ভোট এল: ‘বোকা’ নাগরিককে ঠকানোর বন্দোবস্ত চলছে, চলবে
Society

শিশুরা যে শিক্ষা পেয়েছে

যুক্তি বলবে, পরিণত বয়সের একেবারে সাধারণ বোধসম্পন্ন কোনও ব্যক্তিও যদি বারংবার বুঝতে পারেন যে, তাঁকে ঠকানো হচ্ছে বা তিনি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা হলে স্বাভাবিক প্রবণতায় তিনি সতর্ক হবেনই।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০৬
ধাক্কা: লাভপুরের রিক চায় বড় হয়ে 'বোকা' হতে।

ধাক্কা: লাভপুরের রিক চায় বড় হয়ে 'বোকা' হতে।

লাভপুরের ক্লাস থ্রি-র ছাত্র রিক বাগদিকে সহজে ভোলা কঠিন। অনেকেরই অভিমত, শিশুর সরলতায় সে আমাদের সকলের বিবেকের গোড়া ধরে কিঞ্চিৎ নাড়া দিতে পেরেছে। কারণ আজকের পৃথিবীতে রিক চায় ‘বোকা’ হতে!

Advertisement

কেন? তার বক্তব্য, “বোকা হলে আমি তো কাউকে ঠকিয়ে নিতে পারব না।” তার বাবাকে সে বলতে শুনেছে, “বোকা পেয়ে সবাই আমাকে ঠকিয়ে নিচ্ছে।” এক কথায় বললে, তার কাছে তাই ‘সৎ’ এবং ‘বোকা’ কার্যত সমার্থক।

তার বালক-মনে এই সব সত্যিই কতটা কী জীবনবোধ তৈরি করছে, করলেও তা চিরস্থায়ী হবে কি না, সেই গভীর বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা রাখি না। তবে কথাগুলি শুনলে ধাক্কা লাগে। সেখানেই রিক বাগদি আলোচ্য হয়ে ওঠে। আবার এক থেকে বহু হয়ে বৃহত্তর পরিসরে ভাবলে অন্যতর শঙ্কাও গ্রাস করে। তবে কি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এমনই বিশ্বাস ক্রমে অঙ্কুরিত হচ্ছে? তা হলে আগামী দিনে আমাদের চার পাশের পৃথিবীতে কি এটাই সাব্যস্ত হবে যে, সৎ মানেই বোকা? তারা কি বিশ্বাস করতে শিখবে যে, সততা কোনও গুণ নয়, অন্যকে ঠকানোর ‘অক্ষমতা’ মাত্র! এই কি তবে ‘রিক-বেদ’এর নির্যাস?

বালকের বলা কথা ছেড়ে বক্তব্যের মূল বিষয়ে এলে আরও দু’-একটি প্রশ্নও মাথা চাড়া দেয়। সচেতন ভাবে বোকা হওয়ার মানসিকতা কি আসলে ‘অতি চালাকি’র কোনও প্রকাশ, যাতে অনেক সময় বাড়তি সুবিধার পথ খুলে যায়? না কি নেহাত কিছু করতে না-পারার হতাশা থেকে আড়াল কিংবা সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার জন্য এটি এক বর্ম?

যুক্তি বলবে, পরিণত বয়সের একেবারে সাধারণ বোধসম্পন্ন কোনও ব্যক্তিও যদি বারংবার বুঝতে পারেন যে, তাঁকে ঠকানো হচ্ছে বা তিনি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা হলে স্বাভাবিক প্রবণতায় তিনি সতর্ক হবেনই। হতে পারে, কখনও পরিস্থিতির দায়ে, কখনও বিবিধ ক্ষমতাশালীর চাপে বহু ক্ষেত্রে তিনি হার মেনে নিতে ‘বাধ্য’ হন। যে কারও ক্ষেত্রেই এটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেটাকে তাঁর স্বভাবজাত বোকামি বলে ধরে নেওয়া কিছুটা অতিসরলীকরণ হবে। ফলে এ সবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সততার সম্পর্ক খোঁজাও অর্থহীন।

ভেবে দেখলে, বোকা তো আমরা সবাই! যে সমাজে, যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আবহে আমরা বাস করি, তাতে আমরাও কি নিয়ত বোকা হয়ে ঠকছি না? শক্তিধররা কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও আমাদের মতো জনগণকে চিরকালই তো গুছিয়ে ‘ঠকিয়ে’ যায়। গত্যন্তর নেই বলে জ্ঞানপাপী আমরাও ‘বোকা’ থেকে যাই! কখনও এর আশ্বাসে মাথা হেলাই, কখনও ওর কথায়।

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, বড় হয়ে ‘সুখপাঠ্য’ ইতিহাস পড়তে পড়তে রিকও এক দিন নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবে যে, এই রকম ‘বোকা’র দলে সে একা নয়। সে দিন হয়তো রিক আরও বুঝবে, এ-দেশে ‘সচেতন’ বোকারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা ঠকেও শেখে না, ঠেকেও শেখে না! আসলে আমরা সবাই এমনই বোকা! এবং সে-ও তাদেরই এক জন। “নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?”

এই যে এখন ভোটের বাজারে হাজার প্রতিশ্রুতি, এটা-ওটা পাইয়ে দেওয়ার লম্বা ফর্দ উড়ে বেড়াচ্ছে। নানা দলের নানা মুখ এবং মুখোশ। রিকের অবশ্য এখনও অতশত বোঝায় বয়স আসেনি! কিন্তু বড়রা? দেশের কয়েক কোটি মানুষ, যাঁরা ভোট দিতে যাবেন? তাঁরা কি জানেন না যে, কোথায় ফাঁক, কোথায় ফাঁকি? তথাপি ‘বোকা’ সকলকে হতেই হয়!

এ বারের ভোটে ‘মোদীর গ্যারান্টি’ একটি চটকদার উপকরণ। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এখন তিনি ‘বিকশিত ভারত’ গড়তে উদ্যোগী। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে এগিয়ে। আর্থিক অনুদানের মাত্রা বেড়েছে। নগদ অর্থ হাতেও পৌঁছচ্ছে। সবাই দেখি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং আত্মপ্রচারের ঢাক বাজিয়ে বলছেন, “মানুষের আশা যেখানে ফুরিয়ে আসে, মোদীর গ্যারান্টির সেখান থেকে শুরু।” অন্য দিকে মমতার চ্যালেঞ্জ, কেন্দ্রের আর্থিক ‘বঞ্চনা’, একশো দিনের কাজ ও আবাস যোজনার টাকা ইত্যাদি না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি ‘পাশে’ আছেন এবং “সাহায্য বন্ধ হবে না।”

বালক রিক জেনেছে, বোকাদের ‘ঠকানো’ সুবিধে! কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনও হদ্দ বোকা চাইলেই জানতে পারেন, গত দশ বছরে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কোন কোন প্রতিশ্রুতির কত দূর বাস্তবায়ন হয়েছে। পাশাপাশি এই রাজ্যেরই বা হাল কী।

‘বোকা’রাও বোঝেন, ভোটের ঠিক আগেই অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার সমস্যাসঙ্কুল প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা করা নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলের তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু বিদেশ থেকে কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা হলে সকলের ব্যাঙ্কে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা পড়ার যে স্বপ্ন মোদী ক্ষমতায় আসার আগেই হাওয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার কী হল? দশ বছরে কত কালো টাকা বিদেশ থেকে এল? হায়, ‘বোকা’দের আজও তা কেউ খোলসা করে বলেননি। যদিও দেশের তাবড় মন্ত্রী ও শাসক নেতারা জনগণ বলে অভিহিত ‘বোকাগণ’কে বুঝিয়েছেন, ও-সব হল প্রতীকী, মানে কথার কথা। ভাবখানা যেন, দূর বোকা, এ সব করা যায় নাকি!

নোটবন্দি করে দেশের অভ্যন্তরে কালো টাকা নির্মূলের যে দাবি বিজেপি সরকার করেছিল, তা-ও কি প্রকৃতপক্ষে কার্যকর করা গিয়েছে? ওই ভাবে কত পরিমাণ কালো টাকার চাক ভাঙা সত্যিই সম্ভব হয়েছে, বা আদৌ কখনও হবে কি না, ‘বোকা’ আম-আদমিরা সেই সব গূঢ় তত্ত্বও এখনও ‘বুঝতে’ পারেনি। তা হলে এটাও বরং না-বোঝাই থাক। বোকা তো ঠকবেই!

‘বোকা’দের না-জানার তালিকায় বছরে এক কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতিও আছে। মানে দশ বছরে দশ কোটি। হয়েছে কি? কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ হল কি? ‘বোকা’রা শুধু কৃষকদের আন্দোলন, আর তা দমন করতে শাসকের বিক্রম দেখতে পায়।

কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাদের তৎপরতা কেন কেবল বিরোধীদেরই নিশানা করে, ভোটের আগে কেনই বা তার মাত্রা বেড়ে যায়, ‘বোকা’দের সে সবও ‘বোধগম্য’ হওয়ার কথা নয়! তারা এটাও বোঝে না যে, খাওয়া-পরা থেকে শুরু করে ধর্মাচরণের মতো ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রগুলি বার বার আক্রান্ত হয় কেন? ইতিমধ্যে বঙ্গের ভান্ডারেও ‘বিবিধ রতন’ চিনে ফেলেছে এই ‘বোকা’র দল! অন্তত ত্রিশ বছর তারা দেখেছে ‘সর্বহারা’র তক্‌মা আঁটা বাম শাসকদের সর্বগ্রাসী চেহারা। এখন তাদের দেখতে হচ্ছে সততা, স্বচ্ছতা, নৈতিকতার চরম দুর্গতি। ক্ষমতাধর তৃণমূল যার অন্যতম প্রযোজক।

‘বোকা’রাও জানতে পারছে, মন্ত্রীর খাটের তলায় লুকিয়ে থাকে টাকার পাহাড়। ক্ষমতাসীনের বান্ধবীর বাথরুম ব্যাঙ্কের টাকা ভর্তি সিন্দুককেও হারিয়ে দিতে পারে। একাধিক জাঁদরেল মন্ত্রী ও কেষ্টবিষ্টু নেতার স্ত্রী-কন্যাদের নামে দেশে-বিদেশে নগদ ও সম্পত্তির পরিমাণ বাড়তেই থাকে। এই রাজ্যে ক্ষমতায় বসে থাকা দলের দু’পয়সা-চার পয়সার নেতাদের ঘরেও এখন শত শত কোটি কালো টাকার ‘বিস্ফোরণ’ হয়!

‘ধূর্ত’দের সঙ্গে ‘বোকা’রাও অবশ্য সরকারি অনুদানের লাইনে দাঁড়ান। সেখানে বহু পরিবারই কিছু-না কিছু পেয়ে থাকে। কিন্তু পাশের বাড়ির যুবকটি যখন বলেন, যোগ্যতা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষকের চাকরি পাননি, মোটা ‘প্রণামী’ দিয়ে পেয়েছে ফেল করা অন্য কেউ, ‘বোকা’র হিসাব তখন গুলিয়ে যায়! দিনের শেষে কে ঠকছে? ঠকাচ্ছেই বা কাকে?

রিকের বচন আজকের এমনই অনেক অঙ্ক সহজে মিলিয়ে দিল। পরের কথা পরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement