Education

যত বেশি জানে তত কম মানে?

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে গঠিত হয় দ্য থার্ড রাইখ— এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্র সমাজজীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে পারে।

Advertisement
ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২২ ০৫:০৭

১৯২৩ থেকে ১৯৪৩, অর্থাৎ বেনিতো মুসোলিনির শাসনকালের ইটালিতে পাঠ্যক্রমের আমূল সংশোধন হয়। সেই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্যই ছিল পাঠ্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে ইটালির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা— ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং ভাষাগত ভাবে। ১৯২৩ সালের জেন্টিল রিফর্মের আগে বিভিন্ন স্কুলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের ভাষা অর্থাৎ ফরাসি, জার্মান, বা প্রাচীন ভাষা ল্যাটিন ইত্যাদি শিক্ষার সমান প্রচলন ছিল। কিন্তু এই শিক্ষানীতিতে তা আর রইল না। শুধুমাত্র ইটালীয় ভাষাই শিখতে হবে, এমন ফরমানই জারি হল। পড়ানো হল বা হল না আরও অনেক কিছুই। যেমন, দেশ ঠিক কতটা, কোনখানে তার সীমানা শুরু বা শেষ, তা আন্তর্জাতিক ভাবে নির্দিষ্ট হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভার্সাই চুক্তি দ্বারা নির্দিষ্ট এই ভৌগোলিক সীমান্তকে মানতে অস্বীকার করা হল পাঠ্যক্রমে— বাদ দেওয়া হল সেই সীমান্ত নির্ধারণের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাও। তৎকালীন ইটালির সীমার বাইরের যে সব জায়গা অতীতে রোমান সভ্যতার বা প্রাচীন ইটালীয় রাজ্যের অন্তর্গত হয়ে থাকলেও থাকতে পারত, পাঠ্যপুস্তকে সেই অংশগুলিকেও ইটালির ভৌগোলিক সীমার অংশ বলে দেখানোর চেষ্টা হতে থাকল।

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে গঠিত হয় দ্য থার্ড রাইখ— এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্র সমাজজীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। পাঠ্যক্রমের সঙ্কোচন হল— ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ শিক্ষা, ইংরেজি, ফরাসি, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষাশিক্ষা, ভাষা ব্যাকরণকে বাদ দেওয়া হয়, পাঠ্যক্রমে থেকে যায় শুধু ইতিহাস, রেশিয়াল সায়েন্স বা বর্ণবিদ্বেষের বিজ্ঞান ও দিনে আবশ্যিক ৫ ঘণ্টা শরীরচর্চা। তৈরি করা হয় নতুন পাঠ্যবই, যাতে ভৌগোলিক ইতিহাসে বাদ দেওয়া হয় দেশীয় সীমান্তের মাত্রা, আগের প্রাশিয়ান শাসন এবং তার দীর্ঘ ইতিহাস— পড়ানো হয় শুধু ‘লেবেন্সরাউম’ নীতি, এবং সব ঐতিহাসিক সীমান্তকে অগ্রাহ্য করে আগ্রাসনের গুরুত্ব। জীববিজ্ঞানে পড়ানো হল শুধু ‘ইউজেনিক্স’ তত্ত্ব— যা বলে যে, শ্বেতাঙ্গ জাতিরা অন্যান্য জাতির তুলনায় শারীরিক ভাবে সক্ষমতর, তাই প্রজননের অধিকার শুধু থাকা উচিত তাদেরই। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ সাল অবধি প্রতি বছর একটু একটু করে আগের পাঠ্যক্রমকে পরিবর্তিত ও সঙ্কুচিত করে তৈরি হয় এই আমলের শিক্ষানীতি।

Advertisement

এই সব ইতিহাস মনে পড়ছে, সাম্প্রতিক কালে ভারতের স্কুলপাঠ্য সিলেবাস যে ভাবে রদবদল হচ্ছে তা দেখেই। সত্যি কথা বলতে, রদবদল যে কোনও পাঠ্যক্রমে ঘটানো যেতেই পারে, অনেক সময় পরিবর্তন স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াও হতে পারে। দেখা দরকার, পরিবর্তনটা কী করা হচ্ছে, এবং কেন— তার অন্তর্নিহিত ভাবনাটা ঠিক কী। সেই ভাবনায় যদি পৌঁছতে চাই, তা হলেই, দুর্ভাগ্যক্রমে, ইতিহাসে পড়া এই সব উদাহরণ চোখের সামনে ভাসতে শুরু করে। সম্প্রতি সিবিএসই-র একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে বাদ পড়েছে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বেশ কিছু অংশ। সাধারণ ভাবে বলা হয়েছে, সিলেবাসের ভার লাঘব করাই এই প্রচেষ্টার কারণ। কিন্তু সিলেবাসের ঠিক কোন কোন অংশের ভার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, দেখলে উদ্বেগের বিস্তর কারণ আছে।

যেমন, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস থেকে বাদ পড়তে চলেছে মোগল যুগ। ১৫২৬ সালে স্থাপিত এই তিন শতাব্দীব্যাপী সাম্রাজ্যের ইতিহাস, সেই সময়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস আর পড়তে হবে না ছাত্রছাত্রীদের। কেন, তা অনুমান করতে সমস্যা নেই— কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে। ভারতবর্ষের ইতিহাসকে হিন্দু ও বৈদিক ইতিহাস বলে শেখানো তখনই সম্ভব, যদি এই পর্বের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া যায়। মোগল আমলের আর্থিক নীতির কথা, কিংবা আকবরের মতো কিছু শাসকের সুশাসনের কথা পড়লে ‘বিধর্মী’ শাসককে অত্যাচারী বলে প্রমাণ করা কঠিন। তাই ইতিহাসের সাড়ে তিন শতাব্দী— ১৫২৬-১৮৫৭, এই সময়কালকে উড়িয়ে দেওয়াই সহজ ঠেকে।

পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ঠান্ডা যুদ্ধের ইতিহাসও। হয়তো ঠান্ডা যুদ্ধের কথা বলতে হলে ভারতের নীতির কথা উঠে আসবে, হয়তো নন-অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্ট অর্থাৎ নির্জোট আন্দোলনের প্রসঙ্গ আসবে, এবং সেখানে নেহরুর কৃতিত্ব স্বীকার করতে হবে।

একই ভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে নাগরিকত্ব, গণতন্ত্র, বৈচিত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি। কী পড়ানো হত এই বিষয়গুলিতে? নাগরিকত্বের মূল শর্ত কী, গণতন্ত্রের কোন শর্ত লঙ্ঘিত হলে সংবিধানের অবমাননা হয়, বিভিন্ন বর্ণ-জাতি-ধর্মের মানুষের বৈচিত্রকে রক্ষা করা
সরকারের কর্তব্য কেন, এই কথাগুলো পড়ানো হত। এ সব পড়ে কোনও ছাত্র যদি শাসকদের অনৈতিকতাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, যদি জানতে চায়: ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ তাই সতর্কতা চাই, পাঠ্যক্রমেই।

শাসকের পরিবর্তনের ফলে শিক্ষানীতির পরিবর্তন আমাদের দেশ, এমনকি আমাদের রাজ্য আগে দেখেনি, তা নয়। এখনও নানা রকম পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে রাজ্য স্তরের স্কুলশিক্ষার সিলেবাসেও। পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলের সিলেবাস নিয়েও অনেক কথা বলার অবকাশ ছিল, বর্তমান আমলের সিলেবাস নিয়েও নানা আপত্তি উঠতে পারে। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আনা ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্যক্রমের বদলের চরিত্রটাই একেবারে আলাদা, এ দেশের অভিজ্ঞতায় অভূতপূর্ব— এবং দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে বিপজ্জনক। অথচ এই নিয়ে খুব কম কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে এখনও। ছেলেমেয়েদের মগজধোলাইয়ের ব্যবস্থা দেখেও যদি নাগরিক সমাজ চুপ করে থাকে, শিক্ষাবিদরা কিছু না বলেন, তা হলে ভবিষ্যৎ দেশের চেহারাটা কী রকম হবে, আমরা বুঝতে পারছি কি?

আরও পড়ুন
Advertisement