Durga Puja 2022

মা দুগ্গাই মধ্যমণি, কে বলল

খুলনার সেই উনিশ শতকীয় দোরোখা কাঁথার মতো দু’পিঠে নকশাও চাইলে ফুটিয়ে তোলেন লাভলি। তবে অত সূক্ষ্ম ফোঁড়ের জন্য আরও বেশি সময় দিতে হবে।

Advertisement
ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:১৯
প্রতিমার চালচিত্র।

প্রতিমার চালচিত্র।

চণ্ডীদাসের গাঁয়ের মেয়ে লাভলি বিবির কাঁথার কাজ শেষ হয়েছে। রংবেরঙের ছবিওয়ালা কাঁথা বিছিয়েই পূর্ণতা পাবে কলকাতার পুজোর প্রতিমার চালচিত্র। না দেখলে বিশ্বাস হবে না— হাতি, ঘোড়া, লোকলশকরে সাজা রথের মিছিল, আকাশে টিয়াপাখির ঝাঁক সব ফুটে উঠেছে রঙিন সুতোর বুননে। কলকাতায় গুরুসদয় দত্তের সংগ্রহশালায় মানদাসুন্দরীর কাঁথা রয়েছে। খুলনার সেই উনিশ শতকীয় দোরোখা কাঁথার মতো দু’পিঠে নকশাও চাইলে ফুটিয়ে তোলেন লাভলি। তবে অত সূক্ষ্ম ফোঁড়ের জন্য আরও বেশি সময় দিতে হবে।

পুজো এলেই কলকাতা ডাকে লাভলি, লুৎফাদের। যেমন ডাক পড়ে বীরভূমেরই মহিষঢাল গ্রামের ডোম, বাঁশ-শিল্পী ধনঞ্জয় হাজরা বা গমীরা নাচের কাঠের মুখোশ শিল্পী কালিয়াগঞ্জের সঞ্জুলাল সরকারদের। আজকের থিমপুজোর প্রথম সারির রূপকার পার্থ দাশগুপ্ত বলছিলেন, “আমাদের মধ্যে কোনও কোনও শিল্পীর নাম ছড়ায়! কিন্তু থিমপুজোর আসল মজা কোলাবরেশনের শক্তি। আমার সামগ্রিক ভাবনার সঙ্গে হয়তো মিলে যাচ্ছে লাভলিদির কাঁথা বা ধনঞ্জয়দার তৈরি মাছের জাল।” অন্ত্যজ, প্রান্তিক সবাইকে নিয়ে এই চলার চেষ্টা ইউনেস্কোরও স্বীকৃতি পেয়েছে। পার্থ আবার আর্টের একটা প্রসারণও দেখছেন। হয়তো তাঁর পরামর্শে হুগলির বলাগড়ের নৌকা কারবারিরা নৌকার কাঠ দিয়ে পেঁচা গড়লেন। সেকেলে গৃহস্থবাড়ির সন্দেশ তৈরির ছাঁচ মণ্ডপ সাজাতে নতুন করে বৃহৎ আকারে গড়া হল। কাঠের চিরুনিও হয়ে উঠল দুর্গার মুকুট। দেশকালের সীমা ভেঙে যা কিছু বাংলার বা বাঙালির, সবই পুজোয় মিশেছে।

Advertisement

কলকাতার পুজোর শিল্পসত্তাটিকেই ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। এই যুদ্ধজয়ের ভিতরের একটা গল্প বলা জরুরি। সবাই জানেন, ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতাকে ইউনেস্কোর জন্য দুর্গাপুজো বিষয়ক প্রস্তাবটি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্র দুর্গাপুজো নিয়ে ভাবলেও কলকাতার স্বীকৃতির জন্য আগ্রহী ছিল না। তপতী বোঝান, শিল্পপ্রদর্শনীর প্রসারে কলকাতার পুজোই গোটা দেশে অনন্য। ধর্মকে যা অতিক্রম করে গিয়েছে। তাও কেন্দ্র কলকাতার একটি পরিচয় হিসেবে দুর্গাপুজোকে (দুর্গাপুজো অব কলকাতা) মানতে রাজি হয়নি। শেষে ‘দুর্গাপুজো ইন কলকাতা’র জন্য আর্জি জানানো হয়। স্বীকৃতিও আসে। গত দু’দশক পুজো প্রতিযোগিতার ডাকসাইটে বিচারক, প্রবীণ ভাস্কর বিমল কুণ্ডু কলকাতার বারোয়ারির পথ চলায় শিল্পেরই অভিযাত্রা দেখছেন।

নানা বিক্ষিপ্ত পরিবর্তনের পথ ধরে গত তিন দশক হল সৃষ্টিশীলতার বিস্ফোরণ। পোটোপাড়ার ঠাকুর, ডেকরেটরের প্যান্ডেল নানা রূপ বদলে ক্রমশ একটি বৃহৎ পাবলিক ইনস্টলেশন আর্ট হয়ে উঠেছে। সব কাজই যে দারুণ হচ্ছে, তা নয়। কিন্তু এর সৌজন্যে রাতারাতি সারা দেশ তো বটেই, বিশ্ব-মানচিত্রে পর্যন্ত কলকাতার অখ্যাত মহল্লার নাম দেখছি। গত বছর অতিমারির ঘেরাটোপের শৃঙ্খল ছিঁড়ে উৎসবের সেতুবন্ধের ভাবটি মহালয়ায় লাইভ শো-এর মাধ্যমে সৃষ্টি করলেন থিমের তারকা-শিল্পী সুশান্ত পাল। টালা প্রত্যয়ের মাঠে আচ্ছাদন ভেঙে পুজোমণ্ডপ প্রস্ফুটিত হওয়ার ভিডিয়ো সে দিন গোটা দেশের টুইটারে শীর্ষে ওঠে। নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারের বিলবোর্ডেও সেই পুজো নাম তুলেছিল। এবং পুজোর এই দাপট সবটাই তার শিল্পের উৎকর্ষে।

সারা দুনিয়াতেই শিল্পকলাকে সার-জল দেয় কর্পোরেট পুঁজি। তবে থিম-তারকা ভবতোষ সুতার জোর দিয়ে বলছেন, “পুজোয় কর্পোরেট থাকলেও এখনও পর্যন্ত তারাই সব নয়। কর্পোরেট সৃষ্টির শরিক। কর্পোরেটই নিয়ন্ত্রক নয়।” আমাদের দেশে শিল্পচর্চার একদা জীবনের সঙ্গে যোগ ছিল। আধুনিক আর্ট গ্যালারি-কেন্দ্রিক রূপটাই তার একমাত্র রূপ নয়। আর্ট কলেজ শিক্ষিত সনাতন দিন্দার মতো মূল ধারার শিল্পী পুজোকে তাঁর অক্সিজেন বলেন। কার্যত কর্পোরেট শৃঙ্খলায় পুজোর থিম নির্মাণ থেকে বাজেট সংস্থান— সবই চলে এই পুজোর শেষ থেকে পরের পুজোর শুরু পর্যন্ত এক বছর ধরে। কিন্তু সকলেই এক বাক্যে মানছেন, শিল্পী কী করবেন, তাতে কর্পোরেট নাক গলায় না।

ভারতীয় প্রতিমা ভাস্কর্যের ব্যাকরণসিদ্ধ ঠাকুর থেকে নানা উপাদানের নির্মাণশৈলী, আর্ট কলেজ শিক্ষিত শিল্পী, স্থপতি, সিনেমার শিল্প নির্দেশকদের হাতযশ এসে মিশেছে পুজোর ইতিহাসে। এমনকি, একুশ শতকে এসে দুর্গার দেবী ভাবকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়তে বাংলার শিল্পী কসুর করেন না। ভবতোষ সুতার বা সনাতন দিন্দা দু’জনেই অকপটে বলছেন, ঈশ্বরে বিশ্বাসের জোর তাঁরা পান না। কিন্তু এত মানুষকে মেলানোর এই পরিসর, শিল্পের গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার মঞ্চই তো পুজো।

সনাতনের পুরাণের নানা উপাদান আহরণে আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি বলছেন, “মিকেলাঞ্জেলো দেখে কেউ ধর্মের কথা ভাবেন না। আমাদের পুজোর উপস্থাপনাও ধর্মের গণ্ডি ছাপিয়ে যায়। এখানে শিল্পের দিকটাই বড় কথা।” ভবতোষ সুতার আবার ধর্মের উপাদানের গুরুত্বকেও প্রশ্ন করতে ছাড়েন না। তিনি হাসেন, “দুগ্গাঠাকুরকেই দুর্গাপুজোর মধ্যমণি হয়ে থাকতে হবে, এটাও আমি আর বিশ্বাস করি না। আমি দুর্গাপুজোর মানবিক দিক, উৎসবের মহিমাকেও সবার উপরে রাখতে পারি!” এই সব ভাবনা থেকেই তাঁর থিমে নানা বিনির্মাণ ঘটাচ্ছেন ভবতোষ। কখনও নিজের আদলে অসুর গড়ছেন। ফর্সা পরমাসুন্দরী দুর্গার ধারণাটি ভেঙে দিচ্ছেন। আবার মণ্ডপের কেন্দ্র থেকে দুর্গাকে সরিয়ে হয়তো ঢাকিদের এনে বসাচ্ছেন। তাঁর পুজো অভিজ্ঞতা নথিবদ্ধ করতে বাগুইআটির অর্জুনপুরের পৃষ্ঠপোষকতায় মাঠেঘাটে শিল্প/ আর্ট অন গ্রাউন্ড জ়িরো বলে একটি বইও তৈরি করেছেন ভবতোষ। সুশান্ত পাল শিল্পের সঙ্গে প্রযুক্তির কৃৎকৌশল মেশাচ্ছেন। পার্থ দাশগুপ্ত পুজোর ইতিহাস, পুজো ঘিরে বাঙালির গবেষণার চলমান রূপটিকেও থিমে রাখছেন। এবং ক্রমশ তাঁদের নির্মাণের চূড়ান্ত রূপটি বা ‘এন্ড প্রডাক্ট’ নয়, নির্মাণের প্রক্রিয়াটিই অনেক শিল্পীর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বোধন হওয়া প্রতিমা নয়, ধাপে ধাপে সৃষ্টি শিল্পের হয়ে ওঠাই এ উৎসবের শেষ কথা।

আরও পড়ুন
Advertisement