার কোনও কার্যকর ওয়েবসাইট নেই, অংশীদারের সংখ্যা মাত্র চার, এবং কর্মচারী এগারো জন। হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এমন একটি সংস্থা “জটিল হিসাব নিরীক্ষণের কাজ করতে সক্ষম বলে মনে হয় না।” অডিটের অংশীদার হর্ষিল শাহ ও প্রবীণকুমার ধান্দারিয়া, যাঁরা যথাক্রমে আদানি এন্টারপ্রাইজ় এবং আদানির বার্ষিক অডিটে স্বাক্ষর করেছেন, কাজ শুরু করার সময় তাঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে ২৪ ও ২৩ বছর। মনে হচ্ছে যেন সদ্য পাশ করে বেরোনো হিসাব-পরীক্ষকরা ওই অডিট বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিশেষত তাঁরা যদি দেশের বৃহত্তম সংস্থাগুলির মধ্যে একটির হিসাব নিরীক্ষণের কাজ করেন— এমন সংস্থা, যা ‘এক জন অন্যতম শক্তিশালী ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত’। শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিয়োরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) এই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখছে।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট আরও বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক করেছে, যার ভিত্তিতে আমরা গত কিছু সপ্তাহ ধরে আদানি গোষ্ঠীর কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। আশা করা যায় যে, বাজার অর্থনীতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে সমাধানের দিকে এগোবে।

আরও পড়ুন
Advertisement