তাঁর কথা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত প্রায় ছয় দশকের নানা স্মৃতি। ছায়াছবির ফ্ল্যাশব্যা কের মতো সেগুলো একে একে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মিলিয়েও যায়। অনেক কিছুতেই বিস্মৃতির প্রলেপ পড়ে গেলেও, সামান্য একটু অনুধ্যানেই তারা ধরা দেয় ফের। সহায়ে, সম্পদে-বিপদে, আনন্দে-বিষাদে অগ্রবর্তিতায় তাঁর উজ্বল উপস্থিতি অনুভব করি। তিনি হাসান আজিজুল হক, যাঁকে বলতেই পারি উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক।
মনে পড়ে ষাটের দশকের খুলনার সেই দিনগুলোর কথা। দৌলতপুরের সরকারি ব্রজলাল কলেজে ভর্তি হয়ে তাঁকে দূর থেকে প্রথম দেখি, সেটা ১৯৬৪ সাল। ওই কলেজেই দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হয়ে এসেছেন সবে। কিছু দিন আগেই বেরিয়েছে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য। তারও আগে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত প্রখ্যাত সমকাল পত্রিকায় তাঁর ‘শকুন’ গল্পটি প্রকাশিত হয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কথাসাহিত্যিক হিসাবে তখনই তিনি লেখালিখির জগতে সুপরিচিত। ১৯৬৬ সালে আমি যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র, নতুন আঙ্গিকের গল্প-প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত, তখনই পড়ি তাঁর লেখা বিখ্যাত গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। পড়ে স্তব্ধবাক হয়েছিলাম। তত দিনে তাঁর অসামান্য কিছু আলোচনা শোনারও সৌভাগ্য হয়েছে, খুলনার ‘সন্দীপন সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়’-এর সাপ্তাহিক সভায়। ওই সময়েই এক দিন দুরুদুরু বক্ষে তাঁর বাসগৃহে হাজির হয়েছিলাম। কলেজ ক্যাম্পাসেই একটি জরাজীর্ণ বাসায় তিনি থাকতেন তখন। প্রথম আলাপেই তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। সত্যিকারের এক জন প্রাণবন্ত নিরহং প্রজ্ঞাদীপ্ত মানুষের সন্ধান পেলাম যেন!
তার পর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে এতগুলো বছর। রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ১৯৮৬ সালে রাজশাহীর ‘রবীন্দ্রমেলা’য় যাওয়া, ১৯৮৮ সালে তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞাপনপর্ব পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা। অনুষ্টুপ পত্রিকার আয়োজনে ‘সমর সেন স্মারক বক্তৃতা’ দিতে ১৯৯০ সালে তাঁর কলকাতায় আসা, জন্মভূমি বর্ধমানের যবগ্রামে যাওয়া, তাঁকে নিয়ে ল্যাডলি মুখোপাধ্যায়ের প্রামাণ্যচিত্র গল্পের জায়গা জমি মানুষ নির্মাণের সাক্ষী থাকা, কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বহু জায়গায় বক্তৃতা শোনা, ভ্রমণসঙ্গী হয়েও নানা জায়গায় যাওয়া, তাঁর আনন্দ পুরস্কার নিতে আসা, পরে এক বার ওই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং আর এক বার ওই পুরস্কার প্রাপক নির্বাচনে তাঁর বিচারক হওয়ার সুবাদে দুই পক্ষের দূতিয়ালি করার চমৎকার সুযোগ, আনন্দ পাবলিশার্সের হয়ে তাঁর পঞ্চাশটি গল্প সম্পাদনা করা, হৃদ্যন্ত্রের চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁর তিন-তিন বার বেঙ্গালুরু যাওয়া, তাঁর অনেকগুলি লেখার অনুলিখন নেওয়া— এমন অসংখ্য ঘটনার কথা মনে পড়ছে শুধু। আজ এই সময়ে তাঁর স্বাক্ষর করা বইগুলো আর আমাকে লেখা তাঁর শ’দুয়েক চিঠির বান্ডিল ছুঁয়ে তাঁরই প্রয়াণের ঘোর কাটাতে চাইছি কেবল, প্রাণপণে।
‘শকুন’ (১৯৬০) ছোটগল্প দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৫৭-৫৮ সালে উল্টোরথ পত্রিকা আয়োজিত ‘মানিক স্মৃতি পুরস্কার’-এর উপন্যাস প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়া এই মানুষটার পরিচিতি কিন্তু অন্য রকম হলেও হতে পারত। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হন মতি নন্দী, দ্বিতীয় অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আর তৃতীয় পূর্ণেন্দু পত্রী। আর চতুর্থ হওয়া আজিজুল হক তাঁর নামের আগে ‘হাসান’ শব্দটি বসিয়ে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন ওই ‘শকুন’ গল্প দিয়েই। তার পর আর ফিরে তাকানো নয়, কেবলই পথ চলা। সারা জীবন ধরে লিখেছেন নানা বিষয়ে। শ’খানেক গল্প, দু’টি উপন্যাস, তিনটি উপন্যাসিকা, শতাধিক প্রবন্ধ, একটি নাটকের ভাষান্তর, একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত, মুক্তিযুদ্ধ এবং জন্মভূমির স্মৃতিগদ্য-সহ চার খণ্ডের আত্মজীবনী, সক্রেটিসের জীবনীগ্রন্থ, কিশোরদের জন্যে গল্পগ্রন্থ এবং একটি উপন্যাস-সহ বেশ কিছু কলাম জাতীয় লেখা, এমনকি কিছু অগ্রন্থিত কবিতাও আছে তাঁর।
ছাত্রবৎসল শিক্ষক, নাট্যামোদী, সুবক্তা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সতত থাকা এই মানুষটির অবসর কাটত গান শুনে। তাঁর প্রিয় গায়ক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রাতরাশের টেবিলে নিত্য মুড়ি খেতেন বর্ধমানের এই ভূমিপুত্রটি। ভালবাসতেন প্রিয় মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে। চলতে ফিরতে তাঁর সজাগ অনুসন্ধিৎসু মন তাঁকে নিয়ে যেত অতি সাধারণ মানুষের কাছে। চেনা-অচেনা অনেক মানুষকে ডেকে ডেকে কথা বলতেন। জীবন থেকে আহরণ করা উপাত্ত যে ভাবে অসামান্য এক শিল্পের মোড়কে তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
আড্ডাপ্রিয় এই মানুষটির আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর অনন্য রসবোধ। মুগ্ধ হয়ে শুনতে হত তাঁর কথা। প্রসঙ্গত একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করছি। এক বার কলকাতায় এলে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম শঙ্খ ঘোষের ফ্ল্যাটে। সে দিন সেখানে উপস্থিত কবি কৃষ্ণা বসুও। হাসানভাই তাঁর বরিশাল ভ্রমণের কথা বলছিলেন পরম উৎসাহে। অল্প কিছু দিন আগে তাঁর এক কন্যার বিয়ে হয়েছে ওই বরিশালেই। কৃষ্ণা বসু বরিশাল সম্পর্কে ওঁর কাছে কিছু জানতে চাওয়ায় শঙ্খ ঘোষ বললেন, “আমি খুব অপমানিত বোধ করছি।” আসলে তাঁর পিতৃভূমি বরিশালের কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে বর্ধমানের ভূমিপুত্রের কাছে জানতে চাওয়াতেই তাঁর এই কপট ক্ষোভ। তখন শঙ্খ ঘোষের কাছে কৃষ্ণা বসু জানতে চাইলেন, ওখানে অর্থাৎ জীবনানন্দের ওই শহরে কী ভাবে যাওয়া যায়, আকাশপথে না সড়কপথে! উত্তরে শঙ্খবাবু বললেন, “জলপথে না গেলে জীবনের অর্ধেকটাই বৃথা।” সঙ্গে সঙ্গে জীবনরসিক হাসানভাই বলে ওঠেন, “আর ডুবে গেলে পুরোটাই বৃথা।”
এই হলেন হাসান আজিজুল হক। বিরাশি বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁর মৃত্যুকে হয়তো অকালপ্রয়াণ বলা যাবে না। কিন্তু তাঁর কবোষ্ণ অনুপস্থিতি বাংলা সাহিত্যবিশ্বকে সারা ক্ষণ তাড়া করে ফিরবে, ফিরতেই থাকবে।