Congress

Congress: কংগ্রেস-মুক্ত, না পরিবার-মুক্ত?

ইন্দিরা গাঁধীর প্রায় এক যুগের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের প্রথম কংগ্রেস-মুক্ত জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৭৭-এর মার্চে।

Advertisement
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৪৬

কংগ্রেস-মুক্ত ভারত এখন এক নতুন স্লোগান। সংসদে যথেষ্ট সংখ্যাধিক্য, কংগ্রেসের নেতৃত্বহীনতা এবং দেশের ৩০টি প্রদেশের মধ্যে ১৪টি প্রদেশে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতাসীন। আবার ১৩টি রাজ্যে, দেশের প্রায় অর্ধেক রাজ্যে, রয়েছে প্রধানত আঞ্চলিক দলের শাসন। এই আবহে বিজেপির কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের চিন্তার পালে হাওয়া বেশ সবল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেস-মুক্ত ভারত কি কাম্য?

ইন্দিরা গাঁধীর প্রায় এক যুগের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের প্রথম কংগ্রেস-মুক্ত জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৭৭-এর মার্চে। মাত্র দু’বছরে এই জগাখিচুড়ি দল ভেঙে যায়, কোনও গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছাড়াই। এর এক যুগ পরে দ্বিতীয় কংগ্রেস-মুক্ত জনতা দলের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার হল ১৯৮৯-এ। নির্বাচনের এক বছর আগে তৈরি হয়েছিল এই খিচুড়ি জনতা দল। ২ ডিসেম্বর ১৯৮৯ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের ক্ষমতা গ্রহণের ছ’দিনের মাথায় তাঁর সরকারের কাশ্মীরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সৈয়দের কন্যা রুবাইয়াকে অপহরণ করে জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট। পাঁচ দিন পর ১৩ ডিসেম্বর পাঁচ জন প্রধান সন্ত্রাসবাদীর মুক্তির বিনিময়ে রুবাইয়া মুক্তি পান। এই সন্ত্রাসবাদীদের শ্রীনগরের কেন্দ্রে একেবারে জনতার মাঝে মুক্তি দেওয়ার পর সেখানে তাদের নিয়ে মিছিল হয়, চলে বাজি পুড়িয়ে উল্লাস। এর ঠিক এক মাস পরেই ১৯ জানুয়ারি ১৯৯০-এ শুরু হল মহল্লার মসজিদ থেকে আজ়াদি-র স্লোগান। কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক লক্ষ হিন্দু শিখকে কাশ্মীর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। অর্থাৎ, কংগ্রেস-মুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের দু’মাসের শাসনের মধ্যেই আজকের সন্ত্রাসময় কাশ্মীর উপহার দিল ভি পি সিংহের সরকার, যার দায় সমান ভাবে বর্তায় ভারতীয় জনতা পার্টি ও বাম দলের, কারণ এই সরকার তাদের সমর্থনেই তৈরি হয়েছিল। কাশ্মীরের সন্ত্রাস নিয়ে বামপন্থীদের কোনও দিনই মাথাব্যথা নেই। বিজেপি দাবি করে তারা এ ব্যাপারে খুব সংবেদনশীল। কিন্তু স্রেফ কংগ্রেস-মুক্ত সরকার করতে গিয়ে কাশ্মীরকে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার দায় কি তারা স্বীকার করবে?

Advertisement

একটি শক্তিশালী সর্বভারতীয় দল ও নেতা থাকলে কী হতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক। ১৯৭১-এর মার্চে সাধারণ নির্বাচনে লোকসভায় ৩৫২টি আসনের বিপুল সমর্থন নিয়ে কংগ্রেসের নতুন দল গড়ে ক্ষমতায় এলেন ইন্দিরা গাঁধী। প্রায় সেই সময় শুরু হল পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার দাবির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচার, গণহত্যা। এক কোটি উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিলেন। এই অবস্থায় চিন-আমেরিকান হুমকিকে উপেক্ষা করে ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ গঠন করে দেওয়ার অভূতপূর্ব সাহস দেখিয়েছিলেন কংগ্রেসের নেত্রী ইন্দিরা গাঁধী। আবার ১৯৮৪-তে খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদকে সমূলে আঘাত করার জন্য অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সেনা আক্রমণ চালিয়ে পঞ্জাবের দ্বিতীয় বিভাজন রুখে দিয়েছিলেন তিনি। একই ভাবে ২০১৯-এ যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সাত দশক ধরে গেড়ে বসে থাকা সংবিধানের একটি সাময়িক ধারা— ৩৭০ ধারাকে অবলুপ্ত করে দেশের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে। এই উদাহরণগুলি দেখায় দেশ বা জাতির স্বার্থে বড় সাহসী ভূমিকা নেওয়ার ঝুঁকি সর্বভারতীয় দলই নিতে পারে, ক্ষমতা দখলের জন্য খিচুড়ি দলের কোয়ালিশন বা আঞ্চলিক দলগুলির কোয়ালিশন তা নিতে পারে না। বরং সঙ্কীর্ণ স্বার্থে সার্বিক ভাবে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত সহজেই নিয়ে নিতে পারে।

ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বভারতীয় প্রধান দল এখন দু’টিই। কংগ্রেস এবং বিজেপি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জনতা দল, জনতা পার্টি লোকসভায় মন্ত্রিত্ব-সহ গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও এর পর কেবল নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে তৈরি হিন্দি বলয়ের এই দল বিভিন্ন রাজ্যের স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্বে বিভিন্ন নামে ভাগ হয়ে গেল। উত্তর ভারতের রাজ্য রাজনীতিতে এই দলগুলির প্রাধান্য কংগ্রেসের একচেটিয়া ক্ষমতার মহল একেবারেই ধসিয়ে দিল। দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যেও বহুলাংশে আঞ্চলিক দলেরই প্রাধান্য চলছে। মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি— সর্বত্রই আঞ্চলিক দলের দাপট। এদের প্রতিনিধিরাই লোকসভাতেও যথেষ্ট আসন দখল করে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। নিশ্চয়ই রাজ্যের মানুষের জন্য কাজ করছে বলেই এই দলগুলি রাজ্যে জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে তা মঙ্গলজনক বলেই ধরা যেতে পারে।

২০টিরও বেশি সমৃদ্ধ ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দেশ পরিচালিত হচ্ছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এর আর কোনও উদাহরণ নেই। ভারত পশ্চিমি নেশন স্টেট নয়, ‘সিভিলাইজ়েশনাল স্টেট’— পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা সংস্কৃতির বন্ধনে গ্রন্থিত একটি দেশ। এই ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল ভারতকে সংযুক্ত রাখতে গেলে সর্বভারতীয় দলের প্রয়োজন। আজকের দুর্বল কংগ্রেসকেও কোনও কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিভিন্ন রাজ্যে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে হয়। কিন্তু রকমারি আঞ্চলিক দলের তেমন কোনও বৃহত্তর দায় নেই। তাদের মুখ্য লক্ষ্য নিজের রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা, প্রয়োজনে কেন্দ্রে জোট বেঁধে আরও ক্ষমতার অংশী হওয়া। এর পরের ধাপ বিচ্ছিন্নতাবাদ। কেবল ধর্মীয় কারণে নয়, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক দাবিকে সামনে রেখেও এই বিচ্ছিন্নতাবাদ জেগে উঠতেই পারে। অবশ্য সর্বভারতীয় দল হলেও বাম দলগুলির ভারত বিচ্ছিন্নতায় কোনও দিন আপত্তি ছিল না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের পরিবর্তে বরং গাঁধী পরিবার-মুক্ত কংগ্রেসের কথা বলা বোধ হয় সমীচীন। এবং, কেন্দ্রে জোট সরকার গঠনের প্রয়োজন হলে তার নেতৃত্ব রাখতে হবে সর্বভারতীয় দলের হাতেই, নইলে দেশের স্বার্থ বিপন্ন হতেই পারে।

আরও পড়ুন
Advertisement