শিকার: রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর পর তাঁর ছবি হাতে সরকারবিরোধী প্রতিবাদে শামিল মা রাধিকা। নয়া দিল্লি, ২০১৬।
অধ্যাপক সুরেশ কুমার ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গোয়েজেস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হন ২০১৭ সালে। সারা দেশেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ এক সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিনের অধ্যাপকের উচ্চতর পদপ্রাপ্তি অনেকেই সহজ ভাবে নিতে পারেননি। কারণ মেধা, বৈদগ্ধ ছাপিয়ে সামাজিক আতশকাচে প্রধান হয়ে ওঠে তাঁর জাত। তিনি দলিত, অতএব অযোগ্য হতে বাধ্য। এই নিয়োগ নাকি নেহাতই হিসাবি সিদ্ধান্ত! দলিত কলঙ্কে অপমানিত ও নির্যাতিত অনেক অধ্যাপকের মধ্যে সুরেশ কুমারের উল্লেখ আগে করলাম, কেননা যে দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহননের ঘটনা তার আগের বছরই দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল, এই অধ্যাপক সেই একই জনগোষ্ঠী মালা-র সদস্য। রোহিতের ‘আত্মহনন’রূপী হত্যাকে চাপা দিতেই নাকি একই জনগোষ্ঠীর অন্য এক জনকে উপাচার্য পদে বসানো। যদি এই সমালোচনার মূলে সত্যতা থাকে, অথবা তা ভিত্তিহীন হয়— দু’ক্ষেত্রেই ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বৈষম্যের বিকার বহন করছে বলতে হয়। ভারতের আধবুড়ো ‘গণতন্ত্র’কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পক্ষে এই বাস্তব একাই একশো।
গত দশ বছরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দশটি চিঠি লিখেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), কারণ উচ্চশিক্ষার চত্বরে ক্রমশ বেড়ে চলা বৈষম্যের হিংসা। দলিত এবং নিম্নবর্ণের যে ছাত্রছাত্রীরা অনেক প্রতিকূলতা জয় করে উচ্চশিক্ষার সদরে পৌঁছন, তাঁদের সেখান থেকে বিদায় করার জন্য উচ্চবর্ণের তূণীরে সর্বক্ষণ অপমান-অনাচারের তির প্রস্তুতই থাকে। সব ঘটনা রোহিত কিংবা ভিল জনজাতির ডাক্তার পায়েল তদভি-র ‘আত্মহত্যা’র (মহারাষ্ট্র, ২০১৯) মতো সাড়া ফেলতে পারে না প্রচারের অভাবে। ফলে ডেল্টা মেঘওয়াল, অনিকেত অম্ভোর, ভি প্রিয়ঙ্কা, ই শরণ্যা, অনিল মীনা বা সেন্থিল কুমারদের করুণ পরিণতি সহজেই সকলে বিস্মৃত হন। মৃত্যুর আগে রোহিত লিখেছিলেন, তাঁর জন্মই ছিল এক ভয়ানক ভুল। পরের বছর ‘আত্মহত্যা’র আগে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র মুথুকৃষ্ণন জীবনন্তম লেখেন, “এমফিল, পিএইচ ডি-তে ভর্তির ক্ষেত্রে, ভাইভা ভোসি-র ক্ষেত্রে সাম্য নেই। সাম্য কেবল সমানাধিকার অস্বীকার করার প্রবণতায়।” ভুল সত্যিই হয়েছে, বিরাট ভুল। তবে তা রোহিতের জন্মে নয়, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে বাস করা একনায়করূপী মৌলবাদে।
ইউজিসি যতই চিঠি দিয়ে সতর্ক করুক, তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলুক, আরটিআই-এর উত্তর জানাচ্ছে, এই উদ্যোগ সমস্যার সমাধানে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদ, সঙ্কীর্ণ রাজনীতি, বস্তাপচা ‘সামাজিক নিয়ম’, ‘খাপ’-এর ফতোয়ার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত। দলিত, তফসিলভুক্ত ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় এখনও হয় বঞ্চিত, নতুবা বিতাড়িত। আম্বেডকরের শৈশব থেকে যৌবনে যে যাতনাময় ইতিহাস, তাঁরই স্বপ্নের সংবিধানের ছাতা ফুটো করে দিয়ে সে ইতিহাসের জল বর্তমানেও গড়িয়ে নেমেছে।
গত মে মাসে ‘অল ইন্ডিয়া ওবিসি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে আবেদন করেছে, যেন উপাচার্য পদে বহু শূন্যস্থান স্থায়ী নিয়োগে পূর্ণ হয়। না হলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতেও অসুবিধা হচ্ছে। তাঁরা দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির অধ্যাপকদের আরও বেশি সংখ্যায় এই পদে নিয়োগ করার কথাও বলেছেন। এই আবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু, তা নিয়ে ভাবারও প্রয়োজন আছে। নিম্নবর্ণের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাজীবনে যে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন— অনটন, বিদ্বেষ, বিভেদ ইত্যাদি— সে সব প্রতিবন্ধকতা থেকে তাঁদের বার করে আনতে হলে উপলব্ধি, সহমর্মিতা ও যত্নের দরকার। একই সামাজিক বর্গের শিক্ষক ও প্রশাসকেরা সেই কাজ তুলনায় সহজে করতে পারবেন। (যদিও অন্যান্য সামাজিক শ্রেণির কিছু শিক্ষকও আন্তরিক ভাবে সেই চেষ্টা করেন।)।
রাওসাহেব কালে এ দেশের কতিপয় দলিত উপাচার্যের এক জন। তাঁর গবেষণা বিজ্ঞানীমহলে সমাদৃত। টিনের চাল দেওয়া মাটির ঘর থেকে উঠে এসেছেন এই প্রবীণ অধ্যাপক। তাঁর জনগোষ্ঠীর লোকেরা সাধারণত কাঠ কাটা এবং নিকাশির কাজে যুক্ত। কোনও এক উচ্চবর্ণের বালকের হাত ধরে নদী পার হয়েছিলেন বলে শৈশবে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। যখন স্কুল অব লাইফ সায়েন্সেস-এ গবেষণা করতে গেলেন, তাঁর দলের বাকি ৩৫ জন তত্ত্বাবধায়ক পেলেও তিনি পাননি। দলিত ছাত্রকে কেউ সাহায্য করতে চাননি। তিনি মনে করেন, সম্ভবত জাতের কারণেই উপাচার্য পদে প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত সুখদেব ভোই-এর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কেননা সংস্কৃত হল ‘আর্যদের ভাষা’। কিছু দিন আগে যখন ঝাড়খণ্ডের সিধু কানু মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন জেএনইউ-এর অধ্যাপক সোনাঝরিয়া মিনজ, তখনও সাড়া পড়েছিল। তিন বার অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া এই মেধাবীকে শিক্ষক বলেছিলেন, “তুম সে না হো পায়েগা।” শিক্ষাজীবনে বৈষম্যের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়ার আশায় তিনি রাঁচী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন দক্ষিণে।
এমন লড়াকু শিক্ষকরাই তো বুঝবেন পরিত্যক্ত, অচ্ছুত হয়ে বেঁচে থাকার কী জ্বালা! মলমূত্র পরিষ্কারের ঝাঁটা ফেলে মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখার জন্য জিততে হয় কী ভয়ঙ্কর ধর্মযুদ্ধ! আর, তার পরেও যদি ফিরে যেতে হয় ভেঙে ফেলা আচারের বালুরাশিতেই, তা হলে মনে হতে পারে মৃত্যুই শ্রেয়। তাই দলিত বা নিম্নবর্ণের শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভের পথ সুগম করতে বেশি সংখ্যায় সমশ্রেণির শিক্ষক ও প্রশাসক প্রয়োজন। বাস্তব একেবারেই তা নয়। কিছু আইআইটি-তে তো তফসিলভুক্ত কোনও শিক্ষকই নেই (২০১৬-২০ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে)। আইআইএম-এ এমন শিক্ষক মাত্র তিন শতাংশ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দলিত উপাচার্যের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।
চাকরি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ নিয়ে যত বিতর্ক আছে, পরিহাস ততোধিক। কাজেই আইআইটি কানপুরের শিক্ষক সুব্রহ্মণ্যম সদরেলা সহকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন, গবেষণায় বাধা আসে, বিষয় গড়ায় এফআইআর অবধি। ভারতে প্রতি দু’জন জনজাতির মানুষের মধ্যে এক জন এবং প্রতি তিন জন দলিতের মধ্যে এক জন দরিদ্র। পাশাপাশি ভাষা, অঞ্চল, লিঙ্গ, ধর্মকেন্দ্রিক বৈষম্য তো আছেই।
একই ছায়া উচ্চশিক্ষাতেও। তফসিলি জাতি-জনজাতির সংখ্যা দেশের মোট নাগরিকের এক-চতুর্থাংশ, অথচ ‘অল ইন্ডিয়া সার্ভে অব হায়ার এডুকেশন’ (২০১৮-১৯) বলছে, এই বিরাট জনসংখ্যার আণুবীক্ষণিক অংশই উচ্চশিক্ষার সদর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন— ১৫ শতাংশ সংরক্ষিত আসনও পূরণ হয় না। আর যাঁরা শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেন, তাঁদের অনেকের পক্ষেও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর হয়। স্বয়ং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীই ২০১৯ সালে সংসদে জানিয়েছিলেন, যাঁরা আইআইটি ছেড়ে দেন তার ৪৮ শতাংশ, এবং যাঁরা আইআইএম ছাড়েন তার ৬৩ শতাংশ নিম্নবর্ণের শিক্ষার্থী।
কোভিড যখন ভারতকে বিপর্যস্ত করেছে, তখন এর সঙ্গে চিনের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে গুজব রটেছে। এবং, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির ছাত্রছাত্রীদের মুখাবয়বের কারণে অনেক সময়ই সহপাঠী, বন্ধু, পড়শিরা তাঁদের ‘করোনাভাইরাস’ বলে ব্যঙ্গ করেছে। প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের জীবনে এমন অন্ধকার নেমে আসা এ দেশে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর, এই প্রবণতা যখন শাস্তির বদলে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় পায়, তখন নরক গুলজার হতে বাকি থাকে না। দলিত গবেষক সেন্থিল কুমারের মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে অভিযুক্ত বিপিন শ্রীবাস্তবকে সহ-উপাচার্য পদে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত কিন্তু সে দিকেই ইঙ্গিত করে। ধর্মীয় মৌলবাদ, বিদ্বেষ, বৈষম্যের কারবারিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে তাণ্ডব চালায়, শেষ বিশ্লেষণে তা কোনও দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য নয়। সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হওয়া রাজার ছেলের গ্রাসে যদি লোহার শিকল ছিঁড়ে আসা মেহনতি ঘরের মেয়ের ক্ষতবিক্ষত হাত ভাগ বসায়, তা হলে সিংহাসন টলে যাওয়ার ভয়ের ফলে জন্মলব্ধ ‘রাজনীতি’ সেই মেয়ের বদনাম করা বা তাকে তাড়ানো ছাড়া কী-ই বা করতে পারে?
শিক্ষার জল গায়ে লাগলে স্বাধিকারের ক্ষুধা বাড়ে। মানুষ যত বেশি জানে, তত কম মানে। জাতের নামে বজ্জাতি থামানোর কাজে শিক্ষা যদি কাজে না লাগে, শুভবোধের বিকাশ যদি না ঘটে, তাকে কি আইন প্রণয়ন করে, পুলিশ পাঠিয়ে, শাস্তি দিয়ে কোনও ভাবে নিশ্চিত করা যাবে?