Yogi Aditynath

মেয়েদের ভাগ্যও ভোটের বাক্সে

আদিত্যনাথ ফিরে এলে তা উত্তরপ্রদেশের মেয়েদের ঝুঁকি বাড়াবে, কমাবে না।

Advertisement
নেহা দীক্ষিত
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২২ ০৪:৪৬

মেয়েদের স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাখা চলে না, মনে করেন যোগী আদিত্যনাথ। ২০১৪ সালে তাঁর ওয়েবসাইটে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “ঠিক যেমন শক্তিকে অনিয়ন্ত্রিত, লাগামহীন করে রাখলে তা ব্যর্থ এবং বিধ্বংসী হয়ে ওঠে, তেমনই ‘শক্তিস্বরূপা স্ত্রী’-এর জন্য আসলে স্বাধীনতার দরকার নেই, তাদের ‘সুরক্ষিত’ রেখে এবং যথাযথ পথে প্রবাহিত করে তাকে একটা অর্থপূর্ণ ভূমিকা দিতে হবে।” তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি গভীর ভাবে হিন্দুত্বের মতাদর্শে নিহিত। সেখানে মেয়েদের দেখা হয় মা-বোন বলে, স্বতন্ত্র ব্যক্তি বলে নয়। তিনি লিখছেন, “সেই ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং সুরক্ষিত মেয়েরাই এমন সন্তানের জন্ম দিতে পারে যারা প্রয়োজনে অশুভ শক্তি বিনাশের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে... না হলে পাশ্চাত্য থেকে বয়ে আসা অসার নারী স্বাধীনতার ঝড় তাদের আরও ভয়ানক অবস্থায় নিয়ে যাবে, ঘর ও পরিবারের উৎপাদন, স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ণ হবে, জাতি ও মাতৃভূমির গৌরবময় পুনর্গঠন বাধাপ্রাপ্ত হবে।”

যোগী আদিত্যনাথ সংসদে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের প্রস্তাবিত আইনেরও বিরোধী। তাঁর মতে, এর ফলে পরিবারের গঠনের উপর প্রভাব পড়বে। তিনি লিখছেন, “বিবেচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, মেয়েরা পুরুষদের মতো সক্রিয় রাজনীতিতে থাকবে কি না, এই প্রক্রিয়ায় তাদের মা, কন্যা, বোনের ভূমিকার গুরুত্ব কমবে কি না।” নির্বাচনে মহিলা ভোটারদের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ার জন্যই হয়তো এখন ওয়েবসাইট থেকে প্রবন্ধটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

Advertisement

আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে মহিলাদের উপর জঘন্যতম অপরাধগুলি ঘটেছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে, আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী পদ গ্রহণ করার মাত্র তিন মাস পরে, উন্নাও জেলার সতেরো বছরের একটি মেয়ে গণধর্ষিত হয় বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার এবং তাঁর সহযোগীদের দ্বারা। পরবর্তী দু’বছর সেঙ্গার এবং তাঁর পরিবারকে মুখ্যমন্ত্রী সহায়তা দিয়ে যান, মেয়েটির পরিবার ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ে। ন্যায় পাওয়ার আশায় মেয়েটি মুখ্যমন্ত্রীর আবাসের সামনে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, তবু তাকে উপেক্ষা করেন আদিত্যনাথ। মেয়েটির বাবাকে গ্রেফতার করে পুলিশ, হাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। মেয়েটির পরিবারের উপর বার বার আঘাত নেমে আসে— কাকাকে গ্রেফতার করে পুলিশ, দুই কাকিমা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায় প্রাণ হারায়। সেই দুর্ঘটনাতেই মেয়েটি এবং তার আইনজীবী গুরুতর আহত হয়। নাগরিক সমাজের তীব্র প্রতিবাদ, সুপ্রিম কোর্টের সক্রিয়তা এবং বিরোধী দলগুলির সংসদে হইচইয়ের জেরে সেঙ্গারকে গ্রেফতার করা হয়।

সেটা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর। তার ন’মাসের মধ্যে ঘটে গেল হাথরস, এক ১৯ বছরের দলিত কন্যা ধর্ষিত হল উচ্চবর্ণ পুরুষের দ্বারা। সেখানেও প্রথম দশ দিন কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। মেরুদণ্ডে আঘাত লেগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায় মেয়েটি, কেটে নেওয়া হয় তার জিভ। দু’সপ্তাহ পরে দিল্লির হাসপাতালে মারা যায় সে। রাজ্য সরকার মাঝরাতে তার দেহ জ্বালিয়ে দেয়, পরিবারের সম্মতির তোয়াক্কা না করেই। দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। আদিত্যনাথ দাবি করেন যে তাঁর সরকারের কাজে অগ্রগতিতে যারা ক্ষুব্ধ, এবং যারা বর্ণবিদ্বেষ উস্কে দিতে চায়, তারা হাথরসের ঘটনাকে কাজে লাগাচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে শান্তি বিঘ্নিত করার অভিযোগে উনিশটি মামলা দায়ের করা হয়, যোগ করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ষড়যন্ত্র এবং নানা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার অভিযোগ। গ্রেফতার যাঁরা হলেন, তাঁদের অন্যতম সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে যিনি ষোলো মাস কারাবন্দি। আদিত্যনাথের সরকার মুম্বইয়ের একটি জনসংযোগ সংস্থাকে নিয়োগ করে, যারা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচার করে যে হাথরসের তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়নি।

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আদিত্যনাথ বক্তৃতায় বলেন, “ওরা যদি একটা হিন্দু মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়, আমরা একশো জন মুসলিম মেয়েকে তুলে আনব।” তাঁর ‘লাভ জেহাদ’ তত্ত্ব, অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের বিস্তারের কৌশল হিসাবে হিন্দু মেয়েদের ভালবাসায় ভুলিয়ে ধর্মান্তরের তত্ত্বের সত্যতা নানা রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ অনুসন্ধান করেছে। কোথাও এমন সংগঠিত উদ্যোগের প্রমাণ মেলেনি। এই তত্ত্ব সাম্প্রদায়িক তো বটেই, তা ছাড়াও হিন্দু মেয়েদের বুদ্ধির অবমাননা। মেয়েদের স্বাধিকার, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা, সম্মতিদানের অধিকার এবং জীবনসঙ্গী নির্বাচনকে নস্যাৎ করে দেয় ‘লাভ জেহাদ’-এর ধারণা।

২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কিছু দিন পরেই আদিত্যনাথ ‘অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড’ তৈরি করেন, যারা প্রকাশ্য রাস্তায় ছেলেমেয়েদের পরিচয়পত্র দেখতে চায়, হিন্দু মেয়েরা মুসলিম ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করছে কি না তা বুঝতে। অছিলা ছিল যৌন হয়রানি থেকে মেয়েদের সুরক্ষা। মার্চ ২২, ২০১৭ এবং নভেম্বর ৩০, ২০২০, এই সময়কালের মধ্যে অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড ১৪,৪৫৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। যোগী আদিত্যনাথ সরকার ‘মিশন শক্তি’ শুরু করার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই আইন পাশ হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এই আইনের অধীনে প্রথম দোষী সাব্যস্ত হন কানপুরের এক যুবক। দশ বছরের জেল এবং তিরিশ হাজার টাকা জরিমানা হয়েছে তাঁর। প্রাক্তন সাংসদ সুভাষিণী আলি মনে করেন, এই আইন হল একই সঙ্গে মুসলিম পুরুষদের গ্রেফতার, এবং হিন্দু মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র।

এই সবই এক পিচ্ছিল, ঢালু পথের নির্দেশ দেয়। তাই আদিত্যনাথ ফিরে এলে তা উত্তরপ্রদেশের মেয়েদের ঝুঁকি বাড়াবে, কমাবে না।

আরও পড়ুন
Advertisement